প্রকাশ : ২৩ জুলাই ২০২২, ০০:০০
ঝিরঝিরে বৃষ্টির মাঝে বাসটি হৃদয়পুর স্টেশন থেকে শহরের উদ্দেশ্য রওনা হলো। ধীরে ধীরে চলার পথে থেমে থেমে যাত্রী তুলছে বাসের হেলপার। বৃষ্টির জন্যে সকলেই গাড়ির জানালা বন্ধ করে রেখেছে। বাইরের প্রকৃতি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। তবুও অধীর আগ্রহে জানালার বাইরে কাউকে খুঁজে বেড়াচ্ছে বাদলের দু চোখ। পাঁচ মিনিটের জন্যে যেখানেই গাড়ি থামছে সেখানে নেমে খুঁজে ফিরে এসে বসেছে।
গাড়িটি সাহাপুর স্টেশনে আসতেই বৃষ্টি বাড়তে শুরু করলো। দোকানের ছাউনি থেকে মেয়েটি দৌড়ে এসে বাসে উঠলো। কেবল যুবকের পাশের সিট খালি বলে সেখানেই বসে পড়লো। জানালা খোলা বলে বাতাসের সাথে পানি এসে ভিজে যাচ্ছিলো মেয়েটার পোশাক। হেলপার বাদলকে জানালা বন্ধ করতে বললো। বাদল দেখলো এক নারী তার পাশের সিটে বসা। চোখ ছাড়া পুরো শরীর বোরকায় ঢাকা। নিচের দিকে তাকিয়ে রুমাল দিয়ে বোরকা মুছে যাচ্ছে।
বাদল বললো, আপনার বোরকা ভিজে গেছে, জানালা খুলে রাখার জন্যে দুঃখিত।
কণ্ঠস্বর শুনে পাশে তাকিয়ে বাদলকে দেখে অবাক হলো ধারা। এলোমেলো চুল, চোখের নিচে কালো দাগ, বিধ্বস্ত চেহারা। এমন দেখাচ্ছে কেনো ওকে, বাইরে তাকিয়ে হন্যে হয়ে কাকে খুঁজছে?
হঠাৎ করে গাড়ি ব্রেক করাতে, পড়তে গিয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাদলের শার্ট খামচে ধরলো ধারা। বাদল ফিরে তাকাতে শার্ট ছিড়ে দুঃখিত বললো সে।
এই চোখের চাহনি, কণ্ঠস্বর, কথা বলার ভঙ্গি সব কিছু বাদলের কাছে খুব পরিচিত মনে হলো। বাইরে তাকিয়েই বললো, যদি কিছু মনে না করেন, আপনার নামণ্ডঠিকানা জানতে পারি?
কী বলবে বুঝতে পারলো না ধারা। মিথ্যা বলবে কী করে? বাদলকে কথা দিয়েছিল কোনো দিন মিথ্যা কথা বলবে না। তবুও নিজেকে লুকিয়ে রেখে এক নিঃশ্বাসে বললো, আমার নাম পাখি। হৃদয়পুর কলেজে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। এখানে বান্ধবীর বাড়িতে এসেছি।
জানালার বাইরে তাকিয়ে বাদল বিড়বিড় করে বললো, ধারাও অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়ে। কিন্তু কোথায় পড়ে, কোন্ বিষয় পড়ে কিছুই জানি না আমি। তুমি কোথায় গেলে আমার জীবন থেকে ধারা, একটিবার ফিরে এসো না! বিড়বিড় করে অনবরত বিণœ মনে বলতে থাকলো বাদল।
চার বছর আগে যেই মানুষটি ছিলো ধারার নিঃশ্বাস। একদিন কথা বলতে না পারলে দম বন্ধ হয়ে আসতো, ভালোবাসার সেই মানুষটিকে এতো বছর পর পাশে দেখেও লুকিয়ে রাখতে হচ্ছে নিজেকে।
কতো সুখের ছিলো সেই দিনগুলো। প্রতিদিন কলেজ থেকে বাড়ি ফেরার পথে দোকান থেকে ফোন করা। সারাদিন কলেজে কী কী হয়েছে, সব তাকে বলা, তার উপদেশ শোনা, ‘ধারা তুমি এখনো ছোট, মন দিয়ে লেখাপড়া করবে, কোনো ছেলের সাথে কথা বলবে না। ঠিক মতো খাওয়া-দাওয়া করবে, সঠিক সময়ে ঘুমাবে’। সেই আনন্দের সময়ে হঠাৎ করে তার দেয়া আঘাত, আজও বেদনার সাগরে ভাসায় ধারাকে। নিজেকে লুকিয়ে রেখে পরিবারের থেকে দূরে এসে প্রিয়জনের কথা রাখতে এখানে পড়াশোনা করছে সে।
বাদল বিবাহিত। তাহলে সে আজও কেনো আমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে? এই রহস্য জানার জন্যে ধারা বললো,
আপনার নাম, ঠিকানা তো বললেন না?
