মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২০ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার
  •   দৈনিক ইনকিলাবের প্রশাসনিক কর্মকর্তা শহীদুল্লাহ্ মিজির দাফন সম্পন্ন
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা

প্রকাশ : ১৩ আগস্ট ২০২২, ০০:০০

যাত্রাপথের গল্প
অনলাইন ডেস্ক

এটাকে এক প্রকার মেলাই বলা যায়। মেলা না বলে অবশ্য উপায়ও নেই। মেলাতে যেমন নানান জনপদের হাজার রকমের মানুষ জড়ো হয়, এখানেও তাই। কত প্রকারের মানুষ যে সারা বগিজুড়ে ছুটে বেড়াচ্ছে তার হিসাব করতে গেলে যন্ত্র নিয়ে বসতে হবে। তাতেও কুলাবে কি-না সন্দেহ আছে। সবাই যে বগিময় ছুটে বেড়াচ্ছে সেটা ঠিক নয়। বসার জন্য এখানে অসংখ্য সিট রয়েছে। তবে যে দ্রুতগতিতে দেশের জনসংখ্য বাড়ছে তাতে সবার পক্ষে বসার জন্য সিট পাওয়া সম্ভব নয়। ভাগ্যবানরাই কেবল এখানে বসার সুযোগ পায়। আর ঈদ কিংবা অন্য কোনো ছুটির সিজন হলে তো কথাই নেই। বাশারের মনে হয় এত মানুষ হওয়ার কোনো দরকার ছিল না। অল্প সংখ্যক মানুষ হবে; সবাই যার যার ইচ্ছামতো ছুটে বেড়াবে। এত মানুষের থাকার জায়গা জোগাড় করাই তো কষ্টকর। ছোটাছুটি করা তো বহুত পরের ব্যাপার।

কপোতাক্ষ এক্সপ্রেস। শিক্ষানগরী রাজশাহী থেকে শিল্পনগরী খুলনার দিকে ঝড়ো হাওয়ার বেগে ছুটে চলেছে। বাশারের একটু ঝিমুটি এসেছিল। ট্রেনে উঠলে এই এক সমস্যা! দুলুনিতে খালি ঘুম পায়। সমস্যাটা খালি তার একার নয়। বাশারের পাশের লোকটা মুখ হাঁ করে ঘুমাচ্ছে। মুখের ভেতর রাজ্যের ধুলো-ময়লা সমানে ঢুকছে। লোকটা পাগল নাকি!

ট্রেন একটা স্টেশনে এসে থেমেছে। বাশার জানালা দিয়ে গলা বাড়িয়ে দেখল- ঈশ্বরদী। জায়গাটার নাম বহুবার আব্বার কাছ থেকে শুনেছে। জায়গাটা তার বিশেষ পছন্দের ছিল।

‘ও ভাই, দুডে টাহা দেবেন?’

বাশার দেখল এক খোঁড়া লোক ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে এসে ওর জামা খামছে ধরে আছে। বাশারের মেজাজ গরম হয়ে গেল। পকেট থেকে এক টাকার দুটি কয়েন বের করে দিল।

‘এইডে কী দেলেন ভাই?’

বাশার এবার রাগ দমন করতে পারল না। কড়া মেজাজেই বলে উঠল, ‘ক্যান, হইছে ডা কী? দুই টাহাই তো দিলাম।’

‘এই এক টাহার কয়েল এহন চলে? আমি নেব না। আপনার টাহা আপনি রাইহে দেন।’

‘ওরে আমার জমিদার রে!’

খেঁকিয়ে উঠল বাশার। 'ওর বেশি আমি দিতি পারব না। না নিলি কিছু করার নাই।'

ফকির গজরাতে গজরাতে চলে গেল। তবে টাকা দুটি ততক্ষণে ঠিকই পকেটে পুরে নিয়েছে।

ফকির বিদায় হতেই ও একটু সুস্থির হয়ে বসল। ট্রেন ততক্ষণে ঈশ্বরদী স্টেশন পেছনে ফেলে চলতে শুরু করেছে। সিটে মাথা হেলিয়ে দিয়ে চোখটা একটু বুজল।

‘এই যে ভাই, এই সিটটা আমার’।

বাশার চোখ খুলে দেখল এক মাঝবয়সী মহিলা ঘাড়ের ওপর এসে দাঁড়িয়ে রয়েছে। মহিলার হাতে একটা ব্যাগ। কোলে বাচ্চাকাচ্চা কিছু নেই। বাশার ভাবল, এই মহিলার যা বয়স তাতে দু-তিনটে বাচ্চাকাচ্চা থাকা বিচিত্র কিছু নয়। এর সঙ্গে নেই কেন!

