সোমবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২৪  |   ১৭ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ০৫ মার্চ ২০২২, ০০:০০

অন্য কেউ
তুহিনা আক্তার সাথী

দুদিন ধরে সুরমা পেটের যন্ত্রণায় কষ্ট পাচ্ছে। মনে হচ্ছে, বাচ্চাটা একেবারে তলপেটে চলে এসেছে। শাশুড়িকে বলার পরেও তিনি টুঁ-শব্দটি পর্যন্ত করছে না। বাবার বাড়ির আর্থিক অবস্থা খারাপ বলে তারাও এই বাড়িতে আসতে পারছেন না। শেষ রাতের দিকে যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করলো সুরমা। শাশুড়ি মুখ বেঁকে দরজার সামনে এসে বললো, জন্ম দিবে তো কন্যাসন্তান, তা চেঁচিয়ে লোক শোনানোর কি দরকার আছে!

কই রে ছোট, দাইয়ের বাড়িতে খবর পাঠা। আসতে না চাইলে বলবি, মা বলেছে, বকশিস বেশি করে দিবে। না হলে তো একজন চেঁচিয়ে পাড়ার লোক জড়ো করবে।

সুরমার ছোট ননদ, ভোরের দিকে দাইকে নিয়ে বাড়ি আসলো। বৃদ্ধ মহিলা ঘরে ঢুকে জিজ্ঞেস করলো, কই রে মা, তুই কোন্ দিকে? উপরে না নিচে।

পেট চেপে ধরে সুরমা বললো, আমি নিচেই আছি, আপনি দেখতে পান না?

বয়স হয়েছে তো মা, তাই একটু কম দেখি। তুই চিন্তা করিস্ না, তোর বাচ্চা আমি ঠিকঠাক বের করবো। অনেক বছর ধরে করছি তো। ফজরের আজানের সাথে সাথে বাচ্চার কান্নার শব্দ শুনতে পেলো সুরমা। দুদিন ধরে যন্ত্রণার সাথে লড়াই করে জয়ী হয়েছে সে। একেবারেই পাতলা লাগছে নিজেকে। বৃদ্ধ মহিলা ঠিকমতো দেখতে পায় না বলে নিজের নাড়ি থেকে নিজেই আলাদা করেছে সন্তানকে।

একা একাই সন্তানের পরিচর্যা করছে সুরমা। গায়ে তেল মাখা, শরীর মুছে দেওয়া। কাপড় পরিষ্কার করাসহ সব। সুরমার স্বামী বিদেশ থেকে ফোন করে সন্তানের খোঁজখবর রাখছে, তার মায়ের মাধ্যমে। সপ্তাহখানেক পর সুরমা বাচ্চাকে গোসল করাতে উঠোনে বসলো। অদ্ভুত রকমের একটা লাগলো সুরমার কাছে। কবিরাজ মশাই তো বলেছে তার মেয়ে বাচ্চা হবে!

ধবধবে ফর্সা বাচ্চাটাকে দেখে সুরমার ছোট ননদ বাচ্চাটার কাছে আসতে নিলেই, সুরমা সাথে সাথে কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখে বাচ্চার শরীরের নিচের অংশ। তারপর বললো, মা দেখলে তোমাকে বকবে।

বকুক না। মেয়ে বলেও কি মানুষ না। ও তো আমারই ভাইয়ের মেয়ে। আমি তো ওকে কোলে নেবোই!

নেবে তো, আগে তো ওর শরীর মুছে জামা পরাই, তারপর।

ঠিক আছে, তুমি তাড়াতাড়ি করো। আমার তর সইছে না। তাছাড়া একটু পর মা চলে আসবে। বুঝি না ভাবি? একটা ছেলে বাচ্চার জন্যে মা তোমার সাথে এমন করতে পারলো? তুমি তো জোর করে মেয়ে আনোনি! সব তো সৃষ্টিকর্তা করেছে। অথচ ভাই কিছু বলেনি। সে তো মাকে বলেছে, তার মেয়ের যেনো অযতœ না হয়। সেজন্যেই মা নিজে না দেখলে ও অন্যকে দিয়ে সবটা ঠিক রেখেছে। তবে তুমি চিন্তা করো না ভাবি, মেয়ে তোমার যা সুন্দরী হয়েছে না, মা তো বেশিক্ষু রাগ করে থাকতেই পারবে না।

