প্রকাশ : ২৩ এপ্রিল ২০২২, ০০:০০
ঈদ মানেই আনন্দ, ঈদ মানেই খুশি, ঈদ মানেই ভেদাভেদ ভুলে দুঃখ-সুখে হাসি। প্রতি বছরই আমাদের মাঝে ফিরে আসে খুশির পবিত্র ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা। ঈদ শব্দটি শোনামাত্রই মনের ভেতর এক ভিন্ন রকম খুশির আমেজ সৃষ্টি হয়। সকল দুঃখ, বেদনাকে ভুলে গিয়ে হৃদয় নেচে উঠে এক ভিন্ন রকম রঙিন আনন্দে। এক মাস সিয়াম সাধনার পর বাঁকা চাঁদের হাসি দেখে সকল মুসলিম হৃদয়ে বেজে উঠে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের সেই কালজয়ী গান, ‘ও মন রমজানেরই রোজার শেষে, এলো খুশির ঈদ...’। কিন্তু আমাদের সকলের শৈশবে যেমন কেটেছে ঈদের আনন্দ, সে আনন্দ কি আর এখন মনে বিরাজ করে? এমন প্রশ্নই মনের ভেতরটা নাড়া দিয়ে উঠে প্রতি বছরের ঈদ এলে। জীবনের পাতা থেকে এক এক করে একেকটি বছর চলে গেলেও শৈশবের সেই আনন্দ-উচ্ছ্বাসের স্মৃতিময় ঈদ ফিরে আসেনি।
শৈশবে ঈদের দিন যতোটা না আনন্দ পেতাম তার চেয়ে বেশি আনন্দ পেতাম ঈদের আগের দিন রাতে। অর্থাৎ যেটাকে আমরা ‘চাঁদরাত’ বলে থাকি। শেষ রোজার দিন সন্ধ্যায় ইফতার সেরে মসজিদে মাগরিবের নামাজ শেষ করে সবাই মসজিদ থেকে নেমে সোজা রাস্তায় পাশে দাঁড়িয়ে পশ্চিম আকাশে তাকিয়ে ঈদের চাঁদ খুঁজে বেড়াতে ব্যস্ত হতাম। কোনো একজন তীক্ষè দৃষ্টি দিয়ে বাঁকা চাঁদ দেখতে পেলেই পর্যায়ক্রমে সকলে মিলে সিরিয়ালে চাঁদমামাকে খুঁজে বেড়াতাম। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অপর জনের ঘাড়ের কাছে মাথাটা টেনে নিয়ে শাহাদাত আঙ্গুল উঠিয়ে বলতো, ঐ যে চেয়ে দেখ চিকন করে চাঁদটি বাঁকা হয়ে আছে। পাশে একটি তারাও রয়েছে। দুই চোখ খোলা রেখে ঈদের চাঁদ দেখতে না পেলে এক চোখ বন্ধ করে দুরবীক্ষণ যন্ত্রের মতো বাঁকা চাঁদের হাসি দেখতেই শুরু হতো ঈদের আনন্দের মিছিল ও নানা শ্লোগান। চাঁদ উঠেছে, চাঁদ উঠেছে এলো খুশির ঈদ। আজকে মোদের খুশির দিন কাল আমাদের ঈদের দিন। এসব বলে বলে বন্ধুরা মিলে আনন্দে ভেসে বেড়াতাম। সাথে সাথে শুরু হতো রড কিংবা রিকশর স্কুপ দিয়ে বানানো গোলা বারুদের বাজি ফোটানো। কখনো আবার দোকান থেকে ক্রয়কৃত কাগজে বানানো আতশবাজি ফুটাতাম, রেললাইনের দুটি পাথর হাতে নিয়ে পাথরে পাথরে আঘাত করে আগুন ধরানোর চেষ্টা করতাম। সাথে বাহারি রংয়ের গুঁড়ো এবং জরি গুঁরো সমবয়সীদের গায়ে ছিটিয়ে হৈ-হুল্লুর করে অনেক আনন্দ উপভোগ করতাম। শেষ রোজায় দিনের বেলায়ই সকলে মিলে গাছের ডাল, বাঁশের ডাল, কাগজ পাতা দিয়ে খেলনা ঘর (বুড়ির ঘর) বানিয়ে রাখা হতো। ঈদের চাঁদ দেখা মাত্রই সেই বুড়ির ঘরে আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে ব্যাপক আনন্দণ্ডউল্লাস করে বেড়িয়েছি। ঈদকে ঘিরে সকল বন্ধুবান্ধব নিজেদের কাছ থেকে পঞ্চাশ অথবা একশো টাকা করে চাঁদা উঠিয়ে বাড়ির আঙ্গিনায় কিংবা দোকানের কাছে প্যান্ডেল সাজিয়ে সাউন্ড সিস্টেম ভাড়া করে ব্যাপক শব্দ দিয়ে গান বাজাতাম। গভীর রাত পর্যন্ত চলতো সেই নাচণ্ডগানের আসর।
