প্রকাশ : ১২ মার্চ ২০২২, ০০:০০
মধুমতি নদীর কোলঘেঁষে গড়ে উঠা বিল-ঝিল আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য শোভায় সুশোভিত ধানের দেশ গোপালগঞ্জ জেলা। যেখানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর সুযোগ্য কন্যা মমতাময়ী শেখ হাসিনার পিতৃভূমি। জন্মেছেন কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য। রয়েছে নানা ইতিহাস-ঐতিহ্য ও দর্শনীয় স্থান। সেই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতেই গত ঊনত্রিশ জানুয়ারি থেকে দুই ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত স্বপরিবারে বেড়িয়ে এলাম গোপালগঞ্জের ফলসীপাড়ায়। ভ্রমণের ইচ্ছে না থাকা সত্বেও পরিবারের সকলের পীড়াপিড়িতে এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে অবশেষে ঘুরে এলাম ধান-খ্যাত জেলা গোপালগঞ্জে।
গত ঊনত্রিশ জানুয়ারি শনিবার সকাল নয়টা ত্রিশ মিনিটে চাঁদপুর শহরের বঙ্গবন্ধু সড়ক এলাকা থেকে কালো রংয়ের মাইক্রো গাড়িটি আমাদের বহন করে শোঁ শোঁ করে ছুটে চললো হরিণা ফেরিঘাটের দিকে। প্রায় দেড়ঘণ্টা সময় নিয়ে ফেরিটি ঘাটে ভিড়ার কথা থাকলেও ওপর প্রান্তের ঘাটে অন্য দুটি ফেরি বিড়ম্বনায় আড়াই ঘণ্টা পর আমাদের বহনকৃত ফেরিটিকে নদীর ওপারে আলুরবাজার ঘাট থেকে বিদায় জানালাম। তারপর সেখান থেকে খানাখন্দের বেহাল সড়ক দিয়ে প্রায় ৪০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিলাম ধূলোবালি আর লংকর-ঝংক্কর জার্নিংকে। শরিয়তপুরের রাস্তার সীমানা পেরোতেই মাদারীপুর, খুলনা যাওয়ার মহাসড়ক দিয়ে গাড়িটি শোঁ শোঁ করে ছুটে চললো গোপালগঞ্জের দিকে।
দীর্ঘ ৮ ঘণ্টার জার্নিংকে গাড়িতে সবাই অস্থির। কয়েকজন বমিও করলো। কিছুটা হাফ ছাড়তে মাদারীপুরের একটি বাজারে খানিক সময়ের জন্যে গাড়িটি থামালাম। সেখানে গোল গোলা, পুরি এবং মাদারীপুরের দধিসহ নানা কিছু খেয়ে বিশ মিনিটের বিরতি নিয়ে আবারো ছুটে চললাম গোপালগঞ্জের উদ্দেশ্যে। গাড়ি চলছে তো চলছেই। কিছুতেই যেনো রাস্তা ফুরাচ্ছে না। টানা জার্নিংকে সবাই অস্থির। কিছু দূর যেতেই ‘আছমত আলী খান সেতু’ আর সড়কের সুন্দর দৃশ্যে মন ভরে গেলো। মৃসণ পিচঢালাইয়ের সড়কে গাড়িটি অনেক গতিবেগ নিয়ে ছুটে চললো। অল্প সময়ে পথ পাড়ি দিতে টেকেরহাট হয়ে একটি শাখা রাস্তায় ঢুকে পড়লাম। পথ যেনো ফুরাচ্ছে না। কয়েক মাইল পর পর পথচারীদের জিজ্ঞাসা-গোপালগঞ্জ ফলসী বাজার আর কতটুকু? সবাইর একই উত্তর আরো সামনে। এভাবে জিজ্ঞাসা করে এগুতে এগুতে আরো দুই ঘণ্টার পথ পাড়ি দিলাম। সাপের চলার মতো আঁকা-বাঁকা পথ আমাদের যেনো নাগরদোলায় ঘুরাচ্ছে। সবাই