হঠাৎই ঢাকের শব্দে বাড়ির সামনে তাকালো সুরমা। ওরা চারজন এসেছে। একজন গলার সাথে ছোট একটা ঢাক ঝুলিয়ে বাজাচ্ছে, একজন গান গাইছে, একজন নাচছে, আর বয়সে সবার থেকে বড়জন দু হাতে তালি বাজিয়ে বাচ্চার মা, দাদিকে ডেকে বকশিস চাইছে। খালি পায়ে, অদ্ভুত রকমের সাজ তাদের। বুক, পেট আধখোলা রেখে শাড়ি পরা, কানে, গলায়, হাতে, কোমরে অলংকারের অভাব নেই। আর কপালে লালটিপসহ মুখভর্তি সাজ। পুরুষালী কণ্ঠে ডেকে যাচ্ছে তারা। সুরমার ছোট ননদ ওদের দেখে ভয়ে ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলো। আর জানালা দিয়ে চেঁচিয়ে বলতে লাগলো,

মা বাড়ি নেই, ওরা তো আমাদের মেয়েটিকে নিয়ে যাবে। তোমরা কেউ এসে মেয়েটাকে বাঁচাও। ওর চেচানি শুনে পাশের বাড়ির এক লোক এলো এই বাড়িতে। আর বললো, ও তাহলে তোরা এই বাড়িতেও চলে এলি চাঁদাবাজি করতে? বাড়িতে এখন কেউ নেই। চলে যা তোরা। অন্য সময়ে আসবি।

লোকটাকে দেখে গলায় ঢাক ঝুলানো মেয়েটা বললো, তাতে তোর কিরে, তোর মতো কিপটে পুরুষ তো জীবনেও দেখি না। কোনো দিন তো তোর দোকানে গেলে, পাঁচ টাকার উপরে দেসনি। এখন এসেছিস্ নাক গলাতে। ভালোয় ভালোয় কেটে পর, না হলে তো বুঝবি এখন। মেয়েটা নিজের পরনের পোশাকে হাত দিতেই লোকটা চলে গেলো। সুরমা তখনও বাচ্চাকে নিয়ে উঠোনে দাঁড়ানো। বকশিস চাওয়া মহিলা সুরমাকে বললো,

ভয় পাসনে লো, আমরা জন্তু, জানোয়ার না, আমরা মানুষ। কয়েক গ্রামে আমরা চারজন মাত্র। তোরা হাজার হাজার মানুষ। তারপরও কেনো আমাদেরকে ভয় পাস?

দেখি, তোর বাচ্চাকে একবার কোলে নেই। সুরমা দিতে চাইলো না।

মহিলা বললো, আমরা মানুষ, আদম সন্তান আমরা। আমাদেরও মন আছে। কি করমু বল, আল্লায় বানাইছে আমাদেরকে সৃষ্টির শুরু থেকেই। সংসার নাই। বাপ-মা থাইকাও নাই। বাচ্চা নাই। তবু বাচ্চা দেখলে খুব আদর করতে মন চায়। কোলে লইতে মন চায়। আমাগোও তো এমন একটা বাচ্চা থাকতে পারতো। দে, লো দে, তোর বাচ্চাকে একবার কোলে নিমু বলে সুরমার কাছ থেকে টেনে কোলে নিয়ে নিলো। বাচ্চার নিচের অংশ ডেকে রাখা কাপড়টা সুরমার হাতেই রয়ে গেলো। মহিলা বাচ্চাটাকে আদর করে কথা বলতে থাকলো। বাকি তিনজন বসে কথা বলছিলো। হঠাৎই মেয়েটা বাচ্চাটার নিচের অংশ দেখে বললো, তোর বাচ্চা একেবারেই আমাদের মতোই হয়েছে রে। এতো আগলে রেখে কি হবে রে। এখনই আমাদের দিয়ে দে। আমরা পালন করে আমাদের মতো করে বড়ো করবো।

