প্রকাশ : ১৮ জুলাই ২০২২, ০০:০০
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
ছয়.
থানার ওসি কোনো মতেই নুপুরের লাশ ময়নাতদন্ত ছাড়া পরিবারের কাছে হস্তান্তর করবে না। হিন্দু মানুষ একপ্রকার ভিতু বলা চলে। নিজেদের সংখ্যালঘু ভাবে। কিন্তু সংখ্যালঘু বলে যে সংকীর্ণতা তাদের মনে কাজ করে তা তাদেরকেই কাটিয়ে উঠতে হবে। সমাজ থেকে এ শব্দের ব্যবহারই বাদ দেয়া উচিৎ। হিন্দু হলেই সবকিছুতে ছাড় দিতে হবে কেনো? অবশ্য নুপুরের বাবা অনিল বাবু ভাবছে, কী দরকার মামলায় যাওয়া। এখনকার সময়ে বিচার পাওয়া অনেক সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তারপর পুলিশ আর আদালতপাড়ায় দৌড়াতে দৌড়াতেই জান কবজ হয়ে যাবার উপক্রম হবে। অবশ্য এটি শুধু অনিল বাবুর ভাবনা নয়, গ্রামের মানুষ বুঝাচ্ছে। ময়নাতদন্ত হলে লাশ কাটা-ছেঁড়া করবে। কইলজা, গুদ্দা নাড়িভুঁড়ি সব রেখে দেবে। ভিসেরা রিপোর্টের জন্যে এগুলো চট্টগ্রাম পাঠাবে। আরো কতো ঝামেলা। পুলিশ রিপোর্ট ও ডাক্তার রিপোর্ট। তারপর আবার লাশকাটা ঘরে ডোমের রূঢ় আচরণ। সব মেনে নিয়েই একটা বিচার শেষ পর্যন্ত এসে গড়ায়। এখন আর মানুষ এতো ঝামেলায় যেতে চায় না। কতো ভাবেইতো মানুষ মরে। মহামারি, রোড এক্সিডেন্ট, পানিতে ডুবে, ক্যান্সার, স্ট্রোক। এখন তো পৃথিবীব্যাপী করোনা। করোনায় দেশে শ শ মানুষ মরছে। করোনাকে বাদ দিলেও মানুষ মরার আরো কতো কতো কারণ আছে। ইচ্ছে করলেই মানুষ বেঁচে থাকতে পারে না। জীবন-মৃত্যু প্রকৃতির অমোঘ নিয়ম। মেনে নিতে হয়। মেনে নিয়েছে আমাদের পূর্বসূরিরাও।
না হয় মেয়ে মরেই গেছে। বরং লাশ পুলিশের কাছ থেকে নিয়ে সৎকার করে ফেললেই সব ঝামেলা শেষ। শুভ ওসির সাথে কথা বলতে চায়। কিন্তু কে শুনে কার কথা। ওসিও চায় লাশ পোস্টমর্টেম হোক। শুভও চায়। কিন্তু নুপুরের পরিবার ও নিপুর পরিবারসহ বাড়ি ও এলাকার লোকজন চায় না।
এলাকার লোকজন বলে, পুলিশ শুধু ঝামেলা বাড়াতে চায়। যদি এখানে ভিন্ন কিছু পায় তো পুরো গ্রামের মানুষকে হয়রানি করবে। যদি এটি হত্যা হয় সেক্ষেত্রে যে কারো বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আনতে পারবে পুলিশ। আমি আপনি কেউ বাদ যাবো না। তারচে ভালো পুলিশকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে লাশ বাড়ি নিয়ে চলো। এবার সবাই একজোট হয়ে ওসির রুমে প্রবেশ করে। তবে রুম অনেক ছোট বিধায় সবাই জায়গা পায় না। তাই গ্রামের অনেকেই বাহিরে অপেক্ষা করে।
অনিল বাবু বলেন, স্যার যা কিছু হয়েছে আমার কোনো অভিযোগ নাই। আমার মাইয়ার লাশ দিয়া দেন। উপস্থিত সবাই সমস্বরে বলে জ্বি স্যার। দিয়া দেন। আমরা এ নিয়া কোনো ঝামেলায় যেতে চাই না।
সবার মাঝ থেকে শুধু শুভ আপত্তি দেয়। না স্যার। লাশ পোস্টমর্টেম ছাড়া দেবেন না। আপনাদের সুরতহালে কী পেয়েছেন?
