প্রকাশ : ২২ মে ২০২২, ০০:০০
মাগরিবের আজানের আর অল্প কিছুক্ষণ বাকি। মরিয়ম বেগম ছুটতে ছুটতে বাড়ি আসেন। দরজায় দাঁড়িয়ে কিছুটা হাঁপাতে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মসজিদ থেকে ভেসে আসতে শুরু করে মাগরিবের আজানের সুমধুর ধ্বনি। মাথায় কাপড় দিয়ে ঘরে ঢোকেন মরিয়ম। পানি খেয়ে রোজা ভাঙেন। একমাত্র মেয়ে সালমাকে নিয়ে ইফতার করতে বসেন। ইফতারের আয়োজন বলতে কিছু খেজুর-মুড়ি আর একটা পাকা পেপের অর্ধেক।
সালমার মনটা আজ একটু বেশি খারাপ হয়ে আছে। মরিয়ম বেগম লক্ষ্য করে সালমা ঠিকমতো ইফতার করছে না। মেয়েকে আদর করে মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করে, কি হইসে মা। তুমি ইফতার করো না কেনো?
সালমা মাকে ঝাপটে ধরে। ও আম্মু, আমার এসব ভালো লাগে না। রাপি ভাইয়া, সেলিম ভাইয়া ওরা প্রতিদিন ইফতারে কত কিছু খায়। আলুর চপ, পেঁয়াজু, জুস, হালিম। আম্মু আমার হালিম খাইতে খুব ইচ্ছে করে।
মরিয়ম বেগম উদাস কণ্ঠে বলেন, কিন্তু মা হালিম রান্না করতে তো অনেক কিছু লাগে। চাল-ডাল-মসলা। আর সবচেয়ে বড় কথা গোশত। গোশতের যা দাম। তুমি তো জানো মা, আমাদের যে গোশত কিনার টাকা নেই।
সালমা আর কিছু বলতে পারে না। মুখ কালো করে মায়ের কোল ছেড়ে বাইরে চলে যায়। মরিয়ম বেগম উঠে নামাজ পড়তে চলে যান। রাতে মেয়ের কাছে আসতেই মেয়ে আবার আবদার করে। মরিয়ম বেগম ভাবেন রোজার আর অল্প কয়দিন আছে। মালিক এখন ওভারটাইম করায় ঈদের আগে। কিছু বোনাস নিশ্চয়ই দিবে ঈদের। কাল তো সবার বেতন দেয়ার কথা। মরিয়ম মেয়েকে আশ্বাস দেন।
আম্মু তোমার জন্যে কালকেই একটা নতুন জামা আর তোমার পছন্দের খাবার নিয়া আসমু ইফতারে। সালমা খুশিতে মাকে জড়িয়ে ধরে। অনেক রাতে সালমা ঘুমিয়ে গেলেও মরিয়মের ঘুম আসে না। স্বামী মারা যাওয়ার পর অভাবের তাড়নায় গার্মেন্টসে কাজ নেয়। সালমাকে নিয়ে আশ্রয় নেয় এ বস্তিতে। মেয়েটার জন্যে যে করেই হোক একটা জামা কাল আনবেই।
পরের দিন দুপুরে পাশের মাঠটায় যায় সালমা। কলোনীর মাঠে আশপাশের বাসা-বাড়ির ছেলে-মেয়েরা খেলতে আসে। আগে বিকেলে খেলতে আসতো। এখন রোজার সময় দুপুরে মক্তব শেষ করেই সবাই জমা হয় মাঠে। সালমা দৌড়ে দৌড়ে আসে।
রাপি ভাইয়া। সালমা তোকে কতবার বলেছি আমার নাম রাফি। রাপি না। সালমা দাঁত বের করে হেসে বলে, রাপি ভাইয়া। রাফিও হেসে দেয়। রাপি ভাইয়া জানো, আমার আম্মু আজকে আমার জন্যে নতুন জামা আনবে।
তাই নাকি? রাফি খুশি হয়। হ্যাঁ, আম্মু আমারে কথা দিসে। আজকে জামা আইনা দিবে। কি মজা এবার আমিও নতুন জামা পরবো। এবার আমারও ঈদ হবে। বলতে বলতে সালমা দু হাত দুদিকে ছড়িয়ে দিয়ে ছুটে বেড়ায়। রাফি, সবুজ সেলিম লাবিবরা খুশি হয় সালমার আনন্দে। ওদেরই স্কুলে এবার তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ে সালমা। আর ওরা ষষ্ঠ শ্রেণীতে। রাফি-লাবিবরা জানে সালমার মা কত কষ্ট করে ওকে পড়ায়।