‘এই যে ভাই, আপনি শুনতে পাচ্ছেন না? এই সিট আমার। আপনি এখানে বসে রয়েছেন কেন?’

‘আপনার সিট মানে? আমি সেই রাজশাহী থেকে টিকিট কেটে উঠেছি।’

‘সেটা জেনে আমি কী করব? আপনি আমার সিট ছাড়েন।’

মহিলার ভঙ্গি মারমুখী।

চিৎকার শুনে ট্রেনের একজন লোক এগিয়ে এলো। লোকটার পদবি কী বাশার তা বলতে পারবে না। গায়ে সাদা ড্রেস পরা দেখে ও ব্যাপারটা ধারণা করেছে। লোকটি বলল, 'কী হয়েছে, ম্যাডাম?'

‘দেখুন না ভাই। আমার সিট এই লোকটা দখল করে বসে আছে!’

মহিলার রাগ পূর্বের চেয়ে আরও বেশি বলে মনে হলো।

‘আপনার টিকিট দেখি?’

মহিলার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন তিনি। মহিলা টিকিট বের করে হাতে দিল।

‘আপনার বগি নম্বর তো গ। আপনি এখানে কী করছেন?’

মহিলা ভালো মতো টিকিট চেক করে খানিকটা যেন লজ্জা পেল।

‘আমি দুঃখিত ভাই।’

মহিলা এমন একটা হাসি দিল তা দেখে বাশারের মুখ দিয়ে একটা কথা বেরিয়ে এলো, 'ঢং দেখলি পরে হইয়ে সারে!'

বাশারের আবার চোখ বুজে এসেছিল। হঠাৎ কানের কাছে ছোট্ট একটা শিশু তারস্বরে চিক্কুর মেরে উঠল। আশপাশে যারা সিটে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে গিয়েছিল তারা বিরক্তিকর চোখে শিশুটির মায়ের দিকে তাকাল। সব দোষ যেন মায়ের! শিশু কোনো কারণে কেঁদে উঠলেও মায়ের দিকে আঙুল তুলতে হবে। ভাবটা এমন- মা কাছে থাকা অবস্থায় সন্তান কেঁদে উঠল কেন!

বাশার এবার একটুও বিরক্তিবোধ করল না। বরং ওর এক অদ্ভুত প্রশান্তি বোধ হতে লাগল। এই ভেজাল মানুষের ভিড়ে এই প্রথম ও নির্ভেজাল কোনো শব্দ শুনতে পেল। বাশারের খুব ইচ্ছা করছিল শিশুটিকে বুকে জড়িয়ে ধরে বড়সড় একটা ধন্যবাদ দিতে। ইচ্ছেটাকেও দমন করতে হলো। এত মানুষের ভিড়ে এই কাজ করা কিছুতেই সম্ভব নয়। নিজের সন্তান হলেও না হয় একটা কথা ছিল।

দিনের আলো এতক্ষণে ফুরিয়ে এসেছে। তবে পুরোপুরি আঁধার নেমে আসতে এখনও বেশ দেরি। ট্রেন প্রবলবেগে গন্তব্যের দিকে ছুটে চলেছে। এখন কোথায় আছে তা অবশ্য জানে না। জানার কোনো উপায়ও নেই। চারদিকে ধানক্ষেত। গাছের ডগায় হলুদ ধানের শীষ পরম মমতায় আশ্রয় নিয়েছে। পথের দু'পাশে নাম না জানা শত গাছের সমাহার। দু'দিকে দিগন্ত বিস্তৃত ফসলের মাঠ। ট্রেনে কোথাও গেলে এই এক সুবিধা। ট্রেন চলে যথাসম্ভব গাঁয়ের পথ ধরে। আঁকাবাঁকা পথে সাপের মতো ট্রেন যখন চলতে থাকে তখন বাশার জানালা দিয়ে চোখ বাড়িয়ে দেখে। ট্রেনের লেজের দিকটাকে ওর সাপের লেজ বলে মনে হয়। ছোটবেলায় একবার একটা সাপকে ও ফুটবলের মতো লাথি মেরেছিল। সহসা সেই সাপটির কথা মনে পড়ে যায়।

এখানে ভেজাল মানুষের সমাহার। মেলার মতো জনস্রোত এখানে এসে আছড়ে পড়ে। তবুও বাশারের ভালো লাগে। বারবার তাই এ বগি ও বগি খুঁজে নিজের আসনটি আবিস্কার করে আনন্দে শিউরে ওঠে।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়