প্রকাশ : ১৪ মে ২০২২, ০০:০০
তখন মার্চ মাস। রিন্টু আমাদের ক্লাসে নতুন ভর্তি হয়। মার্চের প্রথম সপ্তাহেই পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তি হয়ে যায়। ক্লাস শুরু হওয়ার এখনো বিশ মিনিট বাকি। প্রথম ক্লাস আনোয়ার স্যারের। স্যারের ক্লাস মানেই রীতিমতো আতঙ্ক। এজন্যে সবাই প্রতিদিন ভালো করে স্যারের পড়া শিখে যেতাম। ক্লাস শুরুর বিশ মিনিট আগে প্রতিদিন এক বেঞ্চে বসে আমি টিপু, ইকবাল, রবি, মিতু সবাই একসাথে পড়া রিভিশন দিতাম। সেদিনও বসে বসে আমরা পড়া রিভিশন দিচ্ছি। তখনি রিন্টু ক্লাসে ঢুকে। গুনে গুনে একদম সবার শেষের বেঞ্চটায় গিয়ে বসে।
ইকবাল আমাদের সবার মধ্যে বেশ ভদ্র। সবসময় মাথায় টুপি পরে স্কুলে আসতো। আমাদের স্কুলে নতুন কেউ আসলেই ইকবাল তাকে গিয়ে সালাম দিয়ে তার খবরাখবর জিজ্ঞাসা করতো।
ইকবাল রিন্টুর কাছে গিয়ে সালাম জানায়। রিন্টু কোনো উত্তর দেয় না। মুখ অন্ধকার করে বসে থাকে। ইকবাল মন খারাপ করে ফিরে আসে। মিতু মুখ ভেংচিয়ে বলে, ইস্ দেমাগ দেখলে বাঁচি না।
রিন্টু কিছুই বলে না। চোখণ্ডমুখ শক্ত করে তাকিয়ে থাকে। ঘণ্টা পড়ে যায়, ছেলে-মেয়েরা তড়িঘড়ি করে ক্লাসে ঢুকে। একটু পড় আনোয়ার স্যার চলে আসেন। স্যারকে দেখলে যথারীতি আমরা ভয়ে থাকি।
স্কুল ছুটির পর বড় মাঠটায় আমরা সবাই খেলতে যেতাম। রিন্টু কখনো কখনো আসতো। কিন্তু আমাদের সাথে কখনোই খেলতো না। চুপচাপ জাম গাছটার নিচে বসে থাকতো। রিন্টু কে অবশ্য কেউ ঘাটাতো না। ওর কাছে গেলে ঠিক কেমন যেনো একটা অনুভূতি হতো। ওর ঠাণ্ডা-শীতল চোখের দৃষ্টি। যেনো আমার ভেতরটা পর্যন্ত দেখতে পায়। মানুষের চোখের মণি বাদামী-নীল-সবুজ রঙের হয় জানতাম। কিন্তু এই প্রথম রিন্টুর চোখই দেখলাম তার মণিগুলো কিছুটা লালচে ধরনের। পৃথিবীতে অদ্ভুত শারীরিক বৈশিষ্টের মানুষ হয় জানতাম। রিন্টুর ব্যাপারটাকেও ওরকম কিছু ভেবে নিলাম।
রিন্টু ক্লাসের কারো সাথেই তেমন একটা মিশতো না। রিন্টুকে ভাগে পেতে আমার অনেকটা সময় লেগেছিলো। প্রায় দুই মাস পর গিয়ে রিন্টু আমার সাথে বেশ খানিকটা মিশতে শুরু করে। রিন্টুকে নিয়ে প্রায় শুক্রবারই একসাথে সাঁতার কাটতাম। রিন্টু কখনো আমার সাথে নামাজ পড়তে যেতো না। অনেকবার বলার পরও। বলতো আমি ওখানে যেতে পারবো না। আমার শরীর বেশিক্ষণ পবিত্র থাকে না।
কেমন অদ্ভুত লাগতো কিন্তু রিন্টুর উপর একটা মায়া কাজ করতো সবসময়। তাই বেশি কিছু বলতাম না। রিন্টু প্রায় সময়ই আমাকে বিভিন্ন অদ্ভুত সব জিনিস এনে দিতো যেগুলো আমি আগে কখনোই দেখেনি।
রিন্টু মাঝে মাঝে আমাকে নিয়ে পুরনো ভাঙ্গা খ্রিস্টান চার্চের কাছে যেতো। আমি চার্চের সিঁড়িতে বসে থাকতাম। অনেক্ষণ পর রিন্টু ফিরে আসতো মুখ মুছতে মুছতে। আমি কিছুটা রাগ করে বলতাম, আমাকে না দিয়ে কি খেলি।
রিন্টু হেসে বলতো লাল পানি। এই প্রথম রিন্টুকে হাসতে দেখতাম। অন্যসময় সে মুখ অন্ধকার করে থাকে। আমি প্রায়ই রিন্টুকে তার প্রিয় খাবার নিয়ে জিজ্ঞেস করতাম। রিন্টু তোর কি খেতে বেশি ভালো লাগে। রিন্টু উত্তরে শুধু বলতো, আমার লাল পানি খুব পছন্দের। লাল পানি খেতে অনেক ভালো লাগে আমার।
রিন্টু লাল পানি কি রে?
