প্রকাশ : ২৩ এপ্রিল ২০২২, ০০:০০
ঈদ উপলক্ষে সেমাই চিনি বিতরণ করা হচ্ছে। রাসেল এ ত্রাণ কার্যক্রমের টিম লিডার। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উত্তরবঙ্গের এই জনপদে ত্রাণ বিতরণ করতে এসেছে তারা। এখানের মানুষদের দেখে পনেরো বছর আগের সেই ঈদের কথা মনে পড়ে যায় তার। যে ঈদে তাদের ভাগ্যের চাকা বদলে যায়। এখনো রাসেলের স্পষ্ট মনে পড়ে মায়ের ওই ঈদের চিন্তিত মুখ।
মাথায় হাত দিয়ে বসে ছিলো আমেনা। বাচ্চা দুটোরও মন ভীষণ খারাপ। রাসেল একটু-আধটু বুঝতে শিখেছে। কিন্তু তার বোন রূপা এখনো বুঝে না অভাব কি। মায়ের মনতো আর মানে না। গত ঈদেও বাচ্চাগুলোকে ঈদের জামা কিনে দিতে পারেনি আমেনা। কথা দিয়ছিলো এ ঈদে অবশ্যই কিনে দিবে। রাত পেরোলেই তো ঈদ। কিন্তু এখনো কিছু কিনতে পারেনি সে। কি করবে কিছু মাথায় আসছে না। ধ্যাৎ, ভালো লাগছে না কিছু। বাচ্চাগুলোকে কতবার আশ্বাস দিয়ে আশ্বাস ভাঙ্গতে হয়েছে। মা হিসেবে অপরাধী মনে হয় নিজেকে। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে নিজের অজান্তে। আজ বাচ্চাগুলোর বাবা বেঁচে থাকলে হয়তো এমন হতো না। সেই চার বছর আগের কথা মনে পড়ে যায় আমেনার। শেষবার সোহেল যখন শহর থেকে গ্রামে আসে কত কিছু নিয়ে এসেছিলো সে। আমেনার জন্যে শাড়ি, বাচ্চাদের জন্যে জামা-কাপড় এবং আশপাশের সবার জন্যে ঈদের জামা। বাড়ির বাচ্চারা সেদিন সবাই অনেক খুশি হয়েছিলো। অথচ ভাগ্যের ফেরে আটকে পড়ে আজ নিজেদের জামাও কিনতে পারছে না তারা। সোহেল এক্সিডেন্টে মারা যাওয়ার পর সবদিক থেকে অবনতি হয় আমেনার। হাতে যা কিছু জমানো টাকা ছিলো সব দ্রুত ফুরিয়ে যায়। হাত খালি হয়ে যায় আমেনার। অনেক চেষ্টা করেছে কোনো একটা কাজ জোগাড়ের জন্যে। কিন্তু এ মফস্বল গ্রামে মানুষ নিজেরাই ঠিকমতো তিন বেলার খাবার জুটাতে কষ্ট হয়। সেখানে আমেনাকেই বা কে কাজ দিবে। সবাই আছে ‘চাচা আপন প্রাণ বাঁচা’ অবস্থায়।
পশ্চিমাকাশে সূর্যের অবস্থা দেখে বোঝা যাচ্ছে বিকেল পাঁচটা-সাড়ে পাঁচটা বাজে হয়তো। ঘণ্টা দেড়েক পরই মাগরিবের আজান হবে। আজ ঘরে ইফতারিও নেই কিছু। গত সপ্তাহে ওই পাড়ার একজন কিছু ইফতারি দিয়েছে, সাথে কিছু খেজুর। তা দিয়েই এ সপ্তাহ পার হয়েছে কোনো মতে। আজ চাপকলের ঠাণ্ডা পানিই একমাত্র ভরসা। এমন সব ভাবতে ভাবতেই রাস্তার দিকে বাচ্চাদের হৈ-হুল্লোরের শব্দ শুনতে পায় আমেনা। কি হলো আবার। এলাকার বাচ্চারা আচ্ছা দুষ্টু। সারাদিনই চিল্লাচিল্লি, মারামারি! আর কোনো কাজ নেই যেনো। এদের দুষ্টুমির কারণে মুরুব্বিদের মধ্যেও বাড়ে