মরিয়মের মনটাই খারাপ। দু বছর করোনায় ব্যবসায় বেশ ক্ষতি হয়। তাই এবার কর্মচারীদের পুরা বেতন দেয়া হয়নি। সবার বেতন অর্ধেক করে দেয়া হয়েছে। অনেকেই ক্ষিপ্ত হয়ে প্রতিবাদ করে এ নিয়ে। কিন্তু লাভ কিছুই হয় না। পুরো মাস চালাতেই হিমশিম খেতে হবে। তার মধ্যে মেয়েকে আজ বাড়ি গিয়ে কি বলবে এসব ভাবতে ভাবতেই কখন যেন অটোরিকশার ভেতর চোখ লেগে আসে মরিয়মের। অনেক সময় পর ড্রাইভারের হাকডাকে ঘুম ভাঙ্গে। ভাড়া দিতে গিয়েই ব্যাপারটা লক্ষ্য করে। হাতের ছোট ব্যাগটা একদম ফাঁকা। একটা পয়সাও নেই। মরিয়ম মনে করতে চেষ্টা করে। পাশে চিকন মতো একটা মেয়ে বসেছিলো। নরমাল থ্রি-পিস পরা। মেয়েটা যে পাক্কা চোর তার চেহারা দেখে বুঝার উপায় নেই। মরিয়মের চোখ লেগে আসার সুযোগ এ সব সাফ করে দিয়েছে। হাউমাউ করে কেঁদে উঠে মরিয়ম।
আজ শেষ রমজান। মাগরিবের আজানের আর কিছুক্ষণ বাকি। সিঁড়িতে উদাস হয়ে বসে আছে সালমা। কাল সবাই ঈদ করবে, কত আনন্দ করবে। নতুন জামা পরে ঘুরে বেড়াবে। সালমা উঠে গিয়ে মায়ের কোলে মাথা গুঁজে কাঁদতে থাকে। হঠাৎ দড়জায় কড়া নাড়ার শব্দ হতেই মরিয়ম উঠে গিয়ে দরজা খুলেন। ওরা সবাই একে একে ঘরে ঢুকে। সবার হাতেই অনেকগুলো প্যাকেট। সালমা চোখ মুছে তাকাতেই দেখে রাফি সেলিম লাবিব অনেকগুলো প্যাকেট হাতে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে। প্যাকেট থেকে একে একে নানারকম খাবার বের হয়। বিরিয়ানি, হালিম, নানা রকম ফল, মিষ্টি, খেজুর, জুস, কাবাব, রুটি। আর সবশেষে বের হলো সালমার জন্যে সুন্দর একটি জামা। সালমার আনন্দের সীমা থাকে না। মরিয়ম অবাক হয়ে চেয়ে আছেন। এবার ভেতরে প্রবেশ করেন লাবিবের বাবা মিজানুর রহমান।
আসসালামু আলাইকুম ভাবি। ওয়ালাইকুমুস সালাম ভাই। ভাই এসব কেনো আর কি দরকার ছিলো। আমিতো কিছুই বুঝতে পারছি না। কেন ভাবি, ঈদ কি শুধু ধনীদের জন্যেই আসে? ঈদ কি ধনী গরিব ভেদাভেদ এ হয়? আর ভাবি আমি কিন্তু আপনার অবস্থা জানি। একজন মুসলিম হিসেবে আমার কি এটা দ্বায়িত্ব নয় আমার প্রতিবেশীর বিপদে আমি পাশে দাঁড়াবো। লাবিব আমাকে সব বলেছে ওর বন্ধুদেরও তাই কথা। ওরা আপনার আর আপনার মেয়ের জন্যে এবারের ঈদটা আনন্দময় করতে চেয়েছে। মরিয়ম বেগমের চোখে পানি এসে যায়। মিজানুর রহমান সাহেব হাজার খানেক টাকা সালমার মায়ের হাতে গুঁজে দেন। মরিয়ম বেগম প্রচণ্ড আপত্তি করেন। মিজানুর রহমান বলেন, ভাবি না করবেন না। আপনার ভাই হিসেবে ভাই থেকে বোনের জন্যে এই ছোট্ট উপহারটুকু গ্রহণ করুন। আপনার পুরো মাসের বাজার খরচ। আসুন ভাবি, সবাই মিলে ইফতার করবো। আর বেশি সময় নেই।
মাগরিবের আজান হচ্ছে। মরিয়ম অবাক হয়ে চেয়ে চেয়ে দেখেন, তার সামনে কতগুলো মানুষ নয়, ছোট ছেলেমেয়ের রূপে বেহেশতী পাখিরা বসে আছে। যে পাখিরা এ মুহূর্তে তার ঘরকে আলোকিত করে রেখেছে।
* পাঠক ফোরাম বিভাগে লেখা পাঠানোর ঠিকানা : [email protected]