ক্লান্ত, অস্থির। কখন কাক্সিক্ষত গন্তব্যে পৌঁছাবো। কিছুক্ষণ পর পর মামা শ^শুরের ফোন তোমারা এখন কোথায়, কতটুকু এসেছো। এইতো মামা অমুক জায়গায়, তমুক স্থানে বলে উত্তর দিই। সবশেষে বললাম, আমরা এখন কাঁশিয়ানি এলাকায়। মামা বললো ঠিক আছে সামনে এগুতে থাকো। আরো বিশ-পঁচিশ মিনিটের পথ পাড়ি দিলেই তোমরা ফলসীবাজারে পৌঁছে যাবে। তার কিছুক্ষণ পরেই একটি ছোট্ট ব্রীজ পার হতেই মামাকে দেখে সবার ক্লান্তমুখে এক টুকুরো স্বস্তির হাসি ফুটে উঠলো। তখন বিকেল পৌনে পাঁচটা।
মাইক্রো থেকে সবাই এক এক করে নেমে বাড়িতে ঢুকে পড়লাম। যাওয়ার আগে ভেবেছিলাম বেড়ানোর স্থানটি হয়তো গোপালগঞ্জ জেলা শহরেই হবে। কিন্তু যখন মাইক্রো থেকে নেমে কাঁচা রাস্তা দিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম তখন মনে হলো সেটি একেবারেই একটি অজোপাড়া গ্রাম। মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেলো। একবার ভাবলাম ওই মাইক্রোতে করেই পুনরায় চাঁদপুরে চলে আসি। সবার কথা ভেবে পরে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে থেকে গেলাম। ফ্রেশ হয়ে দুপুরের খাবার বিকেলে খাওয়া হলো। প্রথমেই দৃষ্টি কেড়ে নিলো ঘরের পাশে থাকা খেজুর গাছে পাতা রস সংগ্রহের হাঁড়ির দিকে। এমন দৃশ্য দেখে আর দেরি নয়, মামাকে বলে গাছ থেকে হাঁড়ি নামিয়ে কাঁচা রস খেলাম। দীর্ঘ ২৪/২৫ বছর পরে যেনো সেই ছেলে বেলায় চুরি করে রস খাওয়ার শখ মিটিয়ে সুখের অনুভূতি ফিরে পেলাম। এরপর চারদিকে বিল আর ফসলী জমির প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে নয়ন জুড়িয়ে গেলো। মনটা ধীরে ধীরে ভালো হতে লাগলো। গায়ের এমন মনোমগ্ধকর দৃশ্য প্রকৃতিপ্রেমী যে কারোই ভালো লাগার কথা।
প্রথম দিন পার করে দ্বিতীয় দিন শ্যালক জীবন, শিহাব ও ফয়সাল নামের এক জামাইকে নিয়ে মোট চারজন মিলে টুঙ্গিপাড়ার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। অটোবাইকে করে শাখা রাস্তা পেরিয়ে মহাসড়কে উঠতেই চোখ জুড়িয়ে গেলো। চল্লিশ ফুট চড়া রাস্তার দুপাশে সারি সারি গাছে তিন ফুটের সাদা চুনায় যেনো গাছগাছালি হেসে রয়েছে। তার পাশেই বিশাল বিশাল ফসলী ক্ষেত। শোভা পাচ্ছে নানা জাতের ফসল। ফসলী জমির ফাঁকে ফাঁকে বড় বড় তাল গাছ দাঁড়িয়ে। দেখলে মনে হয় গোপালগঞ্জ জেলাটি যেনো তাল গাছের জন্য বিখ্যাত। সব কটি স্থানে ফসলী জমিতে তাল গাছ দেখে কবিতার দুটি লাইন মনে পড়ে যায়Ñতালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে সব গাছ ছাড়িয়ে...।
প্রাকৃতিক এমন দৃশ্য দেখে সত্যি মন জুড়িয়ে গেলো। চোখ জুড়ানো এমন প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে কয়েকটি দেশের গান গাইতে লাগলাম।