আমার নাম বাদল। পেশায় কলেজ শিক্ষক এবং ব্যবসায়ী। শহরেই আমার বাড়ি।
আর একটু আগে যে ধারা নামের কারো কথা বিড়বিড় করলেন সে আপনার কে হয়, সে আপনার জীবনের নেই কেনো তার সম্পর্কে জানতে পারি?
ধারা আমার শ্বাস-প্রশ্বাস, জীবন, অস্তিত্ব, সবকিছু। সেই চঞ্চল মেয়েটিকে যেদিন আমার জীবন থেকে হারিয়ে ফেলেছি, সেদিন থেকে আমি ঠিকমতো শ্বাস নিতে পারিনি। অল্প কিছু দিনের জন্যে সে আমার জীবনে এসেছিলো। অপরিচিত কোনো মেয়ের সাথে এই প্রথম বাদল নিজের জীবন কাহিনি সংকোচহীনভাবে বলতে শুরু করলো।
সেদিন ছিলো শ্রাবণ মাসের সপ্তম দিন। সকালে জ্বলমলে রোদ উঠেছে। মাস্টার্স শেষ করে সখের বসে সেদিন আমি বাবার হাসপাতালে অভ্যর্থনায় যোগ দিয়েছি। হঠাৎ প্রবলবেগে বৃষ্টি শুরু হলো। খানিকটা ভিজে ধারা ওর বাবার সাথে চিকিৎসক দেখাতে এলো আমাদের হাসপাতালে। কেউ ভিজে এসেছে বলে আমি চেয়ার ছেড়ে সামনে এগোলাম। ধারার বাবা রিকশার ভাড়া মেটাচ্ছিলো। জুতায় পানি লেগে পিছলে নিতে ধারা আমার হাতটি ধরে নিলো। সেই অসুস্থ কিশোরী মেয়েটির কোমল হাত, মায়াবী চোখ, মুখ আমার কঠিন হৃদয়কে পরম ভালোবাসায় কোমল করে দিলো। ওকে ফ্রেশ হতে পাঠিয়ে ওর বাবার কাছ থেকে নাম, ঠিকানা, ফোন নাম্বার এন্ট্রি করে নিলাম। জানতে পারি, ঠিক মতো খাওয়া-দাওয়া না করার কারণে গ্যাসের সমস্যা হয়েছে ওর। আমার সামনাসামনি চেয়ারে বসেছিল ধারা। বারবার আমার চোখ ওর চোখে পড়ছিলো। চোখ ফেরানোর কোনো সাধ্য ছিলো না আমার। ধারার বাবা নামাজে গেলে আমি ওর সাথে বসে খানিকক্ষণ কথা বলে ওর সম্পর্কে অনেক কিছু জেনে নিয়েছি। চিকিৎসক দেখিয়ে যেতে যেতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো ওদের। ওর বাবা ঔষধ নিতে গেলে, আমি ওর কাছে যেতেই বললো-
পরের সপ্তাহে চিকিৎসক আমায় আসতে বলেছে, আমি আবার আসবো। আমি ইচ্ছা করেই আমার ফোন নাম্বার ওর হাতে দিয়ে দিলাম।
পাঁচ দিন পর ধারা আমায় ফোন করলো। আমি ওর ফোনের অপেক্ষায় ছিলাম। জানালো বাইশ তারিখ আসছে। আমার অপেক্ষার তর সইলো না। ওই নম্বরে ফোন করে জানতে পারলাম, কলেজের পাশের দোকানে থেকে ফোন করেছে ও।
দুদিন পর ধারা এলো ওর মায়ের সাথে। আজ ওকে অনেক সুন্দর, চঞ্চল আর প্রাণবন্ত লাগছে। নিজে এসেই আমার সাথে কথা বলেছে। আমি ইচ্ছা করেই ওর সিরিয়াল নম্বর পেছনে দিয়েছি, যাতে আরো কিছুক্ষণ আমার সামনে থাকে। যতোবারই চেয়েছি, ধারার চোখ আমার চোখেই ছিলো। চিকিৎসক দেখিয়ে যাওয়ার সময় ও আমার কাছে আসলো। আমি বললাম, তোমাকে কি আর চিকিৎসকের কাছে আসতে হবে না?
