প্রকাশ : ০৯ এপ্রিল ২০২২, ০০:০০
সীমা ছোটবেলা থেকেই ডায়েরি লিখে। গত তিন বছর নিয়ম পরিবর্তন হয়ে গেছে। সংসারের হাল ধরতে, কখনো খরিদ্দারের পণ্য পৌঁছে দিতে, কখনো পণ্য মজুদ করতে, কখনো ব্যবসায়ের কঠিন আর্থিক পরিস্থিতি সামাল দিতে, সবশেষে স্বামী আর বাচ্চাকে সময় দেয়ার পেছনে। তবুও মিলেছে কি শান্তি? এমনটা কি হওয়ার কথা ছিলো সীমার সাথে?
বাবা-মায়ের ছোট মেয়ে সীমা। বড় বোনের বিয়ে হয়েছে ইতালিপ্রবাসী ছেলের সাথে। তার মা এমনটা চেয়েছিলো বলেই। বিদেশ থেকে বোন প্রতিদিন ফোনো করে। বিদেশি অর্থ পেয়ে খুশিতে গদগদ হয়ে কথা বলে মা। একদিন মা পাশের বাড়িতে ছিলো। ফোন বাজছে বারবার। অষ্টম শ্রেণীতে পড়ুয়া চৌদ্দ বছরের মেয়ে খেলা ছেড়ে দৌড়ে গিয়ে ফোন ধরলো। ওই পাশ থেকে বোনের পরিবর্তে অন্য কেউ কথা বললো।
ভুলে মোহনের ফোন চলে গিয়েছে অন্য কোথাও। তারপর থেকে মাঝে মধ্যে বিকেলের দিকে সীমা আর মোহনের কথা হয়। নিজেদের পরিচয়ের পাশাপাশি পরিবারের সকল বিষয়ে একে অন্যের সাথে শেয়ার করে। তিন মাসের মধ্যে দুজনের মধ্যে খুব ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়। একদিন ফোনে কথা বলার সময় সীমার মা শুনে পেলে সব। সীমা ভয়ে মাকে সবটা বলে দেয়। আগামী সোমবার দুজনের দেখা করার কথাও বলে দেয়। মা তেমন কিছু বলেনি। শুধু বলেছে, বড় বোন যেমন জীবনসঙ্গী বাছাইয়ে জিতেছে, তেমনি সে-ও যেনো না ঠকে।
সীমা আর মোহন পার্কে বসে কথা বলছে। সীমা তেমন কিছু বলেনি, মোহন দুজনে একসাথে থাকার জন্যে সীমাকে বিয়ের কথা বলেছে। বাড়ি ফিরে সীমা মাকে সবটা বলেছে। এ-ও বলেছে, ফোনে মোহনকে যেমন দেখেছে বাস্তবে সে তেমনটা নয়। মা সীমাকে বলেছে ব্যবসা, বাড়ি আর অর্থ থাকলে চেহারার সৌন্দর্যের দরকার হয় না। পরের সপ্তাহে স্কুল থেকে সীমা বাড়ি ফিরেনি। চলে গিয়েছে মোহনের সাথে। শুরুতে বিয়ের পর আলাদা ভাড়া বাসায় উঠেছে তারা। মোহন কোনো কাজেই যাচ্ছে না। সীমার বাড়ি থেকে নেয়া টাকায় কিছুদিন চললো। একসময় সীমা বুঝতে পারলো, মোহনের আলাদা কোনো ব্যবসা নেই। বড় ভাইয়ের ব্যবসায়ে মাঝে মধ্যে সে সহযোগিতা করতো। লুকিয়ে বিয়ে করায় ভাইয়ের সাথে মনোমালিন্য হয়ে সেখানে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। প্রায়ই মোহন সীমাকে ওর বাবা-মায়ের কাছ থেকে টাকা নেয়ার জন্যে বলে। সীমা তা না শুনলে গায়ে হাত তুলে মোহন।
তোমার বড় বোন বিদেশে থাকে, টাকার অভাব কোথায়? চেয়ে নিলে সমস্যা কী?