সুরমা দুই হাত জড়ো করে ধরে বললো, দোহাই আপনার, আর বলবেন না, আর যেনো কেউ জানতে না পারে, যা চাইবেন, তা-ই দেবো।

লুকিয়ে রেখে কি করবি। একদিন তো লোকে জানবেই। লুকিয়ে রেখে কি তুই বাচ্চাকে আলাদা জীবন দিতে পারবি? দেখিস্ না আমাদের পরিবার আমাদের পরিচয় দেয় না, খবর রাখে না। তুই কি তোর বাচ্চাকে সমাজে জায়গা দিতে পারবি? এই সমাজের নিয়ম বড় কঠিন রে। জায়গা দিবে না। দূর দূর করে তাড়িয়ে দিবে। হাসি-তামাশা-তিক্ততায় বিষিয়ে তুলবে জীবন। এই জীবন বড্ড বিস্বাদের।

পারবো! আমার সন্তানের জন্যে আমি সব করতে পারবো, বলে কানের দুল জোড়া খুলে মেয়েটার হাতে দিয়ে বাচ্চাকে নিয়ে ঘরে আসলো সুরমা।

দ্বীপালি, সেফালিকে জিজ্ঞেস করলো, হ্যাঁ রে সেফু আজ তো আমার কান্তা মায়ের বাড়ি আসার কথা। বেলা গড়াতে চললো, মেয়ে তো এখনও ফিরছে না।

গুরু আমি আর রুপালি গিয়ে রাস্তা পর্যন্ত দেইখা আসি?

হ্যাঁ, যা। সাথে অঞ্জলিরেও নিয়ে যা। খুব তাড়াতাড়ি তিনজনে কান্তা মারে লইয়া ফিরবি। আমি গিয়ে মেয়েটার জন্যে ভালো-মন্দ রান্না করি।

মাগরিবের কিছুক্ষণ আগে অঞ্জলি চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বাড়িতে ঢুকে বললো, গুরুমা আমাগো কান্তার সর্বনাশ হইয়া গেছে। তুমি সিগগির আহ।

কি কইলি বলে, দ্বীপালি, অঞ্জলির সাথে বাড়ির পাশের বাজারের কাছে জঙ্গলে গিয়ে দেখলো, আদরের একমাত্র মেয়ের বিধস্ত শরীরটা পড়ে আছে। কাছেই তার ছেঁড়া বোরকা, পোষাক, জুতা। শরীরের নি¤œাঙ্গ ভেজা তাজা রক্তে। দ্বীপালি দৌড়ে গিয়ে মেয়ের শরীর পোষাকে ঢেকে কেঁদে কেঁদে জানতে চাইলো, মা রে কি করে হলো তোর এই অবস্থা?

কান্তা মায়ের হাতটি ধরে বললো, মা ওরা অনেকজন ছিলো। মুখ রুমালে বাঁধা ছিলো। হেসে হেসে বলেছিলো, হিজড়ার মেয়ের আবার পর্দা, লেখাপড়া। তারা হিজড়ার শরীরের ভাঁজ দেখতে চেয়েছিলো। আর কিছু না বলেই দু চোখ বন্ধ করে নিয়েছে কান্তা।

সেই রাতে ওরা চারজন মিলে মসজিদের হুজুরের কাছে গেলো, কান্তার জানাজা আর দাফন, কাফনের জন্যে। হুজুর জানতে চেয়েছে, সে ছেলে নাকি মেয়ে?

দ্বীপালি জোর গলায় বলে, হুজুর আপনাদের সমাজের ছেলেদের দ্বারা জোরপূর্বক আমার সন্তান বলাৎকার হয়ে দুনিয়া ছেড়েছে। তারপরও আপনার জিজ্ঞেস?