চিকিৎক বলেছে, আমার সমস্যা ঠিক হয়ে গেছে। তারপরও এক মাস পর দেখিয়ে নিতে বলেছে। বাবা নিয়ে এলেই আমি আসবো। যাবার আগে বারবার ও পেছনে ফিরে চেয়েছিলো।
পরের একমাস প্রায় প্রতিদিনই ধারা ওর কলেজ ছুটির পর দোকানের নম্বর থেকে আমায় ফোন করতো। ওর বন্ধুদের সাথে কাটানো দুষ্টু, মিষ্টি বাচ্চা সুলভ কথা আমাকে আরো বেশি ওর প্রতি দুর্বল করে তুলেছিলো। প্রায়ই আমার চাকরি নিয়ে বলতো, আমি কেনো এই চাকরিটা করছি। আমি ওকে হেসে বলতাম, এই চাকরিটা না করলে তোমার মতো দুষ্টু মেয়েটির সাথে পরিচয়ই হতো না। ও রেগে বলতো, দুষ্টু তো আপনি, যতোবার হাসপাতালে গিয়েছি, আমার থেকে নজর সরাননি।
আমি হেসে বলতাম, তুমি নজর দিয়েছো বলেই তা দেখতে পেয়েছো।
এভাবেই আমাদের সম্পর্কটা এগোতে থাকলো। একমাস পর ধারা হাসপাতালে এলো। আমি আগেই ভেবে রেখেছিলাম, আজ ধারাকে আমার মনের কথা বলবো। ডাক্তার দেখানোর পর, বাবার ম্যানেজিং রুমে ডেকে ওর হাতে একগুচ্ছ লাল গোলাপ দিয়ে বলেছিলাম, ‘শুধু তোমার জন্যে’। ওর চোখে চেয়ে সব ভুলে গিয়েছি, আর কিছুই বলতে পারিনি। ‘ভালোবাসি’ লেখা একটি রুমাল উপহার দিয়েছিলো সেদিন ধারা আমায়।
তারপর থেকে কখনো কখনো ধারা আমাকে দিনে দুবার করে ফোন করতো। বারবার ওর সাথে দেখা করতে বলতো। আমি আমার বন্ধু সজিবকে নিয়ে ওর সাথে দেখা করতে গেলাম। ক্লাস শেষে ওর বান্ধবীসহ আমরা মেঘনা নদীর পাড়ে হেঁটেছি। ধারার দুষ্টু, মিষ্টি আচরণ বারবার আমায় মুগ্ধ করতো। সেদিন ধারা আমায় বলেছে, ওর পছন্দ, ওর বর একজন শিক্ষক হবে। আমি যেনো আমার পেশাটি বদল করে নিই। আমি ওর হাত ছুঁয়ে কথা দিয়েছিলাম।
এরপর ধারা আমাকে খুব বেশি ফোনো করতো। রাতে পড়াশোনার মাঝে ওর বাবার ফোন থেকে। সামনে ওর এইচএসসি পরীক্ষা। আমি ওকে অনেক বুঝিয়েছিলাম এখন বেশি ফোন করার দরকার নেই। এখন লেখাপড়ায় মনোযোগ দেয়া বেশি দরকার। ও কথা শুনেনি। জানতে পারলাম, টেস্ট পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করেনি। তাই আমি ওর সাথে রাগ করে কথা বলিনি।