বারবার চেয়ে নেবো কেনো? সত্যি বলতে তোমার তো কোনো ব্যবসাই নেই। তোমার বাবার বাড়িতেও আমাকে নিলে না, চেঁচিয়ে বললো সীমা।
কয়েক মাস পর মোহন ভাইয়ের কাছে ক্ষমা চেয়ে সীমাকে নিয়ে তার বাড়িতে উঠলো। ভাইয়ের ব্যবসায়ে সারাদিন সময় দেয় মোহন। রাতে বাড়ি ফিরে মা-বোনের সাথে কথা বলে সীমার জন্যে তার সময় থাকে না। এতোদিনে সীমা এই বাড়ির কাজের লোক হয়ে উঠেছে। ধোয়া, মোছা, রান্নাসহ সকলের ফরমাশ খেটে ক্লান্ত হয়ে রাতের শুরুতেই শুয়ে পড়ে সীমা। মোহন এসে বকাবকি করে সীমিকে। একদিন সীমা তার সারাদিনের খাটুনির কথা মোহনকে বলে। সবশুনে মোহন চুপ থাকে। কিছুদিনের মধ্যে সীমার শরীর প্রচণ্ড খারাপ হলে মায়ের থেকে টাকা চেয়ে মোহনের সাথে ডাক্তারের কাছে যায়। সেখান থেকে জানতে পারে সীমা মা হতে চলছে। মোহন বাড়িতে ফিরে তার মা, বোন ও ভাইয়ের স্ত্রীকে এ খবর জানালো। সকলকে সীমার যত্ন নিতে বললো।
আগের মতোই সব কাজ সীমাকে করতে হয়। মোহনকে বললে সে বিশ্বাস করে না। সীমা শরীর খারাপ নিয়ে শুয়ে থাকলে তার জাঁ এসে বলে, আমার বাড়িতে থাকতে গেলে কাজ করে খেতে হবে।
এই বাড়ি যে তার ভাসুরের সেটা সেদিনই সীমা জানতে পারলো।
ডেলিভারির তারিখের আগেই সীমার সমস্যা শুরু হলে সে তার মাকে জানায়। ডাক্তার বলে দু সপ্তাহ আগেই সিজার না করালে বাচ্চার সমস্যা হবে। পনেরো দিন হাসপাতালে থেকে সীমার বাচ্চাকে নিয়ে সীমার মা সীমার শ্বশুর বাড়িতে আসলো। সমস্ত খরচ বহন করাতে শ্বাশুড়ি এবং জাঁ সীমার মাকে ভালো আপ্যায়ন করলো।
কিছুদিনের মধ্যেই আবার সীমার কাজ শুরু হলো। একদিন সীমা মোহনকে বললো সে আর এখানে থাকতে পারবে না।
মোহন সীমাকে জানালো, আলাদা থাকতে গেলে বাবার বাড়ি থেকে টাকা এনে দিলে সে ব্যবসা করে আলাদা হবে। সীমা তার মাকে বাচ্চার খরচের জন্যে বলে টাকা এনে মোহনের ব্যবসার জন্যে দিলো। কিছুদিনের মধ্যেই সব টাকা শেষ করে মোহন আবার টাকা চাইলো। এবার সীমা না বললে, মোহন সীমার গায়ে হাত তুলে। শেষ পর্যন্ত মাকে এসব কিছুই না বলে মেয়েটি নিজের কন্যাসন্তানের মুখের দিকে চেয়ে সংসার বাঁচাতে নিজেই শুরু করলো, কাপড় সেলাই আর কাপড়ের ব্যবসা। সংসারটাকে দু বছরের মাথায় সুন্দর করে সাজালো। তারপরও মাঝে মাঝে মোহনকে টাকা দিতে দেরি হলে গায়ে হাত তোলাসহ সীমার বোনের মাধ্যমে তাকে ইতালিতে নেয়ার জন্যে অনেক ঝামেলা করে।
বাবার বাড়ি বেড়াতে আসলে মোহন ফোন করে জানায় ব্যবসার জন্যে যেনো এক লাখ টাকা নিয়ে আসে। সীমা তার মাকে বললো। মা বললো, তোর শ্বশুর বাড়িতে তো ভালোই অবস্থা, কতো বড়ো বাড়ি, ব্যবসা তাহলে মোহন কেনো তোকে এতো টাকার জন্যে চাপ দেয়?