শত্রুতা। এইতো সেদিন বাচ্চাদের দুষ্টুমির কারণে বেলাল ভাইয়ের সাথে হেলাল ভাইয়ের কি তুমুল মারামারি। অথচ বেলাল, হেলাল এদের মাঝে কখনো কোনো কিছু নিয়ে বিরোধ ছিলো না। বাচ্চাদের হয়ে কথা বলতে গিয়ে নিজেরাও মারামারিতে জড়িয়ে যায়। পরে এ নিয়ে সালিশও হয়েছে। বাচ্চাগুলোর চিৎকার আরও বাড়ে। পাল্লা দিয়ে সবাই চিৎকার করছে। আমেনা পা বাড়িয়ে এগিয়ে যায়। কি হয়েছে, বাচ্চারা চিল্লাচ্ছে কেনো? রাস্তার দিকে এগোতেই একটা গাড়ি দেখতে পায় আমেনা। বাচ্চাগুলো গাড়িটির পেছনে পেছনে দৌড়াচ্ছে। এ সময় গ্রামে এমন গাড়ি। ব্যাপার কি! কোনো কুলকিনারা খুঁজে পায় না সে। ভাবছে আর এক পা-দুই পা করে সামনে হাঁটছে আমেনা। ইব্রাহিম সাহেব নামে একজন লোক এসেছে গ্রামে। সাথে একটি বড় হাইএস গাড়ি। সাদা রঙের। এর আগে এরকম গাড়ি কখনো আসেনি এই গ্রামে। পেছনে ছোটো ট্রাকের মতো একটি পিক-আপ ভ্যান। একজন লোক নামে হাইএস গাড়ি থেকে। গায়ে হালকা পার্পেল কালারের কাজের মধ্যে একটা পাঞ্জাবি, পরনে পায়জামা। গালভর্তি দাড়ি। বয়স পঞ্চান্ন-ষাটের মতো হবে। লোকটিকে দেখে অনেক বড় লোক মনে হচ্ছে। গাড়ি থেকে নেমে সোহেলের বাড়ি খোঁজ করছেন লোকটি। একজন মুরুব্বি গোছের মানুষ সোহেলের বাড়ি দেখিয়ে দেয়।
আমেনা জানতে পারে লোকটির নাম ইব্রাহিম। তিনি সোহেলের কোম্পানির মালিক। সোহেল মারা যাওয়ার পর তার পরিবারের সব দায়িত্ব নিতে চেয়েছিলেন তিনি। কারণ কোম্পানির ফ্যাক্টরির কাজে ঢাকা থেকে চিটাগাং যাওয়ার পথে গাড়ি এক্সিডেন্ট করেছিলো সোহেল। গাড়িতে ড্রাইভারসহ মোট পাঁচজন ছিলো। সবাই স্পটডেট। কিন্তু সোহেল মারা যাওয়ার পরপরই ইলেকট্রিক শর্টসার্কিটের আগুনে ইব্রাহিম সাহেবের ফ্যাক্টরি আগুন লাগে। আগুনে পুড়ে সব শেষ হয়ে যায় তার। বড় অঙ্কের লসে বিরাট ধাক্কা খেয়েছিলেন তিনি। পরে অনেক কষ্টে ব্যাংক লোন, ধার-দেনা করে আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। জাত ব্যবসায়ী তিনি। ছোটবেলা থেকে নিজের পরিশ্রম আর সততা দিয়ে আজকের অবস্থান তার। এখন চার-চারটা ফ্যাক্টরি তার। সব মিলিয়ে প্রায় চল্লিশ হাজার ওয়ার্কার কাজ করে তার ফ্যাক্টরিগুলোতে। ইব্রাহিম সাহেব আজ শুধু সোহেলের পরিবারের দায়িত্ব নিতে আসেননি। সাথে করে গ্রামের সবার জন্যে নিয়ে এসেছেন ঈদ উপহার।
