প্রকাশ : ১০ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০০:০০
আজ আমি পুরোদমে একজন বাবা। আমার ফুটফুটে কন্যাসন্তান আছে। এই নামটা আমার প্রিয় এক শিক্ষিকা রেখে দিয়েছেন। আমার মেয়ের নাম সুহাসিনী। আমার প্রিয় শিক্ষিকার নাম শিশির। এইবার আসি মূল কথায়। আজ থেকে পনের বছর আগের কথা। আমি তখন কলেজের ছাত্র। সে এক ভালো লাগার বয়স। তবু পড়াশোনায় সিরিয়াস ছিলাম। ক্লাস শুরু হওয়ার ঠিক দুমিনিট আগে সবাই বললো শিশির ম্যাম আসছে। ক্লাসে ঢুকতেই আমরা সবাই দাঁড়িয়ে গেলাম। ম্যাডাম হেসে বললো, সবাই কেমন আছো? সমস্বরে সবাই জবাব দিলো। প্রত্যেকেই বলাবলি করছে ম্যাডাম অনেক শান্ত। আমরা বলাবলি করলাম, ম্যাডাম বোধহয় কঠোর হবেন না।
ম্যাডাম আমাদের বললো, আজ ছেলেদের একটা কথা বলবো। এমন সময় আমাকে দাঁড় করালো ধরো তোমার বোনের সাথে কেউ ফ্লার্ট করলো তুমি তাকে কী বলবে? আমি বললাম, তাকে আমি অমানুষ বলবো।
তারপর ম্যাডাম সামনে গিয়ে বললো, আজ তোমাদের প্রত্যেককে বলবো মানুষ হবে। আজ তোমরা ছেলে, তারা একদিন বাবা হবে সেদিন জানবে মেয়ের বাবা হওয়ার মূল্য কতো।
আজ যারা ক্লাসে আছো, প্রত্যেকে ভালো মতো পড়াশোনা করবে। জীবনে সৎ মানুষ হবে। চোখ, মন সংযত করবে। আজ তোমরা এই ভাবো কখনো কারো কান্নার কারণ হবে না।
আমরা প্রত্যেকে হা করে তাকিয়েছিলাম। সেদিন আমরা কলেজ থেকে ফেরার পথে সহপাঠীদের কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গিয়েছি। মনে পড়েছে ম্যাডামের কঠিন কথা। আমরা প্রত্যেকেই দেখেছি ম্যাডাম কিভাবে অশ্রু ধরে রেখেছিলো। অবশ্য ম্যাম প্রথম ক্লাসে বলেছিলো, আমার নারীদের নিয়ে কাজ করতে শিক্ষকতা পেশা বেছে নিয়েছি। আমি সবসময় চেয়েছি মানসিক স্বাস্থ্যে সেবায় কাজ করবো।
পরের দিন ক্লাসে একটা জটলা বাধলো। কেউ কেউ ম্যাডামের এই কথাটা আমি আব্বু-আম্মুকে বলেছি। তারাও বললো, বাবা তোমার গুরু। জীবনের শুরুতে এই শিক্ষাটা তোমার জন্যে প্রয়োজনীয়। গুরু তো তোমাকে শুধু পাঠ্যপুস্তক বিষয়ে পাঠদান করাবে তা নয়, এর বাহিরে তোমাদের অনেক কিছু শেখাবে।
কেউ কেউ বললো, তাহলে কি আমরা প্রেম করবো না?