সেদিন বাসায় বাবা তার বন্ধুর মেয়ের সাথে আমার বিয়ের কথা বললো। আমার মেজাজ পুরোই খারাপ হয়ে গেলো। এতো বছর কাউকে মনে ধরেনি, যখন কাউকে পছন্দ হলো, তখন তার কথা পরিবারে বলতে সংকোচ বোধ হলো। একদিকে ধারার বয়স কম, দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্রী, অন্যদিকে ওর বাবা এখানকার অস্থায়ী বলে আমি আমার প্রথম পছন্দের কথা বাবাকে বলতে পারিনি। ঠিক তখনই ধারা ফোন করলো। ভাবলাম, ধারার ফোন কমানোর একটা উপায় পেয়ে গেছি।
ছট করে বললাম, পড়াশোনায় মনোযোগ দাও। আমায় বেশি ফোন করার দরকার নেই। প্রয়োজনে আমি ফোন করে নেবো। তাছাড়া গতকাল বাবা জোর করে তার বন্ধুর মেয়ের সাথে আমার বিয়ে দিয়ে দেন। কিন্তু আমি তোমাকেই ভালোবাসি। এই বিয়ে ভাঙার সব ব্যবস্থা করবো আমি। তুমি শুধু লেখাপড়া মনোযোগ দিয়ে করে, ভালো ফলাফল করো।
আমি কখনো ভাবিনি, সেই চঞ্চল মেয়েটি এতো সহজে সব কিছু মেনে নেবে। পাল্টা কোনো প্রশ্ন করেনি। দুদিন ধরে ধারা আমাকে ফোন করেনি। ওর নিজের ফোন ছিলো না বলে আমি ফোন করতে পারিনি। ওর বাবার নম্বরে ফোন দিয়ে বন্ধ পেলাম। দোকানের নম্বরে ফোন করে জানতে পারলাম ও নিয়মিত কলেজে আসছে। ওর ফাইনাল পরীক্ষা হয়ে গেলো। আমার মন আনচান করতো ওর সাথে কথা বলার জন্যে, দেখা করার জন্যে। এদিকে আমার কলেজ চাকরিটা হয়ে গেছে। ধারার কলেজের দোকানে ফোন করে জানতে পারলাম, ধারা এদিকে এখন আর আসে না। তবুও আমি অনুরোধ করে বলেছি, কখনো এলে যেনো আমায় একবার ফোন করতে বলে। ওর বাবার নম্বর বারবার বন্ধ পেতাম। দোকানে ফোন করে জানতে পারলাম ওর বাবার চাকরি বদল করে খুলনা চলে গেছে ওদের পরিবার।
আর খুঁজে পাইনি ধারাকে। ওর ভালো ফলাফলের জন্যে আমার সেদিনের সাজানো মিথ্যার জন্যে হারালাম ওকে। ওর কলেজ থেকে জানতে পারলাম এ প্লাস পেয়ে পাস করেছে। ও আমার কথা রেখেছে। আমায় বলেছে, ওর বাবার চাকরি যেখানেই বদল হোক, ও হৃদয়পুরে থেকে পড়াশোনা করবে। এখানে ওর বেড়ে উঠা, বন্ধু-বান্ধব, নদী, জল, মাটি, মানুষের ভালোবাসা রেখে অন্য কোথাও গিয়ে থাকতে পারবে না ও।
আমার বিশ্বাস, ধারা এখানে কোথাও আছে। সেই থেকে আমি ওকে খুঁজে ফিরছি।
জানালার বাইরে থেকে বাদল দৃষ্টি ফিরিয়ে দেখলো পাখি চোখের পানি মুছছে। এ কি আপনি কাঁদছেন কেনো?
-না, আসলে বৃষ্টির পানি এসে চোখে লেগেছে, কাঁদছি না।
আপনার চোখ, কণ্ঠস্বর, আচরণ অনেকটাই ধারার মতো মনে হচ্ছে। সেই জন্যেই নিজের জীবনের গল্প আপনাকে বলে ফেললাম। আচ্ছা, আপনি কোথায় থাকেন জানতে পারি?