অটোবাইক চলছে তো চলছেই। পিচ ঢালাইয়ের বিশাল সড়কটির কোথাও কোন গর্ত নেই। খুবই চমৎকার একটি সড়ক। এ সড়ক দিয়েই প্রতিদিন ঢাকা, খুলনাসহ বিভিন্ন অঞ্চলের বাস চলাচল করে থাকে। শুধু এই মহাসড়কটিই নয়, দু-একটি প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল ছাড়া গোপালগঞ্জের প্রায় সব কটি সড়কই যানবাহন চলাচলের জন্যে চমৎকার উপযোগী। অটোবাইকে করে দেড়ঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়ে খানিকটা সময় চা-বিরতি দিলাম। এই সুযোগে দেখা হলো গোপালগঞ্জের দৃষ্টিনন্দিত নির্মাণাধীন প্রধান পৌঁর ঈদগা। সেখানে পকেট থেকে মোবাইল বের করে ক্যামেরা অন করে কয়েকটি ক্লিক দিয়ে দৃষ্টিনন্দিত ঈদগাটির ছবি সংগ্রহ করে রাখলাম। চা-বিরতি শেষে আবারো কচ্ছপগতিতে টুঙ্গিপাড়ার দিকে ছুটে চললো অটোবাইক। এক ঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়ে অবশেষে পৌঁছে গেলাম কাক্সিক্ষত গন্তব্যস্থান টুঙ্গিপাড়ার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিস্থলে। আমরা এক নাম্বার গেটের কাছে গিয়ে গাড়ি থামালাম। খুবই মনোমুগ্ধকর একটি এলকা। গেটের দু পাশের দেয়ালের সামনের অংশে শোভা পাচ্ছে হলুদ রঙ্গের গন্ধরাজসহ বাহারী রঙের ফুল। তার বিপরীত পাশে পার্কের মতো দর্শনার্থীদের বসার স্থান। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন সড়কের পিচ ঢালাই। দুপুরের শেষলগ্নের আবহাওয়ায় ছবির মতো চমৎকার রূপে ফুটে উঠেছে সমাধিস্থলের আঙ্গিনাটি। এতো সুন্দর পরিবেশ দেখে আর লোভ সামলানো গেলো না। সবাই মিলে নানা রঙ্গে-ঢঙ্গে ইচ্ছেমতো ছবি তুললাম। বাহিরের অংশে ছবির তোলার শখ মিটিয়ে গেটের কাছে যেতেই আনসার-বিডিপির সদস্যদের কাছে জানতে পারি করোনার কারণে দুদিন আগে থেকেই দর্শনার্থীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অনেক অনুরোধ করেও ভেতরে ঢুকার অনুমতি পেলাম না। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ। কাউকেই ভেতরে ঢুকানো যাবে না। মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেলো। তিনটি জেলা পেরিয়ে চাঁদপুর থেকে গোপালগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী যে দর্শনীয় স্থানটি দেখতে গেয়েছিলাম। দুর্ভাগ্যবশত তা আর দেখা হলো না। অন্যদের মতো আমাদেরকেও ব্যর্থ মনে ফিরতে হলো সেখান থেকে। তার পাশেই রয়েছে ‘শেখ রাসেল শিশু পার্ক’ করোনার কারণে সেটিও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। আমার মতো ব্যর্থ হয়ে পঞ্চগড়, বরিশাল, লালমণিরহাটসহ বহু দূর-দুরান্ত বিভিন্ন জেলা থেকে আসা