আমি বললাম, ম্যাম বলেছে চোখ, মন সংযত করতে তার মানে যাই করো কারো ক্ষতি কিংবা কষ্টের কারণ না হয়।
এবার সবাই বললো, ম্যামের মতো মানুষ হয় না। সেদিন থেকে ম্যাম সবার প্রিয়। ম্যামের ক্লাস শেষ হওয়ার প্রতি পাঁচ মিনিট আমাদেরকে ভালো মানুষ হওয়ার জন্যে নানাবিধ উদাহরণ দিতেন।
একদিন ম্যামের সাথে তার ছোট্ট ছেলে আলিশ এসেছে। সে-ও ক্লাসে ঢুকলো। আমরা আবার অবাক। ম্যামের বাচ্চা আছে।
আলিশ ক্লাসে ঢুকে বললো, আমার নাম আলিশ। মা বলেছে, ভালো মানুত হতে। আমি ভালো মানুত। কিন্তু মা বলে যখন তুমি বড় হবে তখনও ভালো মানুষ থাকবে। আচ্ছা বলো তো, ভালো মানুষ কি খারাপ হয়? আমি মাকে বোঝাতে পারি না।
ম্যাডাম বললো, আলিশ যাও রাবেয়া আন্টি ডাকছে। তারপর ডাস্টার হাতে নিয়ে বললো, মনোবিজ্ঞান বইটা বের করো। ক্লাস শেষে বললো তোমরা সবাই ভালো মানুষ হয়ে থেকো। ছোট্টবেলায় প্রত্যেকেই ভালো থাকে। কিন্তু আমি চাই তোমরা প্রত্যেকে যৌবন-বৃদ্ধ সব বয়সে ভালো মানুষ থাকবে।
আমরা বড্ড অবাক হয়ে ম্যাডামের তাকিয়ে থাকতাম। ম্যাডাম মেয়েদের বেশিই ভালোবাসতো। তাদের প্রতিনিয়ত বলতো তোমরা যারা কঠিন পর্যায়ে আছো সেখান থেকে নিজেই নিজে মোকাবিলা করতে পারো না তারা আমার সাথে কথা বলবে। আমি কিছুটা মানসিকভাবে সেবা দেবো।
আমরা আরো অবাক হয়ে যেতাম। তারপর ম্যাডাম আরো বললো, আমি তিনটি মাস্টার্স পড়েছি। তারপর এম.ফিল. এবং পি.এইচ.ডি. করেছি। এমনকি এল.এল.বি. পড়েছি। যা কিছু পড়েছি তা তোমাদের মেয়েদের সেবার জন্যেই পড়েছি। আমরা কেমন যেনো হকচকিয়ে গেলাম।
ম্যাডাম বললো, আমার মা বলতো তুমি কি পড়তে পড়তে বুড়ো হবে?
আমি তখনি বলতাম, মা আমাকেই যে পড়তে হবে।
তারপর মেয়েদের নিকট ম্যাডাম হলো ভরসার জায়গা। এভাবে পুরো কলেজের সবাই ম্যাডামের নিকট মানসিক সেবা নিতে আসতো। ম্যাডাম একটা চেম্বার খুললো। সেখানে সপ্তাহে দুদিন দুই ঘণ্টা বিনামূল্যে মানসিক চিকিৎসা দেয়া হতো। সেটা শুধু শিক্ষার্থীদের জন্যে ছিলো। একদিন কলেজে একটা অনুষ্ঠান হলো। সেখানে আমরা সবাই দাবি করলাম আজ যেনো ম্যাডাম কিছু বলে।
অধ্যক্ষ স্যার বললো, ম্যাম আপনি কিছু কথা বলেন। এই সমাজে আপনি হলেন মেয়েদের অনুসরণীয়।
ম্যাডাম স্টেজে উঠলো।
ম্যাডাম বক্তব্য শেষে বললো, শোনো আমার মেয়ে বাচ্চারা, তোমরা যারা জীবনের চরম হতাশা, দুঃখ মধ্যে দিয়ে যাচ্ছো তাদের জন্যে আমি আছি। আমি কিছুটা হলে মানসিকভাবে আরাম দেবো। কথাগুলো বলতে বলতে ম্যাডামের গলা আর চোখ ভারী হয়ে আসলো।
প্রিন্সিপাল স্যার মাইক নিয়ে বললো, শিশির আমার মেয়ের মতো। সে যে তোমাদের নারীদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কতো ভাবে আমি জানি। তার স্বপ্ন, চেষ্টা, ভাবনাতে শুধুই তোমরা বসবাস করো। আমি সত্যিই ভাগ্যবান আমার কলেজে এই রকম শিক্ষিকা পেয়েছি।
সেদিন থেকে আমি নারী জাতিকে ভিন্নভাবে দেখা শুরু করলাম। কারণ ম্যাডামের চোখে পানি দেখেছি। সেই কান্না আমাকে পরিবর্তন করেছে। আমার কন্যাটা যেদিন কোলে এলো সেদিন একজন মেয়ে বাবা হওয়ার কতোটা কঠিন বুঝলাম। সেদিন আমার কন্যার জন্যে সুন্দর পৃথিবীর প্রয়োজন বোধ করলাম। সেদিন আমি অক্ষরে অক্ষরে বুঝলাম ম্যাম কেনো প্রতি ক্লাস শেষে বলতো তোমরা মানুষ হও।
লেখা পাঠানোর ই-মেইল : [email protected]