কান্তার দাফন-কাফনের পর ওরা চারজন অনেক কাঁদলো গলাগলি করে। আল্লার কাছে বললো, হে আল্লাহ, তুমি আমাদের সৃষ্টি করেছো, না ছেলে, না মেয়ে হিসাবে। বাবা-মা কেউ আমাদের স্থান দেয় না। পরিচয় দিতে লজ্জা পায়। সমাজ, সংসার, সন্তান, আদর, ভালোবাসা ছাড়া স্বাদহীন জীবন আমাদের। লোকে দেখলে তিরস্কার করে, অভিসপ্ত বলে, হাসে, কেউ কেউ ভয়ে পালায়। এই জীবনে তুমি দিয়েছিলে কান্তাকে। এই সমাজের চিহ্নিত পুরুষদের তীক্ষè নজর আমার শিশুসুলভ কান্তার জীবন কেড়ে নিলো।

সুরমার শাশুড়ি সেদিন বাড়ি ফিরেনি। দ্বীপালির কথায় বারবার সন্তানের দিকে তাকাচ্ছে সে। কিছুতেই ঘুম আসছে না চোখে। শাশুড়ি তো তার মেয়েকেই মেনে নেয়নি। বাকিটা দেখলে তো সারা গ্রাম করে লোক জানিয়ে বাড়িছাড়া করবে তাকে। তাতে তার চিন্তা নেই, কিন্তু তার সন্তানের পরিচয় কি হবে? ভাবতে ভাবতে সকাল হলো। সুরমার ছোট ননদ এখনও ঘুমিয়ে আছে। একটু পর ওরা চারজন এলো। দেখেই সুরমা বললো, একি তোমরা আজ আবার এলে?

দ্বীপালি শান্ত কণ্ঠে বললো, কিছু নিতে আসি না রে। আজ তোকে কিছু বলতে এসেছি। একটু বসে শুনলেই হবে। সুরমা ওদের বসতে দিলো। আজ চারজন একেবারেই শান্ত। দ্বীপালি বলতে শুরু করলো,

সকলে চেয়েছিলো ছেলেসন্তান হোক। ঘর আলো করে মায়ের কোলজুড়ে ছেলে হয়েছে। ছেলের নাম রাখা হলো। সকলের আদরে বড় হতে লাগলো, স্কুলে ভর্তি হলো। কিন্তু বছর দশেক পর হঠাৎ করে ছেলেটা কেমন যেনো মেয়ের মতো আচরণ শুরু করলো। মেয়েদের সাজে, পোশাকে, খেলাধুলায় আগ্রহ। মেয়েদের সাথে মিশতে আগ্রহ। একসময়ে বাড়ি, স্কুল, আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশী সকলেই জেনে গেলো বিষয়টা। তখন থেকেই শুরু হলো হাসি, তামাশা, তিরস্কার, অপমান আর অবহেলা। নাম পরিবর্তন করে নতুন নাম হলো হিজড়া। অনেক ছেলেরা সুযোগ পেলে শরীর দেখার আগ্রহ দেখাতো। বাবা-মা সকলের অবহেলা সহ্য করতে না পেরে ঘর ছেড়েছি। খুঁজে নিয়েছি নিজের মতো অবহেলিত মানুষের সঙ্গ। আবার পেয়েছি নতুন নাম। জীবন ধারনের তাগিদে নেমেছি পথে। লোকে কতো কথা বলে। এখন আর গায়ে লাগে না। লোকে তো বলে পয়সার জন্যে আমরা পোশাক খুলি। আমরা খুলি না, খোলার ভান করি। লোকে বলে আমরা চাঁদাবাজি করি। আমরা চাঁদাবাজি করি না। কারো বিয়ে হলে, বাচ্চা হলে, খাৎনা হলে এসে নাচ, গান করে কিছু বকশিশ দাবি করি। যা দেয় তাই নিয়ে খুশি থাকি। তবুও বলে আমরা চাঁদাবাজ। আমাদের কাছে তো অস্ত্র থাকে না! আমরা তো কারো বাড়িতে রাতের অন্ধকারে চুরি করি না! আমরা তো ভিক্ষুকের মতো চেয়ে নেই। ভিক্ষুককে কেউ তিরস্কার করে না। আমাদেরকে করে। কাজ খুঁজতে গেলে অপয়া, অলক্ষ্মী বলে তাড়ায়। তাই বেঁচে থাকার জন্যে নেমে আসি পথে। পাঁচটা টাকার জন্যে হাত পেতে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পা ধরে যায়। আমাদের এতো প্রয়োজন কিসের? সংসার নেই, সন্তান নেই। কেবল খাওয়া আর পরা। সারাদিন হেঁটে যা রোজগার করি, সবটা আমরা খরচ করি না। যারা অসহায়, রোজগার করতে পারে না, আমরা তাদেরকে সাহায্য করি। তবুও সমাজের মানুষ আমাদেরকেই মন্দ বলে। তবে কিছু ভালো মানুষ সমাজে আজও আছে, তাদের সহায়তায় আমরা খেয়ে-পরে বেঁচে আছি।