সমস্ত বিষয়ে খুলে বলে সীমা তার মাকে। মা সবশুনে বললো, কেনো আমাকে আগে জানালি না এসব। এই বাচ্চাটা নেয়ার কি দরকার ছিলো? আমি তো সেদিন বাড়ি আর ব্যবসার কথা শুনে পালাতে দিয়েছিলাম। এমন জানলে তো পরের বারই রেখে দিতাম।
মা, বাড়ির লোভে তুমি আমার জীবনটাকে নিয়ে এমন করলে?
হ্যাঁ করেছি। তোর ভাসুরের বাড়ি বলে ওই বাড়ি তোকে ছাড়তে হয়েছে। শ্বশুরের বাড়ি হলে তো ছাড়তে হতো না। মোহনের সাথে কথা বলার দরকার নেই। এখন থেকে আমি যা বলবো তাই শুনবি।
কিছুদিন পর সীমার সেজো খালা ওদের বাড়িতে বেড়াতে আসলো। সীমার মায়ের কাছ থেকে সীমার জীবনের সব কথা শুনলো। এমনিতেও সীমার পরিষ্কার কাজের গুণ দেখে সীমাকে পছন্দ তার। সেই সুযোগে তিনি সীমার মাকে বললো সীমাকে আর ওখানে দেয়ার দরকার নেই। ওনার মেজো ছেলের জন্যে তিনি সীমাকে নিতে চান। সাভার তাদের জমি, বাড়ি কোনো কিছুর অভাব নেই। সব কিছুতেই সীমা সমান ভাগ পাবে।
কিছুদিনের মাথায় মোহনকে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে একরকম জোর করে মেয়েকে সাথে নেয়ার শর্তে খালাতো ভাই রাহুলের সাথে সীমার বিয়ে দিলো তার মা।
সাভারের শহরে বড় একটি জমিতে টিনসেডের বাড়ি রাহুলদের। পাশে বড় গরুর গোয়াল, তার পাশেই হাঁস, মুরগীর খামার। রাহুলের বড় ভাই তার স্ত্রীকে নিয়ে তার শ্বশুরবাড়িতে থাকে। প্রথমবার একই অফিসের সহকর্মীর সাথে ভালোবেসে বিয়ে করেছে রাহুল। রাহুলদের বাড়ির গরু, হাঁস, মুরগীর সেবা করে চাকরি করতে সমস্যা হচ্ছিলো বলে প্রথম পক্ষ রাহুলকে ছেড়েছে। বিয়ের কিছুদিন পর সীমার ক্ষেত্রেও তাই হলো। সবটা নিরবে সয়ে যাচ্ছে সীমা। তারপরও মেয়ের খরচের জন্যে তার খালা তাকে নানা কথা শুনাতো। বাচ্চাটাকে নিষেধ করতো রাহুলকে বাবা না ডাকতে। কিছুদিনের মধ্যেই সীমার শরীর খুবই খারাপ হতে লাগলো। ডাক্তার সীমার পেটে অপারেশন করতে বললো। সীমার মা এবং রাহুলের মাধ্যমে সীমার অপারেশন হলো।
এদিকে সীমার খালা প্রায়ই সীমার প্রথম ঘরের মেয়েকে নিয়ে খোটা দিয়ে কথা শোনাতো। একদিন সীমা বলেই দিলো, সবটা জেনে-শুনেই তো আপনার ছেলের জন্যে আমাকে এনেছেন। তাহলে এখন কেনো কথা শোনাচ্ছেন?