দর্শনার্থীরা ফিরে গেছেন। ফলসীরহাট বাজারের উদ্দেশ্যে পুনরায় সবাই অটোবাইকে চড়ে বসলাম। সেখান থেকে ব্যর্থ হয়ে ফিরলেও সড়কের দুপাশে থাকা গাছগাছালি, ধান ক্ষেতের প্রার্কতিক সৌন্দর্য আর সড়ক দিয়ে ভ্যানে করে যাত্রীদের যাতায়াতের দৃশ্যগুলো দারুণভাবে মুগ্ধ করেছে। আমাদের এখানে যেমন বিভিন্ন স্থানে যাতায়াতের জন্যে রিকশায় চড়া হয়। কিন্তু সেখানে ছোট যানবাহন হিসেবে তিন চাকার ভ্যান গাড়িটিই ওই জেলার ঐতিহ্য। একটি ভ্যানে করে নারী-পুরুষ মিলে প্রায় ৫/৬ জন যাত্রী একসাথে যাতায়াত করে থাকেন। ভ্যানে চড়ার এমন দৃশ্য দেখতে বেশ ভালোই লাগছিলো।
টুঙ্গিপাড়া থেকে ব্যর্থ মনে ফেরার পথে রেল স্টেশন, রেললাইন এবং প্রকৃতির সবুজ ছায়ায় বিরতির ফাঁকে ফাঁকে ছবি তোলা। তারপর সোজা ফলসীর হাট বাজার। অটোবাইক থামাতেই গ্রামের ঐতিহ্যবাহী চমৎকার দৃশ্যটি নজর কেড়ে নিলো। ফলসীরহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠজুড়ে হাট বসেছে। সবাই পৃথক পৃথকভাবে চটি বিছিয়ে বিভিন্ন তরি-তরকারি, ফল-ফলাদী, ভাঁজাপুরি বিক্রি করছেন। একপাশে বসেছে মাছের বাজার। ব্যবসায়ীদের থালা এবং পাতিলে শোভা পাচ্ছে দেশীয় প্রজাতির মাছ। হাটের এমন দৃশ্যটি যেনো সেই ছোট বেলায় বইতে গল্পের সাথে আঁকা সংযুক্ত ছবির মতো মনে হলো। বেশ কিছুক্ষণ ঘুরে ঘুরে দেখলাম। প্রতি সপ্তাহের শুক্রবার এবং সোমবার এই হাট বসে। ভালো লাগা থেকে আমিও কিছু কিনে নিলাম। গৌধূলীর লগ্নে বাড়িতে গিয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে কিছুক্ষণ নিরবতায় ডুবে গেলাম।
গ্রামের নামটি ফলসী গ্রাম। ফসল শব্দের সাথে একটা দারুন মিল রয়েছে। তাই হয়তো সেই গ্রামে বেশির ভাগ জমিতে ফসল বুঁনা হয়। মামার বাড়িতে গিয়ে গাছ থেকে আধাপাকা বড়ই ফল পেরে মরিচের গুঁড়ো আর লবণ মিশিয়ে বেশ মজা করে খেলাম। জিহ্বায় জল এসে পড়েছে। ঝালে লাল হয়ে হাফ ছাড়তে ছোট, ছোট ফসলের গাছের ফাঁকে পা বাড়িয়ে ক্ষেতের আইল বেয়ে বিলের মাঝপ্রান্তে দাঁড়িয়ে কালোজিরা এবং সরিষা ফুলের সুভাসে মুগ্ধতা ছড়িয়ে দিলো। বাতাসে দোলা খায় সরিষা ফুল, মৌমাছিরা উড়ে উড়ে মধু সংগ্রহ করছে, একই সাথে চাষকৃত কালোজিরা গাছে ফুলের হাসিতে ভ্রোমরার পরশ ছুয়ে যায়।
তার পর সকাল এগারোটায় ফয়সাল ভাইকে সাথে করে তিন চাকার ভ্যান গাড়ি ভাড়া নিয়ে কাশিয়ানি উপজেলার বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখলাম। যাবার বেলায় ফয়সাল ভাই এবং ভ্যান চালক একটি মোড় দেখিয়ে আমার উদ্দেশ্যে বললো, এই জায়গাটির নাম দাড়োগার মোড়। বললাম কেনো এই নাম রাখা হলো। তারা জানালেন একসময় এক দাড়োগা সেখানে আসামী ধরতে গিয়ে গাড়ি উল্টো পড়ে যায়। তারপর থেকেই সেই জায়গাটিকে মানুষ দাড়োগার মোড় নামে চিনেন। ওইদিন দিনটি ফলসী গ্রামেই ঘুরে ফিরে কাটালাম। