প্রকাশ : ০৬ আগস্ট ২০২২, ০০:০০
রিতা আর রাকিবকে পড়ানোর জন্যে একটা মেয়ে খুঁজছি অনেকদিন যাবৎ। মনের মতো গৃহশিক্ষক না পেয়ে আমার অস্থিরতা দেখে বন্ধু রাসেল একটা মেয়েকে ঠিক করে দেয়। সপ্তাহে চারদিন আসে মেয়েটা। শুক্র, শনি আর মঙ্গলবার আসে না। তাই আমার সাথে দেখাও হয় না। বিনীতা বলল, ইপ্সিতা ভালোই পড়ায়। সবচেয়ে বড় কথা রিতা আর রাকিব ওর পড়ানোর ধরণটা ধরতে পেরেছে।
বিনীতা আমার সতেরো বছরের বিবাহিতা স্ত্রী। রাকিব হওয়ার সময় ওর অনেক সমস্যা হয়। সেই থেকে আস্তে আস্তে অসুস্থ। এখন ঘর-সংসারের কাজ খুব একটা করতে পারে না। আমাদের পাশের গ্রামের হনুফাকে নিয়ে এসেছি সেই ৫/৬ বছর আগে। সম্পর্কে হনুফা আমার ফুফু হয়। বয়সে আমার অনেক ছোটই। একটু সহজ সরল বলেই স্বামীর সংসার টিকেনি। আমার কোমর ভাঙ্গা সংসারটাকে সেই আবার দাঁড় করেছে। ওর প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।
হাজার চিন্তার মাঝে একটা চিন্তা কমে গেলো। বিগত ৬/৭ মাসে ইস্পিতার সাথে আমার দেখা হয়নি। হবে কী করে, শুক্রবার ছাড়া বাকি ছয় দিন আমার অফিস। রোজ সকাল ছয়টা ত্রিশ মিনিটে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেস হয়ে নাস্তা করে সাতটা পঁয়তাল্লিশ মিনিটে বের হতে হয়। অফিসের গাড়ি ছাড়ে ঠিক আটটায়। গাড়ির কাছে আসতে লাগে দশ মিনিট। কখনও কখনও সাতটা ত্রিশ মিনিটে অধরার কল আসে, ওর সাথে কথা বলতেই বলতেই গাড়িতে উঠি।
কয়েকদিন যাবৎ দেখছি ছাব্বিশ/সাতাইশ বছর বয়সী একটা মেয়ে ঠিক এই সময় গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে থাকে বাসের জন্যে। কখনও আমার আগেই সে বাসে উঠে আবার কখনও আমার পরে। মেয়েটা আমাকে দেখলেই তাকিয়ে থাকে। ওর এই তাকানোর কারণেই ওর প্রতি আমার কৌতুহল বাড়ে। হিসাব করে দেখলাম ও পুরা সপ্তাহের মাত্র শনি আর মঙ্গলবার এখানে আসে। সপ্তাহে দুদিন কারো চাকরি থাকতে পারে এটা নতুন দেখছি। যাক পুরো দুই মাস এটা লক্ষ করলাম। কেনো জানি মেয়েটাকে আমার চেনা চেনা লাগছে। প্রথমে ভেবেছি কৌতুহল হতে হতেই হয়তো এমন হচ্ছে। কিন্তু ভাবনার জগৎ থেকে বের হতেই পারি না। মেয়েটার চেহারা হুবহু মিলে যাচ্ছে আমার মায়ের সাথে। আমার বয়স যখন নয় বছর তখন মা না-ফেরার দেশে চলে যান। গতবছর চলে গেলেন বাবা। আর ভাইয়া তো হঠাৎ করেই চলে গেলো, কিছুই বলে গেলো না। কখনই ভাবিনি ভাইয়া এতোটা নিষ্ঠুর হতে পারবে।
মেয়েটা আমায় যতোটা দেখছে, তার চেয়ে আমিই দেখছি বেশি। ইদানীং আমি সাতটা ত্রিশেই চলে আসি গাড়ির কাছে, শুধু ওকে দেখার জন্যে। এখন প্রতি শনি ও মঙ্গলবার আমিই আগে আসি। ও আসে একটু পরে। মা যখন চলে যান তখন উনার বয়স এমনিই ছিলো, নয়তো একটু এদিক-ওদিক হবে। মায়ের সাথে আমার স্মৃতি খুব কম মনে পড়ে। মা যখন পুকুর ঘাটে যেতেন, আমি পেছন পেছন যেতাম। মা ঘাটে কাজ করতেন আমি পাড়ে বসে মায়ের কাজ দেখতাম। মায়ের সাথে গল্প করতাম। আরেকটা স্মৃতি হলো মায়ের রান্না করার সময়। ওই ধোয়ার মাঝে মায়ের চোখে পানি আসতো, আমি মায়ের চোখ মুছে দিতাম।
