প্রকাশ : ৩০ জুলাই ২০২২, ০০:০০
কাকতালীয়ভাবে মেয়েটির সাথে লঞ্চে দেখা হয়ে গেলো! সাথে সাথে সিগারেটটা ফেলে দিলাম। এ দেখে তার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো।
অতঃপর কী যেনো একটা বললো নরম ঠোঁটে। ইঞ্জিনের কাছে থাকার কারণে শুনতে পেলাম না।
আমি দাঁড়িয়ে আছি হতভম্বের মতো। মেয়েটি বিষয়টি বুঝতে পেরে আমাকে অবাক করে উপরের দিকে ইশারা করলো। আমি দোতলায় নয়, ছাদেই বুঝলাম।
অতঃপর সে মৃদু হাসতে হাসতে একপ্রকার দৌড়েই চলে গেলো। আমি সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে সেই সকালের দৃশ্যে চলে গেলাম।
আমি ট্রেনে বসে আছি। জানালার পাশে সিট। মই ব্যবহার করে অনেকেই ছাদে উঠার প্রতিযোগিতা করছে। বিশ্রী দেখা গেলেও বিষয়টা ভালো লাগার। নাড়ির টান, পিছুটান অথবা প্রিয়জনের সাথে ঈদের আনন্দের অনুভূতি তারাই কেবল বুঝে।
হঠাৎ লক্ষ্য করলাম একটি মেয়ে এসে সীটে কাছে দাঁড়িয়ে আছে। একটা শ্যামলা মেয়ে যে এতোটা সুন্দর হতে পারে এই মেয়েকে না দেখলে বুঝতে পারতাম না। আমি পলকহীন তার দিকে তাকিয়ে আছি। আর তার সৌন্দর্যের উৎস নিঁখুতভাবে অনুসন্ধান শুরু করতে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ পেছনে থেকে অবিকল তার চেহারার মতো মধ্যবয়সী নারী এসে বললো, কী ব্যাপার? সিটে বসো না কেনো?
সে বাচ্চাদের মতো আনাড়ি করে বললো, ভাবী আমি জানালার পাশে ছাড়া বসতে পারবো না। আমি জানালার পাশেই বসবো। তুমি একটু ম্যানেজ করো না প্লিজ।
বাপরে কী আবদার! এ কথা শুনে ভাবি অসহায় দৃষ্টি দিয়ে আমার দিকে তাকালেন। আমি মেয়েটির দিকে তাকালাম। দেখি সুন্দর আকাশে মেঘ জমতে শুরু করছে। এ দেখে আমি জানালার পাশের সিট ছেড়ে সামনের সিটে এসে বসলাম।
সে খুশিতে আত্মহারা হয়ে আমার পূর্বের সিটে বসে গেলো। এখানে ঠিকই তার বান্ধবী থাকলে এক হলে তাকে আলিঙ্গন করতো। নয়তো একটা চিৎকার দিতো। ভাবী আর আমি এ দৃশ্যে দেখে চোখাচোখি হওয়ার কারণে মৃদু হাসলাম। ট্রেন ছেড়ে দিলো।
মেয়েটি বাইরের অপূর্ব প্রকৃতি দেখছে। আর আমি তাকে দেখছি। বাতাসে তার কপালের চুলের এক অংশ উড়ছে। সে কতক্ষণ পর পর তার কানে আটকে রাখার চেষ্টা করছে। প্রায় ঘণ্টাখানেক পরে নজর পড়লো তার চোখের কোণে কাজলের দিকে। এতোক্ষণ পর তার আসল সৌন্দর্যের কাহিনি বুঝলাম। কারণ শ্যামলা মেয়েরা সাজলেই মাধূর্যমতি। আর তাদের কাজল সৌন্দর্যের মূল উপকরণ।