রিন্টু কোনো উত্তর করতো না। চুপচাপ পাশ কাটিয়ে যেতো। মিতু প্রায়ই কান টেনে ফিসফিস করে বলতো, ওই রিন্টু মানুষ না, ও পিশাচ। দেখিস না কেমন ভূতের মতো মুখ করে বসে থাকে সারাদিন। মিশবি না ওর সাথে খবরদার। আমি হি হি করে হাসতাম। একদিন খুব জিদ করলাম। রিন্টু তোর লাল পানি আজকে আমাকে খাওয়াবি। রিন্টু বারবার আমাকে না করতে লাগলো, না বাদল ওটা তোর খাওয়ার জিনিস না। তুই বরং অন্য যা কিছু খেতে চাইবি আমি এনে দিবো এক নিমিষে।
না না রিন্টু আমার ওটাই চাই। তুই দিবি কি না, নাহলে তোর সাথে জন্মের মতো কথা বন্ধ। আমি নাছোড়বান্দা। রিন্টু কিছুটা নিরূপায় হয়ে বললো, আচ্ছা বস একটু, নিয়ে আসছি। একটু পর রিন্টু একটা সাদা বাটিতে করে কিছু লাল পানীয় ধরনের বস্তু নিয়ে আসে। আমি খুব খুশি হয়ে চুমুক দিলাম। কিন্তু একি। ভক করে একটা গন্ধ নাকে লাগলো। পানিটা ঘন এবং গরম। কেমন নোনতা বিচ্ছিরি স্বাদ। হরহর করে বমি করে মাথা ঘুরে পড়লাম।
টানা সাতদিন জ্বরে ভুগলাম। এই সাতদিন রিন্টুর মুখ দেখিনি। পাজিটা কিসব খায় আর আমাকেও খাইয়ে বমি করালো। এমন পঁচা জিনিস মানুষে খায়।
সাতদিন পর রিন্টু আমার বাড়ির পেছনের বাগানে এলো। অপরাধীর ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। আমিও আর রেগে থাকতে পারলাম না। রিন্টু বললো চল পুরানো চার্চে যাই। আমিও কোনো কথা না বলে সায় দিলাম। তখন সন্ধ্যা।
রিন্টু প্রতিদিনের মতো চার্চের পেছনে গেলো। রিন্টু সবসময় আমাকে নিষেধ করতো। যতোক্ষণ সে না আসে আমি যেনো পেছনে না যাই। অনেক্ষণ চুপচাপ বসে থাকলাম। আজ রিন্টুর বেশ দেরি হচ্ছে। কৌতূহল চাপতে না পেরে উঠে পেছনে গেলাম। গিয়ে দেখলাম মাটিতে একটা বড় বন-বিড়াল পড়ে আছে। রক্তাক্ত ছিন্নভিন্ন শরীর। রিন্টুর সারা মুখ রক্তে মাখা। চোখে-মুখে হিংস্রভাব। আর একি, রিন্টুর হাতের থাবাগুলো লোমে ডাকা। বড় বড় নখ তাতে। আর কিছু মনে নেই।
এক মাস পর সুস্থ হয়ে স্কুলে গেলাম। সেদিন ওখানে কিভাবে গিয়েছিলাম কাউকেই বলিনি। রিন্টুকেও আর কোনোদিন ওই স্কুলে দেখেনি।
এখন আমি দশম শ্রেণিতে পড়ি। মাঝে মাঝেই রিন্টুকে খুব মনে পড়ে। হয়তো কোনো একদিন রিন্টু আমার বাড়ির পেছনের বাগানে এসে দাঁড়াবে। বলবে, বাদল চল পুরানো চার্চে যাই। লাল পানি খাবো।
* পাঠক ফোরাম বিভাগে লেখা পাঠানোর ই-মেইল : [email protected]