মায়ের সাথে এই মেয়েটির চেহারার মিলের কথা আমি কাকে বলবো। বাবা বেঁচে থাকলে বলতে পারতাম। ভাইয়া থাকলে বলতে পারতাম। কিন্তু আজ তো ওরা কেউই নেই। বিনীতা তো এই পরিবারে এসেছে মাত্র সতেরো বছর হলো। ও মায়ের একটা ছবিও দেখেনি। সেই সময় ক্যামেরা-ট্যামেরা ছিলোই না। বাবা বেঁচে থাকতে রিতাকে বলতো, রিতা নাকি দেখতে মায়ের মতো হয়েছে। কিন্তু আমি ঠিক মনে করতে পারি না। সেদিন মেয়েটাকে দেখেছি, অফিস যেতে যেতে শুধুই ভেবেছি ওর কথা। কী করে এতো মিল হতে পারে মায়ের সাথে ওর। সেই সকাল থেকেই আজ মনে পড়ে সালমা আপুকে। এই জীবনে একবার তাকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। ভাইয়া আর সালমা আপুর মাঝে খুব সুন্দর একটা সম্পর্ক ছিলো। কী মায়াবী সেই চোখ সালমা আপুর, ভাইয়াই বলেছিলো আপু ডাকতে। ভাইয়াও চলে গেলো, সালমা আপুর কোনো খোঁজ নেই। ঠিক করে নিই মেয়েটার সাথে কথা বলতেই হবে। দিনটি ছিলো শনিবার, আমি নিজেই এগিয়ে যাই।
-তোমার সাথে একটু কথা ছিলো, তুমি কোথায় যাবে?
-উত্তরা চার নাম্বার সেক্টর।
-আমিও সেদিকে যাবো, আমরা কী আজ এক সাথে যেতে পারি।
-অবশ্যই।
আমরা একটা বাসে উঠি। পাশাপাশি কথা বলতে বলতেই যাই। ওকে যে মায়ের মতো লাগছে তা বলিনি। ওর কথা জিজ্ঞেস করতেই বললো, আমি মায়ের অফিসে যাই। মা একটা হাসপাতালে আয়ার কাজ করে। অসুস্থ শরীর টানা করতে পারে না, তাই শনি ও মঙ্গলবার কাজটা আমিই করি। মা বাসায় থাকেন। আমি আর মা এই এলাকায় থাকি, অন্যদিনগুলো আশপাশের কয়েকটা বাচ্চাকে পড়াই। আর শুক্রবার করে মা-মেয়ে একসাথে থাকি।
-তোমার বাবা নেই?
-না, আমার জন্মের আগেই বাবা। (এই বলতেই থেমে যায়।)
-উনি কি হারিয়ে গেছেন।
-মা কিছু বলেননি।
-তোমার আত্মীয়স্বজন কেউ নেই।
-আছে, আমি কাউকে চিনি না। মাকে জিজ্ঞেস করলে বলেন না কিছু।
-ভালো কথা, তোমার নামটাই শোনা হয়নি।
-আমার নাম খাদিজা আক্তার ইপ্সিতা।
-তুমি কি রিতা আর রাকিবকে পড়াও।
-জি¦, আপনি ওদের চিনেন।
-আমিই ওদের বাবা।
পরিচয় হবার পর ওর নম্বরটা আমি নিই। ওকে আমার নম্বরটা দিই। তবে আজকের আমাদের দেখা আর পরিচয়ের কথা কাউকে না বলতে অনুরোধ করি।
যতো দূর জানি আমার মায়ের নাম খাদিজা ছিলো, কিন্তু ওর নাম খাদিজা হয় কী করে? ইচ্ছে করেই পরের সপ্তাহে রোববার অফিস ছুটি নিই। বাসায় ছিলাম, এই সুযোগে ওর সাথে বাসায় দেখা হয়। কথা হয়। মাঝে মাঝেই কথা হয় ওর সাথে। এক শুক্রবার কল দিই ইপ্সিতাকে। ওর মায়ের সাথে কথা বলতে চাই। কথা হয়, কথা শুনেই বুঝতে পারি উনি আসলেই অসুস্থ। ইপ্সিতার কাছ থেকে ওদের বাসার ঠিকানা নিই, ওর মা অসুস্থ দেখতে যাবো এমনটা নয়। আমার কৌতুহল ওর চেহারা আর ওর নামটা। ইপ্সিতা আপত্তি করেনি বাসায় যাওয়ার ব্যাপারে। বিকেলেই চলে যাই ওদের বাসায়। ইপ্সিতার মা আমার সামনে আসেননি, আড়াল থেকেই কথা বলেছেন। সেদিন আমায় ফিরে আসতে হয় কোন কিছু না জেনে না শুনেই।
দুদিন পর অফিসে খুব ব্যস্ত, মোবাইলে অপরিচিত নম্বর থেকে কল, ‘হ্যালো আমি খুব ব্যস্ত পরে কল করছি আপনাকে’ বলেই রেখে দিই। বাসায় ফেরার পথে কল দিই সেই নম্বরে।
-হ্যালো, ইলিয়াস কেমন আছো?