দুজন দুজনকে বহুবার আড় চোখে দেখছি। মাঝে মধ্যে একটু চোখাচোখি হয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ মেয়েটির সঙ্গে ভালো করে চোখাচোখি হয়ে গেলো। দুজনেরই অপলক চাহনী। যেনো চোখ সরালেই হেরে গেলাম। এক পর্যায়ে ভাবী তার কানের কাছে গিয়ে বলল, কে কাকে কতক্ষণ মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখতে পারে। সেই প্রতিযোগিতা হচ্ছে তাহলে...। ভাবীর এমন রসিকতায় সে ভারী লজ্জ্বা পেলো। লজ্জ্বায় একেবারে লাল হয়ে উঠলো।
সে আবার বাইরে থাকিয়ে রইলো। এভাবে অনেকক্ষণ কেটে গেলো। এক সময় জানালার কাছে মাথা হেলান দিয়ে গুনগুনিয়ে মধুর সুরে গাইতে লাগলো, ‘দূর হতে আমি তাকে সাধিব/গোপনে বাহুডোরে তাকে বাঁধিব’। পাশের দুই সিটে থাকা মানুষ পর্যন্ত মন্রমুগ্ধের মতো শোনার চেষ্টা করছে। ভারী মিষ্টি গলা তার। আমার প্রেম প্রেম ভাব উপক্রম শুরু হলো। আমিও পাল্লা দিয়ে টান দিলাম, ‘বলো কি করিলে পাইবো তোমারে, রাখিব আঁখিতে আঁখিতে’। সে আমাকে অবাক করে, ‘ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে ও বন্ধু আমার’ গানে টান দিলো। আমিও ছাড়ার পাত্র নয়। বলতে লাগলাম ‘তোমার ইচ্ছেগুলো ইচ্ছে হলে আমায় বলতে পারো, আমার ভালো লাগা, ভালোবাসা তোমায় দিবো আরো। তুমি হাতটি শুধু ধরো, আমি হবো না আর কারো’।
গান শেষ হওয়ার আগেই ট্রেন এসে থামলো একটা জায়গা। অন্য ট্রেন আসছে এই লাইন দিয়ে । আমরা যে লাইন দিয়ে ঢাকা যাবো। ঢাকা থেকে এটার ময়মনসিংহের আগে। উঠেছিলাম আমরা জামালপুর জংশন থেকে। আধ ঘণ্টার মতো বিরতি। নেমে গেলেন দুজনেই। একটা বিরহ বিরহ ভাব অনুভব করলাম।
দুদিন ঘুমোতে পারিনি। প্রায় আধ ঘণ্টার বিরতিতে একা একা থাকতে থাকতে কখন ঘুমিয়ে গেলাম বুঝতে পারলাম না। অবশ্য ঘুমে থাকলেও সে এসে যে গান বলা শুরু করছিলো সেটা শুনতে পেয়েছিলাম। ‘তুমি দাঁড়িয়ে আছো মোর গানের ওপারে’সহ রবীন্দ্রনাথের সব কালজয়ী গান অবিরত গেয়ে যাচ্ছিলো।
একসময় আমি গভীর ঘুমের দেশে তলিয়ে গেলাম। হঠাৎ সে আমাকে চিমটি খেলো। আমি লাফ দিয়ে উঠলাম। উঠে দেখি সে চলে যাচ্ছে! বাইরে তাকিয়ে দেখি কমলাপুর রেলস্টেশন চলে এসেছি। দৌড়ে পেছনে পেছনে গেলাম। কিন্তু কিছু বলার সাহস পারছিলাম না।
-মহাশয় ছাদে উঠতে এতোক্ষণ লাগে আপনার? কী ভাবতে ভাবতে আসছিলেন... আমাকে কি বলা যায়?
-জ্বি। আমাদের ট্রেনের কথাই ভাবছিলাম। এভাবে দেখা হবে ভাবিনি।
-সবই তকদীর জনাব। তো যাচ্ছেন কোথায়?
-বরিশাল দেশের বাড়ি। আপনি?
-বোনের বাড়ি। যদিও দুই তিনদিন থাকবো। মূল উদ্দেশ্য সবাই মিলে পদ্মাসেতু দেখতে যাবো।
-ও তাই! আমিও তো সেখানেই দুই-একদিনের মধ্যে যাবো ভাবছি। ভালোই হলো।
-জ্বি
-আমরা কি একই দিনে একসাথে যেতে পারি বা সেখানে গিয়ে দেখা করতে পারি?
-অবশ্যই। কেনো নয়?
* পাঠক ফোরামে লেখা পাঠানোর ই-মেইল : [email protected]