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হতেই চা এবং হালকা কিছু খাওয়ার পর সবাই গল্পে কথার আড্ডা জমালাম। একসময় আমার জেঠস, শালী, খালা শাশুড়ি, মামী শাশুড়িসহ সবাই বায়না ধরলের আমার হাতে রান্না করা আলুর দম (আলুর চপ) খাবে। তারা সবাই বিভিন্ন কথা বলে আমাকে খেপিয়ে তুললো। তাদের কথায় নিজের গুণ দেখাতে আমিও আর দেরি না করে খাটের নিচ থেকে প্রায় ৮ কেজি আলু বের করে কেটে মাটির চুলায় বসালাম। চুলার আগুনের আলোতে প্রায় চল্লিশ মিনিট সময় নিয়ে আলু সিদ্ধ করে আলুর দম পাকালাম। গরম আলুর দমের সাথে দেশি ধনিয়া পাতা দিয়ে বড় পাত্রতে ঢেলে সবার সামনে দিতেই সবাই খুব মজা করে খেলো। তৈরি করা খাবার পেয়ে সবাই আমার নানামুখী প্রসংশার বাণী শোনালেন। তারপর সবাই চেয়ার খেলা এবং বালিশ-খেলার আয়োজনে উঠোনে চেয়ার সাজালেন। আমাদের হাসি-ঠাট্টার শব্দ শুনে বাড়ির পাড়া-প্রতিবেশীরা এসেও ভিড় জমিয়েছেন। তারা সবাই খেলা উপভোগ করার অপেক্ষায়। প্রথমে চেয়ার খেলা শুরু হলো। যে গান বাজাচ্ছিলো তাকে ঈঙ্গিত করে মজা করে বললাম, যখন আমি চেয়ারের কাছাকাছি বা সামনে থাকবো তখন তুমি গানটা বন্ধ করে দিও। এভাবে খুব হাসি আনন্দে আমরা দুটি খেলা শেষ করলাম। চেয়ার খেলায় আমি বিজয়ী হলেও বালিশ খেলায় সকলের ষড়যন্ত্রে তৃতীয় হয়েছি।
পরদিন হঠাৎ মামা শ^শুরের অসুস্থায় সকলের মনটা কিছুটা খারাপ হয়ে গেলো। তারপর ঔষধ খাইয়ে মামা কিছুটা সুস্থ করা হলো। ওইদিন রাতেই পুকুর সেচের জন্য মামা লোক ঠিক করে পুকুরে সেচ মেশিন লাগালেন। দুটি পুকুর সেচা হলে পুকুরের তরতাজা নানা জাতের জিয়ল মাছ ধরবো, সে শখের দীর্ঘ অপেক্ষা। কিন্তু পুকুরের গভীরতা বেশি হওয়ায় পানি যেনো কমছেই না। রাত শেষে ভোর হলো। তখনো ঘট ঘট শব্দে চলছিলো ছোট্ট সেচ মেশিন। আমাদের বেড়ানোর সময়সীমা পাঁচদিন অতিবাহিত হওয়ায় আর অপেক্ষা নয়। পরদিন সকালেই আমাদের চাঁদপুর ফেরার পালা। পুকুর সেচের অপেক্ষায় থাকলে আর ওইদিন চাঁদপুরে ফেরা হবে না। তাই সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই হালকা চা নাস্তা সেরে সবকিছু গুছিয়ে একই রঙ্গের মাইক্রোবাসে করে চাঁদপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। গোপালগঞ্জের মসৃণ পিচঢালাইয়ে মহাসড়ক দিয়ে শোঁ শোঁ করে মাইক্রোবাস ছুটে চললো শরীতপুরের দিকে। এক-দেড়ঘণ্টার পথ পাড়ি দিতেই চার লাইনের দৃষ্টিনন্দিত সড়কের দৃশ্য দেখে মন জুড়িয়ে গেলো। কি চমৎকার দৃশ্য। চারটি