-কে আপনি?
-আমি সালমা, তোমার সালমা আপু। তুমি কি আমার সাথে দেখা করতে পারবে। খুব জরুরি।
সালমা আপু আমায় কিছুই বলতে দেয়নি। রাজলক্ষ্মী মার্কেটের পাশে দেখা হবে বলে সময় জানিয়ে দেয়। আর কল করতে নিষেধ করে। পাগলের মতো যাকে আমি পথেঘাটে খুঁজেছি সে কি না আজ নিজেই...
পরদিন দেখা হয় আমাদের, সালমা আপা খুব পর্দা করেন। উনাকে প্রায় আমি বাসে উঠতে দেখেছি, কিন্তু মুখ ঢাকা ছিলো বলে চিনতে পারিনি। উনিও আমায় দেখেননি। আর আমি দেখলেও চেনার কথা নয়। কোথায় গেলো তার রূপ, কোথায় গেলো তার সেই মায়াবী চোখ। অনেক অনেক কিছু জানার কিন্তু কি আগে বলবো আর কী পরে বলবো ভেবে পাচ্ছি না। আমরা একটা নিরিবিলি জায়গায় বসি। আমার সামনেই উনি কাউকে কল করে আসতে বললেন। কয়েক মিনিটের মাঝে ইপ্সিতা এখানে উপস্থিত। আমার মুখে কোনো কথা নেই। সালমা আপার সাথে ইপ্সিতার সম্পর্ক কী?
সালমা আপা বলতে লাগলেন,
-ইলিয়াস, ইপ্সিতা তোমার বংশধর। তোমার ভাইয়ার একমাত্র স্মৃতি। কুমারী হয়েও সন্তান আমার গর্ভে, সমাজ আমাকে ধিক্কার দিয়েছে। মরতে বলেছে, ততদিনে তোমার ভাইয়া পৃথিবীতে নেই। আমি পারিনি ওকে শেষ করতে। আজ ২৭ বছর ওকে নিয়ে আমি আছি, আর পারছি না। তুমি দেখে-শুনে একটা বিয়ে দিও। আমার সময় আর নেই, হয়তো এই জন্যেই বেঁচে ছিলাম এতোদিন। তোমার মায়ের নাম খাদিজা শুনেছি বলেই ওর নাম এটা রেখেছি।
কথাগুলো বলতে বলতে সালমা আপা চোখ বন্ধ করেন। কিছুই বুঝার আগেই...
দ্রুত উনাকে ধরে গাড়িতে তুলি। হাসপাতাল নিয়ে যাই, পুরো পথে সালমা আপা এক হাতে আমায় আরেক হাতে ইপ্সিতাকে ধরে রেখেছিলো। হাসপাতাল যেতে যেতেই তিনিও না-ফেরার দেশে চলে যান। মৃত সালমা আপার হাত আমার হাতে, এই হাত ধরে ভাইয়া বাঁচতে চেয়েছিলো। আজ হয়তো সালমা আপা আমার হাত ধরে বাঁচতে চেয়েছিলো। কোথায় নিয়ে যাবো আমি সালমা আপার দেহ। গন্তব্যহীন এই যাত্রার শেষ কোথায়?
* পাঠক ফোরাম বিভাগে লেখা পাঠানোর ই-মেইল : [email protected]