ধারা একটি কাগজে বাসার ঠিকানা লিখে বাদলের হাতে দিলো।
এটা তো আমার বন্ধু সজিবের বাড়ির ঠিকানা। যদিও আপনি ওকে দেখেননি। কারণ, গত তিন বছর ধরে ও বিদেশে থাকছে। তবে আগামী পরশু দেশে আসবে। ওদের বাড়ি গেলে আপনার সাথে দেখা হবে।
ততোক্ষণে বাস নির্দিষ্ট স্থানে এসে থামলো। ধারা ‘হয়তো বলে বাস থেকে নেমে বাদলের কাছ থেকে আলাদা হয়ে গেলো।
বাসায় ফিরে চিন্তায় পড়ে গেলো ধারা। তবে সেদিন, বাদল মিথ্যা বলছিলো? এই মিথ্যেটা ছাড়া তো অন্য কিছু বলতে পারতো সে। তাহলেই দুজন তিন বছর ধরে এতো কষ্ট পেতাম না। আমি কি বাদলের কাছে ফিরে যাবো?
না, না আমি তো ওকে মিথ্যে পরিচয় দিয়েছি। একটি মিথ্যার জন্যে তিনটি বছর আমাদের সম্পর্ক ছিলো না। এই মিথ্যের জন্যে যদি বাদল আমায় ভুল বুঝে? তাছাড়া তিন বছর পর আমার মধ্যে অনেক পরিবর্তন এসেছে, বাদল যদি আমায় চিনতে না পারে? ভাবতে পারছে না ধারা। বাদলের দেয়া আঘাত নিয়ে বেদনায় তিনটি বছর কেটেছে তার। একা একা সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে সে।
সজিব দেশে ফিরলে, বাদল ওদের বাসায় গিয়ে দেখা করে, পাখির সাথে পরিচয়ের কথা বললো। ধারাকে আজও খুঁজে ফিরছে, সে কথাও বললো।
ধারা ভুল করে মুখ না ঢেকে জানালা কিছুটা খোলা রেখে নিজের সব কথা ডায়েরিতে লিখছিলো। সেই সময় সজিব জানালার পাশে দিয়ে যাওয়ার সময় ধারাকে দেখে ফেললো। কেউ জানালার পাশে ছিল ভেবে, ধারা তাড়াতাড়ি মুখে পর্দা করে নিলো। এই তিন বছর সে কারো সাথে দেখা দেয়নি। এই পরিস্থিতিতে চিন্তিত হলো ধারা। কে ছিলো জানালায়? অস্থিরতা কমাতে ছাদে চলে এলো সে। হয়তো দরজা লক না করেই।
সজিব সবটা লক্ষ্য করে ধারার রুমে গিয়ে ওর ডায়েরি পড়ে পুরো বিষয়টি বুঝতে পারলো। ওদের সম্পর্কটা ঠিক করার জন্যে বাদলকে ডেকে নিলো।
-তোকে বলতে হবে, তুই পাখিকে ভালোবাসিস।
-অসম্ভব। এসব কী বলছিস্ তুই! আমি শুধু ধারাকে ভালোবাসি। তুই সব জানিস। তাছাড়া পাখি, ধারার সম্পর্কে সব জানে।
-তবুও তোকে বলতে হবে।
-আমি কিছুতেই বলতে পারবো না।
-ঠিক আছে, বলতে হবে না তোকে। এক কাজ কর, ইতালি থেকে আমি এক বিশেষ পানীয় এনেছি, তুই আর আমি একসাথে খাবো বলে।
নিজে এক গ্লাস খেয়ে কোনো প্রশ্ন করতে না দিয়ে বাদলেকে একগ্লাস খাইয়ে দিলো সজিব।
বাইরে প্রচণ্ড ঝড় উঠেছে। ধারা ছাদ থেকে বাসায় ফিরে এলো। বাদল এলোমেলো কথায়, হেলেদুলে পাখির দরজায় নক করলো। দরজা খুলতেই বাদল দরজা লাগিয়ে দিয়ে বেঘোরে বললো, খুব ভালোবাসি তোমায়, বিশ্বাস করো, আর কোনদিন মিথ্যা বলে কষ্ট দেবো না তোমায়।
-আপনি আমার রুমে কী করছেন। এক্ষুণি বের হয়ে যান।
-কেনো কষ্ট দিচ্ছ আমায়, যাবো না আমি, ক্ষমা করে দাও না আমায়।
-বের হয়ে যান বলছি। না হলে কিন্তু আমি...