লাইনের সড়ক যেনো এক বিনোদন কেন্দ্র। সড়কের দুপাশে সবুজে ঘেরা গাছগাছালি। দুর্ঘটনারোধে স্টীলের অ্যাঙ্গেল দিয়ে বেড়িকেট দেয়া হয়েছে। মাঝে মাঝে হালকা বাঁক। মসৃণ পিচঢালাইয়ের ফাঁকে ফাঁকে সাদা রঙ্গের প্রলেপ যেনো মহাসড়কটিকে আরো ফুটিয়ে তুলেছে। যত দূর গাড়ি চলছে ততোদূর মুগ্ধতা ছুঁয়ে গেছে। সড়কটি দেখে মনে হলো সড়কের এমন সুন্দর দৃশ্যের স্থানটি তো টিভি নাটকে দেখেছি। সত্যি ভীষণ ভালো লাগলো। সড়কের এমন দৃশ্য দেখে তড়িগড়ি করে পকেট থেকে মোবাইল বের করে খানিকটা সময় লাইভ করলাম। তারপর কিছুক্ষণ ভিডিও ধারণ করে রাখলাম। প্রায় পাঁচ ঘণ্টা সময় পাড়ি দিয়ে বিকেল সাড়ে তিনটার মধ্যে অবশেষে আমরা পৌঁছে গেলাম আলুরবাজার ফেরিঘাটে। সবাই এক এক করে মাইক্রো থেকে নেমে টানা পাঁচ ঘণ্টার ক্লান্তি দূর করার চেষ্টা। এর ফাঁকে টুকরিতে করে পনেরো বছরের একটি ছেলেকে তাজা সবুজ রঙের কলির শাক সাজিয়ে রাখতে দেখে, দাম জিজ্ঞেস করে একশ’ টাকা দিয়ে দুই কেজি কলির শাক ক্রয় করে নিলাম। প্রথমে ভেবেছি ফেরিতে করে মেঘনা পাড়ি দিয়ে হরিণাঘাট থেকে সিএনজি অটোরিকশা করে বাড়ি যাবো। মুহূর্তেই শ্যালক শিহাব এসে বললো- ভাইয়া ঘাটে কোন ট্রলার নেই। তবে এক্ষুণি বোগদাদীয়া লঞ্চটি ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাবে। সেটি চাঁদপুর ঘাটেও ভিড়বে। তার কথা শুনে আর দেরি নয়, সবাই দ্রুত পায়ে হেঁটে লঞ্চে উঠে পড়লাম। আমাদের নিয়েই লঞ্চটি ছেড়ে দিলো। মাত্র চল্লিশ মিনিটে বোগদাদীয়া লঞ্চটি চাঁদপুর লঞ্চ ঘাটে এসে পৌঁছলো। সেখান থেকে অটোবাইকে করে ক্যাফে কর্ণারের সামনে নেমে সবাই দুপুরের খাবার সেরে নিলাম। খাবার খেয়ে যে যার গন্তব্যের উদ্দেশ্যে বিদায় নিলো। আমরাও একটি অটোবাইকে করে চাঁদপুর শহরের বঙ্গবন্ধু সড়ক হাজী বাড়ি মসজিদের সামনে এসে নামলাম। এভাবেই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা ধানখ্যাত জেলায় ছয়দিন ভ্রমণ করা হলো।
উল্লেখ্য, গোপালগঞ্জ, বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ যেনো একই সুতোয় কয়েকটি ফুল নিয়ে গাঁথা একটি মালা। ইতিহাস-ঐতিহ্য, বিল-ঝিল আর প্রাকৃতিক শোভায় সুশোভিত এই গোপালগঞ্জ জেলায় যে সকল দর্শনীয় স্থান রয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্যÑটুঙ্গিপাড়ায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধি, ওড়াকান্দি ঠাকুর বাড়ি, জমিদার গিরীশ চন্দ্র সেনের বাড়ি, অন্যন্যা চন্দ্র ঘাট, বধ্যভূমি স্মৃতি সৌধ, বিলরুট ক্যানেল, উলপুর জমিদার বাড়ি, মধুমতি বাওড় ও সখীচরণ রায়ের বাড়ি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।