এছাড়াও ঈদের দশ পনের দিন আগে থেকেই নতুন জামা-কাপড় ক্রয় করে লুকিয়ে রাখতাম। যাতে করে ঈদের দিন ছাড়া এর আগে যেনো কেউ সেই নতুন জামা কাপড় দেখতে না পায়। আগে দেখে ফেললে ভাবতাম ঈদের আনন্দ নষ্ট হয়ে যাবে। আমার ঈদটি শেষ হয়ে যাবে। গভীর রাত পর্যন্ত জেগে থাকায় চোখ হয়ে যেতো লাল টগবগে, তবুও যেনো মনের আনন্দ ফুরাতো না। বড় সাউন্ড সিস্টেম বক্সে গভীর রাত পর্যন্ত চলতো নানা ধরনের হিন্দি এবং বাংলা গান।
চাঁদরাতের আনন্দ শেষ করেই ভোর বেলায় যখন মসজিদের মাইকে ঘোষণা হতো ঈদ মোবারক, ঈদ মোবারক। তখন এই মোবারক শব্দে ঘুম পালাতো বহু বহু দূরে। লাফিয়ে উঠে প্যান্ট কিংবা লুঙ্গি, গামছা কাঁধে ঝুলিয়ে পুকুর ঘাটে গিয়ে তিন ডুব দিয়ে লাক্স অথবা লাইফবয় সাবান গায়ে মেখে ভালো করে শরীর পরিষ্কার করতাম। আজ ঈদের দিন, নিজেকে নতুন রূপে, নতুনভাবে সাজাতে হবে এমনটাই মনের আনন্দ ছিলো। গোসল সেরে ঘরে এসে স্নো, পাউডার শরীরে তেল মেখে আলমারী থেকে নতুন জামা-কাপড়, পড়ে নতুন জুতা পায়ে দিয়ে ঈদগাহে যেতাম ব্যাপক আনন্দে। ঈদের খুশিতে মনটা নেচে উঠতো যেনো তাধিন তাধিন করে।
ঈদগাহে ঈদের জামাত শেষ করতেই হ্যান্ডশিপ এবং কোলাকুলিতে জড়িয়ে কুশল বিনিময়ে একজন অপরজনকে ঈদের দাওয়াত দিতাম। নামাজ শেরেই বড়দেরকে পায়ে সালাম দিয়ে বখশিসের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত থাকতাম। কে কত টাকা সালামি উঠিয়েছি তার একটা হিসবে হতো বন্ধুদের ঈদ আড্ডায়।
শুধু তাই নয়, তখনকার দিনে বিভিন্ন নায়ক-নায়িকার ভিউকার্ড এবং ঈদকার্ড বাজারে বিক্রি করা হতো। ঈদের কয়েকদিন আগে থেকেই দুই টাকা কিংবা এক টাকা দিয়ে সেই ভিউকার্ড এবং ঈদ কার্ড ক্রয় করে খামে ঢুকিয়ে প্রিয়জন, বন্ধুবান্ধবদেরকে ঈদের শুভেচ্ছা ও দাওয়াত করা হতো। উঠতি বয়সে মনে আবেগ থাকে বেশি প্রেমও থাকে অনেক। আর সেই আবেগের প্রেম থেকেই স্কুলজীবনের প্রিয় ক্লাসমেট কিংবা প্রিয় মানুষটিকে লাভ চিহ্নের আঁকা বিভিন্ন ডিজাইনের ঈদকার্ড প্রদান করতাম। সকালে ঈদের নামাজ শেষে ঈদ সালামি উঠানো এবং এলাকায় ঘুরে ফিরে ও গান বাজনার আনন্দ শেষ করে বিকেলে দূরে কোথাও ঘুরতে বের হওয়া হতো। ঈদের বাতাসে মন ছলছল করে ঘুরে আসতাম নদীর পাড়ে কিংবা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কোনো স্থানে। কি যে আনন্দ ছিলো শৈশবের সেই ফেলে আসা হারানো দিনগুলোতে।
আমাদের সময়ে শৈশবে ঈদে যতোটা না আনন্দ-উল্লাস করেছি। সেই আনন্দণ্ডউচ্ছ্বাস এখন আর তেমন নেই বললেই চলে। কারণ আধুনিকতার ছোঁয়ায় কালের বিবর্তনে অনেক কিছুই দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে ফেসবুক, ইন্টারনেট, হোয়াটস্আপ, মেসেঞ্জার, ইমু সামাজিক মাধ্যম এবং পাবজিসহ নানা ধরনের গ্যামস্ খেলার ভিড়ে শৈশবের সেই আনন্দণ্ডউচ্ছ্বাস এখন আর তেমন চোখে পড়েনি। সেকালের ঈদ আনন্দ আর বর্তমান ঈদ আনন্দের অনেক তফাৎ রয়েছে। প্রতি বছর ঘুরে ফিরে ঈদ আসে ঠিকই কিন্তু মনের ভেতর ফিরে আসেনি সেই ছেলেবেলার আনন্দণ্ডউচ্ছ্বাস। এখন ঈদ এলেও হৃদয়ে সুখের তেমন দোলা লাগেনি, বাঁকা চাঁদের হাসিতে তেমন করে হেসে উঠেনি মনের দুয়ার। রঙিন আবিরের ছোঁয়া লাগেনি হৃদয়ের মণিকোঠায়। জীবনের ডায়েরিতে স্মৃতির পাতায়, পাতায় জড়িয়ে রয়েছে শৈশবের সেই বাঁকা চাঁদের হাসি ভরা দৃশ্যের ঈদ-আনন্দ।