ইব্রাহিম সাহেব আগেই তথ্য নিয়েছেন ইউনিয়ন বোর্ড অফিস থেকে। এ গ্রামে কতটি পরিবার। সব মিলিয়ে কতজন কোনো বয়সী ছেলেমেয়ে আছে তার তথ্যও। ইতিমধ্যে গ্রামের অনেকে জড়ো হয়েছে গাড়ির কাছে। গ্রামের এ প্রান্ত থেকে ঐ প্রান্ত পর্যন্ত রটে যায় একজন দানবীর এসেছেন গ্রামে। যে যা চায়, তাই নাকি দিচ্ছে। এ খবর পেয়ে গ্রামের গরিব মানুষগুলো সবাই গাড়ি লক্ষ্য করে ছুটে আসছে। ইব্রাহিম সাহেব ইউনিয়ন বোর্ড অফিস থেকে প্রাপ্ত তথ্যের হিসেবে সবার জন্য জামা কাপড় নিয়ে এসেছেন। জামা-কাপড়, সেমাই চিনি সব পিক-আপ ভ্যানে। তিনজন ছেলেকে সাথে করে নিয়ে এসেছেন তিনি। ছেলেগুলো লিস্টের সবার নাম ধরে ধরে ডেকে ডেকে সবাইকে একটা করে কাপড় দিচ্ছেন। বাচ্চাদের জন্য একসেট জামা-প্যান্ট। মুরুব্বিদের জন্য একটা করে পাঞ্জাবি। সাথে প্রত্যেক পরিবারের জন্য একটি করে খাম। প্রতিটি খামে তিন হাজার করে টাকা। গ্রামের সবাই ভীষণ খুশি। খুশিতে সবাই যেন আগামীকালের ঈদ আজই পালন করে ফেলে এ অবস্থা।
আমেনার হাতে একটি খাম তুলে দেন ইব্রাহিম সাহেব। খামে পাঁচ লাখ টাকা। সাথে বাচ্চাদের জন্যে জামা-কাপড়, ঈদের জন্যে সেমাই চিনি। আমেনার বিশ্বাস হচ্ছে না কিছু। কি হচ্ছে এসব। সোহেল তার মালিকের কথা বলতো প্রায়ই। যে আমার কোম্পানির মালিক অনেক ভালো একজন মানুষ। আজ তার প্রমাণ হাতে-নাতে পায় আমেনা। আমেনা খামসহ জামা-কাপড়, সেমাই-চিনি গ্রহণ করে ইব্রাহিম সাহেব থেকে। ইব্রাহিম সাহেব, আমেনার দুই বাচ্চার পড়াশোনারসহ সবকিছুর দায়িত্ব নেয়। যাওয়ার আগে আমেনাকে বলে, মা এই নাও আমার কার্ড। তোমাদের যে কোনো প্রয়োজনে আমাকে নিঃসংকোচে জানাবে। আমি তোমাদের পাশে আছি সবসময়। এই বলে ইব্রাহিম সাহেব গাড়িতে ওঠে বসে। ইব্রাহিম সাহেবের খুব তাড়া। আবার ঢাকায় ফিরে যেতে হবে তাকে। ইফতার করবে হাইওয়ে রোডের পাশের এতিমখানায়। সেখানেও একটা প্রোগ্রাম আছে তার। এতিমখানার বাচ্চাদের নিয়ে আজ একসাথে ইফতার করবেন তিনি। গাড়ি গ্রাম ছেড়ে যায় ইব্রাহিম সাহেব ও তার টিমকে নিয়ে। আমেনার দু চোখে কান্না। স্রষ্টার লীলা বুঝা বড্ড কঠিন। তিনি কি চান তিনি নিজেই জানেন। দু চোখ ভিজে আসে আমেনার। এর মধ্যেও ভীষণ খুশি সে। বাচ্চাদের দেয়া কথাতো রাখতে পারবে এই ভেবে। রাসেল ও রূপা নতুন জামা পেয়ে ভীষণ খুশি। খুশি যেন আর ধরেনা। আমেনা ইব্রাহিম সাহেবের দেয়া ইফতারির প্যাকেট থেকে একটা খেঁজুর মুখে দেয়, চাপকল এর পানি দিয়ে ইফতার করে শেষ করে। নামাজে বসে দুহাত তুলে দোয়া করতে থাকে ইব্রাহিম সাহেবের জন্যে। সাথে সোহেল, বাচ্চাদের জন্যে এবং সমগ্র মাখলুকাতের জন্য।
রাসেলের চোখেও এক অন্যরকম জল দেখা যায়। যে জল রাসেলের ত্রাণ কার্যক্রমের গতি বাড়ায়। রাসেল নিজেকে সৌভাগ্যবান ভাবে। আর এগিয়ে চলে তার এই ত্রাণ কার্যক্রম।