একদিন আমরা কয়েকজন মিলে কাজে যাচ্ছিলাম। হঠাৎই বাচ্চার কান্নার শব্দ শুনে চেয়ে দেখি, অল্প কিছুদিনের একটি বাচ্চা বেঞ্চের উপর শুয়ে কাঁদছে। কেবল ছোট একটা জামা পরা। দৌড়ে গিয়ে কোলে নিলাম। যখন ওরা আদর করছিলো, দেখলাম বাচ্চাটির মা আড়াল থেকে সবটা দেখে সস্তির নিশ্বাস ফেলে চলে গেছে। উভয় লিঙ্গের বাচ্চা বলেই ফেলে গেলো মা। ওর নাম দিলাম কান্তা। আদরে আদরে পালতে শুরু করলোম। ওকে ডাক্তার দেখালাম। অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ডাক্তার বলেছে, আমার কান্তা মেয়ে। শুধু বড় হলে একটা অপারেশন করলেই হবে। সেজন্যে ওকে বড় হতে হবে। ডাক্তার বলেছে অপারেশনের পর আমার কান্তার বিয়ে হবে, সংসার হবে, সন্তান হবে। সবটা শুনে মনে হয়েছিলো, পৃথিবীতে সবচেয়ে ভাগ্যবতী মা আমি। মেয়েটার ওষুধপত্র, খাবারের জন্যে আমার খরচ বেড়ে গেছে। সারাদিন যা রোজগার করতাম, গুরুমাকে ভাগ দেয়ার পর ওর খরচ চালাতে আমার কষ্ট হতো। গুরুমাকে একটু কম দিলে গুরুমা চেঁচিয়ে বলতো, খাওয়া আর থাকার খরচ না দিলে সেখান থেকে যেনো চলে যাই। গুরুমারও কিছু করার নেই। আমার মতো কয়েকজনের থাকা-খাওয়ার খরচ উনাকেই ব্যবস্থা করতে হয়।

তাই একদিন মায়ের কাছে গিয়েছিলাম টাকার জন্যে। ভাই-বোনদের অপমানে ছুটে পালিয়েছি সেখানে থেকে। আমার জন্যে নাকি তাদের সম্মান নষ্ট হয়। আর যেনো কখনোই তাদের দরজায় না দাঁড়াই, তা-ও বলে দিলো। মেয়েটাও বড় হতে শুরু করেছে। তাই গুরুমার আস্তানা ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। ওরা তিনজন কান্তাকে ভালোবাসে বলে আমার সাথে চলে এসেছে শহর ছেড়ে এই গ্রামে। ভেবেছিলাম, গ্রামের সহজ সরল মানুষ আমাদের অবহেলা করবে না। কিন্তু না রে, আমরা সব জায়গাতেই অবহেলিত। মহিলা মাদ্রাসার হুজুরের হাতে-পায়ে ধরে আমার কান্তাকে লেখাপড়া করতে দিয়েছি মাদ্রাসায়। কতো ঝামেলা হয়েছে ওর বাবার নাম নিয়ে। এবার আমার মেয়েটা মাধ্যমিক দিতো। কতো আশা ছিলো শহরে ফিরে মেয়েটার অপারেশন করাবো, সে চাকরি করবে, আর কাজ করবে মানুষের মানবিক অধিকার নিয়ে। ছেলে নয়, মেয়ে নয়, প্রতিটি মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। আগে তাদের মানুষ ভাবতে শিখতে হবে। আমার কান্তা খুব জ্ঞানী ছিলো। একবার যা দেখতো সবটা সহজেই বুঝে নিতো। আমাকে আম্মাজান বলে ডাকতো। আমি পরিবারের কথা মনে করে কাঁদলে, চোখের জল মুছিয়ে বলতো একদিন সে আমাকে একটা সুন্দর সংসার উপহার দিবে। আমার সব দুঃখ ঘুছিয়ে দিবে। তা আর হলো না রে। এই সমাজ তিরস্কার করেই ক্ষান্ত হয়নি, শরীরটা যাচাই করতে গিয়ে তীক্ষè নজরে আমার কান্তার জীবনটা কেড়ে নিলো। বুকে হাত দিয়ে দ্বীপালি কাঁদতে লাগলো। সাথে ওরা তিনজনও হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। ওদের কান্না দেখে সুরমার চোখেও জল চলে এলো।

