প্রকাশ : ১৬ এপ্রিল ২০২২, ০০:০০
আমার মা থেকে শুনেছিলাম, তাদের বিয়ের কয়েক বছর পর কোলজুড়ে আমি আসি। মায়ের তখন পড়ালেখা শেষ হয়েছে মাত্র। শুনেছিলাম বাবা নাকি ‘বাবা’ ডাকটা শুনতে অনেক আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। যখন আমি মায়ের গর্ভে ছিলাম বাবা নাকি মায়ের অনেক যত্ন নিতেন, খাওয়ার ব্যাপারে অনেক খেয়াল রাখতেন। আমি যেনো ঠিকঠাকভাবে মায়ের গর্ভে বড় হতে পারি সেদিকে বাবা খেয়াল রাখতে শত ব্যস্ততার মাঝেও ভুলে যেতেন না। একসময় মায়ের শারীরিক অনেক জটিলতা দেখা দিলো। ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়ে চেকআপ, বাসায় বাড়তি যত্ন বাবা করতেন। অতঃপর মায়ের ডেলিভারি তারিখ দেয়ার সময় বাবা অনেক কষ্ট করে অফিস থেকে ছুটি নিলেন আমাদের পাশে থাকার জন্যে, আরও বেশি সময় দেয়ার জন্যে। অবশেষে ডেলিভারি দিন আসলো। ডাক্তার বলেছিলেন, মা অথবা মেয়ে যে কোনো ১ জনকে বাঁচানো যাবে। বাবা বলেছিলেন, আমার ২ জনকেই লাগবে। মায়ের আবদার ছিলো বাবার কোলেই যেনো আমাকে প্রথম দেয়া হয়। বাবা আমাকে কোলে নিয়ে সুখে কান্না শুরু করেছিলেন।
আমি হাঁটি হাঁটি পা পা করে বড় হতে লাগলাম। রাতে কান্না করলে বাবা উঠোনে নিয়ে হাঁটতেন, বিভিন্ন উপায়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করতেন। ততোদিনে মা একটা চাকরি পেলেন। তাই অনেক সময় বাবাই আমাকে খাইয়ে দিতেন, গোসল করিয়ে দিতেন, ন্যাপকিন ক্লিন করে দিতেন। গল্প শোনাতেন, কাঁধে চড়াতেন ইত্যাদি। যখন আমার জ্বর হতো বাবা সারারাত মায়ের পাশে বসে থাকতেন। আমাকে বাবা-মা পরম যতেœ সারিয়ে তুলতেন।
আমি প্রথম যখন ‘বাবা’ বলে ডাকি, বাবা নাকি খুশিতে ভীষণ কান্না করে দিয়েছিলেন। মা-বাবার ২ জনের হাতে ২ হাত রেখে হাঁটা শিখা, কথা শিক্ষা রপ্ত করতে করতে স্কুলে যাওয়ার বয়স হয়ে গেলো। বাবার হাত ধরে স্কুলে গেলাম। বাবা সারাক্ষণ স্কুলের বাইরে আমার জন্যে অপেক্ষা করেছিলেন।
বয়স বাড়ার সাথে সাথে শুরু হতে লাগলো মায়ের শাসনের পালা। মা আমাকে শাসন করতেন বাবার আড়ালে। তখন সেটা বুঝিনি কিন্তু আজ বড় হওয়ার পর বুঝি বাবার আড়ালে মা কেনো আমাকে শাসন করতেন!
শিক্ষাজীবনের অনেকটা সময় অতিবাহিত হয়ে যায়। বাবা সিদ্ধান্ত নিলেন আমাকে প্রাইভেট মেডিকেলে পড়াবেন। আড়াল থেকে শুনতে পেয়েছিলাম বাবা বলছেন ‘টাকা যাবে যাক, তাণ্ডও আমার মেয়েটার যেনো ভবিষ্যৎ ভালো হয়, আমাদের খাবারের খরচ, যাতায়াত ভাড়া থেকে কিছু টাকা বাঁচালেই টুকটুকির পড়ার খরচটা হয়ে যাবে’। কিন্তু মা আপত্তি জানিয়েছেন। কারণ আমাদের ৪ ভাই-বোনের পড়ার খরচ, দাদির ওষুধের খরচ, সংসার চালাতেই আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবারের টানাটানি হয়ে যেতো। অবশেষে আমাকে উচ্চশিক্ষার জন্যে প্রাইভেট মেডিকেলে ভর্তি করানো হয়েছিলো। হোস্টেলে থাকার সুবাদে অনেকের পরিবারের গল্প শুনতাম। আমার এক বান্ধবী ছিলো সে ভালো খাবার তেমন খাওয়ার সুযোগ হতো না বলে তার বাবাও ভালো খাবার খাননি বেশ কয়েক বছর! মেয়ে যেদিন ভালো খাবার খেয়েছে শুনতেন, সেদিন বাবা ভালো খাবার মুখে তুলতেন!
অতঃপর আমি মেডিকেল পাস করলাম কিন্তু জানি না আমার মধ্যেবিত্ত পরিবারের এ মা-বাবার কত ঘামের বিনিময়ে, কত ত্যাগের বিনিময়ে আমি তা অর্জন করতে পেরেছিলাম। একটা কথা তো বলতেই ভুলে গিয়েছিলাম, আমার বাবা ছিলেন আমার সকল সাহসের উৎস। সৎ মানুষ হওয়ার প্রেরণা। তিনি কোনো ঈদে হয়তো নিজে জামা-কাপড় নেননি কিন্তু আমাদের ৪ ভাই-বোনকে জামাকাপড় কিনে দিতেন। আমরা যখন ঈদের দিন নতুন জামাকাপড় পরে ঘুরতাম সেটাই নাকি ছিলো বাবার ঈদের উপহার।
আজ ঈদ। বিশেষ দিন আমার জন্যে। কত বছর এইদিনের জন্যে অপেক্ষা করেছি। আজ নিজের উপার্জন করা টাকায় বাবা-মাকে জামাকাপড় কিনে দিয়েছি। ছোট ভাইবোনের জন্যে উপহার কিনে এনেছি। বাবা আবারও কাঁদলেন। আমিও আজ বাবার সাথে কেঁদেছিলাম।