রেগে কথা বলতে গিয়ে ধারার মুখের ওড়না সরে গেলো।
বাদল ধারাকে দেখে হেসে বললো, তুমি আগের থেকে অনেক পাল্টে গেছো ধারা। আমার কল্পনায় থেকেও বেশি। খুব ভালোবাসি তোমায়।
চুপ করো তুমি। আর কতো মিথ্যে বলবে। এতোক্ষণ তো পাখিকে ভালোবাসার কথা শুনিয়েছিলে। এখন আবার মিথ্যা বলছো? সেদিন বাসে মিথ্যা পরিচয় না দিলে, চিনতেই পারতাম না তোমার আসল চেহারাটা। আসলে আমার নাম করে অন্য মেয়েদের ঠকাচ্ছো তুমি। তুমি আসলেই মিথ্যাবাদী, ঠক। বের হয়ে যাও এখান থেকে।
ধারা...আমি...বলেই বাদল বিছানায় ঢলে পড়লো, আর ধারার নাম ধরে বিড়বিড় করতে থাকলো।
ধারা বুঝতে পারলো, বাদল নেশার ঘোরে আছে। বাদলের চোখে-মুখে পানি ছিটিয়ে ভাবলো, কেন বাদল এতো বছর পর আবার আমার সাথে এসব করছে। ঝড়ের সময় কেউ এসব দেখলেই কী ভাববে। খুব তাড়াতাড়ি বাদলকে বসিয়ে, লেবুর পানি খাইয়ে দিলো।
যাকে দেখার জন্যে, কথা বলার জন্যে পাগল হয়ে যেতো ধারা, যে ছিলো তার জীবনে দেখা পুরুষদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ আর সুদর্শন, সেই মানুষটিকে এতো কাছে পেয়েও কেমন অচেনা মনে হচ্ছে। বাদলের অজ্ঞান মুখের দিকে তাকিয়ে সব রাগ ভুলে গেলো ধারা। বাদলের দু গালে হাত রেখে কেঁদে বললো, তোমার কোন কথাটি বিশ্বাস করবো বলো, কেন এতো ধোয়াশায় রেখেছো আমাকে?
জানালায় দাঁড়িয়ে সজিব ধারাকে সব খুলে বললো। ধারা অনবরত কেঁদে যাচ্ছে। আবারো সে বাদলকে ভুল বুঝলো। এখন কি করে বাদলের সামনে দাঁড়াবে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাদলের জ্ঞান ফিরে এলো। একটু আগের সব ঘটনা ওর মনে পড়লো। পাশেই ধারা কাঁদছে। বাদল ধারার দুহাত ধরে বললো, আমায় ক্ষমা করোনি ধারা? আসলে সজিব আমাকে...
আমি সব জেনে গেছি, বাদলকে থামিয়ে ধারা বলল। ধারার দু গালের পানি মুছে দিয়ে বাদল বললো, আমার সেই দুষ্টু কিশোরী হরিণিটি আজ খুব সুন্দর যুবতীতে রূপ নিয়েছে। তাকে পেতে আজ আর কোন সংকোচই রইলো না। ধারা বাদলের বুকে মিশে অবিরাম ধারায় কাঁদলো। বাদল ভেজা চোখ মুছে ধারার চিবুক ছুঁয়ে আচমকা হাসলো, ধারাও হাসলো। অঝোর ধারায় বৃষ্টির পর শেষ বিকেলের এক চিলতে রোদের ঝিলিক জানালার ফাঁকে এসে পড়লো দুজনের চোখে-মুখে।