ঘুম ভেঙে সুরমার বাচ্চাটি কেঁদে উঠলো। সন্তানকে বুকে জড়িয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো সুরমা। দ্বীপালি বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে আদর করে বললো, আর কখনো আসবো না। তাই তোর গয়না ফেরৎ দিতে এলাম।

গয়না ফেরৎ দিবে কেনো? কাল তো নিলে।

কাল তো আশা ছিলো রে। খেয়ে-পরে যা সামান্য থাকতো, তা একটু একটু করে এই চৌদ্দ বছর ধরে জমিয়েছি মেয়ের চিকিৎসার জন্যে। সেই যখন নেই, জমানো টাকা দিয়ে কি আর হবে? তুই বরং এটা তোর সন্তানের জন্যে রেখে দিস্। গয়নার সাথে একটা টাকার পুটলি সুরমার হাতে দিয়ে দ্বীপালি বললো, পারলে বাচ্চাটাকে নিয়ে অনেক দূরে চলে যা। যেখানে কেউ ওর অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলবে না। কেউ কিছু জানবে না। সম্পূর্ণ একা ওকে বড় করবি। ওর মন যা চায় তাই প্রাধান্য দিবি। মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবি। যে অন্য মানুষকে মূল্যায়ন করবে। ছেলে-মেয়ের বিভেদ খুঁজবে না।

তোর মেয়ের জন্যে দোয়া করি। তার জীবন যেনো সম্মানিত হয়। এই গ্রাম ছেড়ে রাতের লঞ্চে আমরা আবার শহরে ফিরে যাবো।

সত্যিই তোমারা ফিরে যাবে? আমাকে তোমাদের সাথে নিবে। আমার সন্তানকে বাঁচাতে হবে তো! আমি যে শহরের কিছু চিনি, জানি না।

তুই চাইলে আমরা সব ব্যবস্থা করে দিবো। কাজ ঠিক করে দেবো। তোর বাচ্চাকে ডাক্তার দেখাবো। রাতে তৈরি হয়ে থাকবি। আমরা এসে তোকে নিয়ে যাবো। তোর বাচ্চাকে মানুষ করে গড়ে তোলবো, আমার কান্তাকে নিয়ে যে স্বপ্ন দেখেছিলাম তোর সন্তান সেই সব স্বপ্নপূরণ করবে। অবহেলিত, তিরস্কৃত সম্প্রদায়কে সমাজে বিতর্কিত না করে মানুষ হিসাবে মূল্যায়নের জন্যে কাজ করবে সে।

বাড়ি ফিরে ওরা চারজন, নিজেদের পোশাক গুছিয়ে নিলো। রাতে, সরকারি দুই কক্ষের ছোট্ট টিনের ঘরটিতে তালা ঝুলিয়ে কান্তার কবরের পাশে কিছুক্ষণ কেঁদে সুরমার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলো।

সুরমা তার স্বামীর কাছে একটা চিঠি লিখলো, ‘যেদিন ফিরে আসবো, সেদিন চলে যাবার কারণ বলবো’। তারপর এক হাতে সন্তানকে বুকে ধরে অন্য হাতে ব্যাগ নিয়ে, রাতের আঁধারে সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্যে জীবনের এক কঠিন সংগ্রামে পা বাড়ালো সে। পিছনে হাঁটলো ওরা চারজন।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়