এনেছিতো আমার বাড়ির গোয়াল ঘরে কাজ করাতে। এখনতো অপারেশন হয়ে ঘরে বসে আছো। তোমাদের মা-মেয়ের খাওয়ার খরচটা কে দিবে? রাহুলের রোজগার কম। আমার বাড়ির কাজ ধরতে হবে। তোমার মাকে বলো, রাহুলকে ইতালি পাঠানোর ব্যবস্থা করতে।
সীমা কেঁদে মাকে সব বললো। লোকসমাজে মুখ দেখাতে পারবে না বলে বড় মেয়ের সাথে কথা বলে রাহুলকে ইতালিতে পাঠানো হলো। কিছুদিন সীমার জীবন ভালো কাটলেও হঠাৎ রাহুল সীমাকে ডিভোর্স পাঠালো। কারণ হিসেবে বলা হলো, সে তার প্রথমপক্ষ, তার ভালোবাসার মানুষের সাথে নতুন করে আবার জীবন শুরু করতে চায়। আর তাছাড়া সীমার মতো গ্রামের কাজ করা একটা মেয়ের সাথে তার মোটেই যায় না।
কয়েক মাস ধরে সীমা বাবার বাড়িতে আছে। তার মেয়েটির বয়স তিন বছর হয়ে গেছে। সীমার অগোচরে ওর মা ওর বিয়ে নিয়ে অনেকের সাথেই কথা বলে। সীমা সবটাই বুঝতে পারে। একদিন সীমার মা সীমাকে বললো,
দেখ্ সীমা, এখনো তোর বয়স কম। সারাজীবন তো একা কাটিয়ে দিতে পারবি না। তাই আমি আবার তোর বিয়ে দিতে চাইছি। তুই অমত করিস্ না। রাতে ছেলে পক্ষ তোকে দেখতে আসবে। আশা করি, তোর কোনো আপত্তি থাকবে না।
সীমার মা যখন মেহমানদের জন্যে খাবার তৈরি করতে ব্যস্ত, তখন সীমা ওর আর মেয়ের প্রয়োজনীয় পরিচয়পত্র ও জিনিসপত্র নিয়ে পেছনের দরজা খুলে বেরিয়ে পড়লো নতুন ঠিকানর উদ্দেশ্য। মায়ের উদ্দেশ্য একটি চিঠি লিখে গেলো সীমা-
মা,
চৌদ্দ বছর বয়সে যখন আমি ভুল পথে পা বাড়িয়েছিলাম, তখন তুমি আমার ভুলটা শুধরে না দিয়ে ভুল পথে যেতেই পথ দেখিয়েছ আমায়। মোহন আমাকে ভালোবেসেছে কি না জানি না তবে জেনেছি আমাকে বিয়ে করার পেছনে তার উদ্দেশ্য ছিলো তোমাদের দেয়া অর্থে জীবন কাটানো। আর আমাকে ভুল পথে চালিত করতে তোমার উদ্দেশ্য ছিলো টাকা আর শহরে বাড়ির মালিকের কাছে আমাকে বিয়ে দেয়া। দ্বিতীয় বারও তোমার লোভের কাছে আমি হেরেছি। তোমার বোন আমাকে তার ছেলের বউ করেছে, আমাকে তার বাড়ির চাকরাণী করে রাখার জন্যে। আর রাহুল আমাকে বিয়ে করেছে ইতালিতে যাওয়ার জন্যে। মা তুমি কেবল অর্থ চেয়েছো, আমার শান্তি চাওনি। আর ওরা আমাকে ব্যবহার করেছে ওদের নিছক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্যে। কিন্তু আর নয় মা, আর আমি তোমার কথা রাখতে তৃতীয়বার ভুল করবো না। আমার জীবনের তৃতীয় অধ্যায় রচনা করবো শুধুই আমি। আমাদের মা-মেয়ের মাঝে তৃতীয় কেউ থাকবে না। আমার জীবন-জগতে থাকবো কেবল ‘আমার আমি’।