- বিশেষ কিছু পাইনি। তবে তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে ধারণা করছি। যদিও শরীরের খুব বেশি আঘাতের চিহ্ন নেই। শুধু বাম হাতে একটু যখম আছে। আমরা সে কারণেই সন্দেহ করছি এটি একটি পরিকল্পিত হত্যা।
- বৈদ্য বাড়িতে আমার যাওয়া-আসা আছে। সবসময়ই আমি ওই বাড়িতে যাই সবাই আমাকে ভালো জানে। নিপু আমার বন্ধু। সে সূত্রে নুপুরের সাথে আমারও পরিচয় ছিলো। অনেক সময় কথা হয়েছে। নুপুর খুব ভালো মেয়ে। শুভর অজান্তেই চোখের কোনে জল নেমে আসে। ওসিসহ উপস্থিত সবাই অবাক হয়। ঘটনা কী?
- তুমি কাঁদছো কেনো?
- না স্যার। এমনিতেই। চোখে কী যেনো পড়েছে। আমি কাঁদতে চাইনি। আপনি কিছু মনে করবেন না। নুপুর খুব ভালো মেয়ে ছিলো। নুপুরের এভাবে চলে যাওয়া আমি মেনে নিতে পারছি না। আমি নিশ্চিত এটি একটি হত্যা এবং পরিকল্পিত হত্যা।
- তুমি কিভাবে এটা ভাবছো?
এখানে নুপুরের কোনো শত্রু নেই। তাছাড়া সে এ এলাকায় বেড়াতে এসেছে মাত্র এক সপ্তাহ হলো। এতো রাতে কারো সহযোগিতা ছাড়া সে আখড়ায় যেতে যাবার সাহস করবে না। আমি এটা বিশ্বাস করি। কাঁপাকাঁপা গলায় বলছিলো শুভ।
শুভর কথা শুনে উপস্থিত সবাই স্তব্ধ। অবশ্য এলাকার গণ্যমান্যদের একজন শ্যামল বৈদ্য। তিনি হঠাৎ ক্ষেপে গেলেন। তুমি কে? তুমি কেনো এ বিষয়ে নাক গলাচ্ছ? তাহলে তুমিই নুপুরকে রাতে এসে হত্যা করেছো। ওসি সাহেব তাকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করুন দেখবেন সব বেরিয়ে আসবে। শুভ এবার চিৎকার দিয়ে কাঁদতে শুরু করে। এমন কথা শুভর বুকের ভেতর চৌচির শুরু হয়। যেনো তুমুল ভাঙচুর।
ওসি চিন্তায় পড়ে। কী করা?
তারপরেও পুলিশ হিসেবে একটু সময় নেয়া দরকার। ততোক্ষণে সন্ধ্যা ঘনিয়েছে। লাশ পোস্টমর্টেম করবে কি করবে না কোনো সিদ্ধান্তে আসা যাচ্ছে না। অবশ্য নিপুর বাবা নারায়ণ বলেন, আরে পুলিশকে কিছু দিয়ে দিলেই লাশ দিয়ে দেবে। অযথা প্যাঁচাচ্ছেন কেনো?
শ্যামল বৈদ্যও নারায়ণ সরকারের সাথে একমত পোষণ করে। কিন্তু পুলিশ কি কারণে এতেও রাজি হচ্ছে না বলা মুশকিল। তবে ওসি শুভকে একটু ভিন্ন চোখে দেখতে শুরু করেছে।
এবার ওসি সবাইকে চলে যেতে বলেন। আমি লাশ ময়নাতদন্ত ছাড়া হস্তান্তর করবো না। এরপরেও সবাই অনেক অনুরোধ করে। কিন্তু ওসি কোনোভাবেই রাজি হচ্ছেন না।
সবাইকে বিদায় করে দিয়ে ওসি শুধু শুভকে থাকতে বললো।
থানায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো ঘটনায় মামলা হয়। কিন্তু এ ঘটনা নিয়ে যতোটা বেগ পোহাতে হয়েছে অন্য কোনো মামলায় এতোটা বেগ পেতে হয় না। অথচ এ মামলার ক্ষেত্রে কোনো রাজনৈতিক চাপ নেই। প্রভাবশালীদের মাথা ব্যথা নেই। তবুও কতোটা হেচিং। বিষয়টি খুব সাবধানে হেন্ডেলিং করতে হচ্ছে। অবশ্য পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্যে প্রতিটি ঘটনাই গুরুত্ব বহন করে। সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে দেখতে হয়। না হয় যে কোনো ঘটনার গভীরের রহস্য অপ্রকাশিত থেকে যাবে। ছাড় পেয়ে যাবে প্রকৃত অপরাধী। (চলবে)
[পরের পর্ব আগামী সংখ্যায় প্রকাশিত হবে]