প্রকাশ : ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০০:০০
ভাষা আন্দোলনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বাংলার নারীদের অনবদ্য ভূমিকা ছিলো। শুধুমাত্র ঢাকার ভেতরে নয়, ভাষা প্রশ্নে বাংলাদেশের প্রতিটি জেলা থেকে এমনকি মফস্বল এলাকার নারীরাও আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে আলোচনায় আসে। নারীদের তৎপরতা সারাদেশে শুরু থেকেই অব্যাহত থাকাটা ছিল চোখে পড়ার মতো। ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে অধ্যাপক আবুল কাশেমের নেতৃত্বে বাংলাভাষার দাবিকে চাঙ্গা করতে গঠিত হয় তমদ্দুন মজলিস। তখনও নারীরা ছিলো সেখানে। মূলকথা বিভাগোত্তরকালে লেখনী প্রচেষ্টা থেকে শুরু করে ১৯৪৮ সালের, ১৯৫২ সালের এবং ১৯৫২ সাল পরবর্তী সময়ের আন্দোলনে নারীরা ব্যাপকহারে অংশগ্রহণ করে।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বেলা ১১টা নাগাদ হাজারো ছাত্রছাত্রীর ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’-স্লোগানে মুখরিত চারদিক। ১৪৪ ধারা ভাঙার পক্ষে সিদ্ধান্ত হলে ভাষাসৈনিক গাজীউল হক সভাপতিত্বে মিছিল বের হতে শুরু করে। এ সময়ে তিনবছর সশ্রম কারাদ- ভোগ করে মুক্তি পেয়েই ভাষা আন্দোলনে আবারো সক্রিয় হলেন হাতিরপুল সেন্ট্রাল রোডের ‘দারুল আফিয়া’ বাড়িতে বসবাসকারী নাদেরা বেগম। ভাষা আন্দোলনে তার সক্রিয় ভূমিকা না থাকলেও তিনি পরোক্ষভাবে এই আন্দোলনে অংশ নেন।
‘১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনে নাদেরা বেগমের ভূমিকা প্রসঙ্গে ভাষাসংগ্রামী সোফিয়া খান বলেন, ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হয়ে দেখলাম রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ইতিমধ্যে আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে। নাদেরা বেগম ব্র্যবোর্নে পড়তেন। এখানে এসে দেখলাম নাদেরা যথেষ্ট কাজ করছে। আমি নাদেরার সঙ্গে মিলে মেয়েদের সংগঠিত করার কাজ করলাম। আমি আর নাদেরা স্কুলে স্কুলে যেতাম মেয়েদের সংগঠিত করতে।’ (তথ্যসূত্র : বাদল চৌধুরী, বই, ‘২১ মহিয়সী ভাষাসংগ্রামী’ পৃ. ৩০ ও ৩১)
ভাষাকন্যা নাদেরা বেগম ১৯২৯ সালের ২ আগস্ট বগুড়ার একটি সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার ডাকনাম ছিল উম্মে হেনা। জন্ম বগুড়ায় হলেও পৈত্রিক বাড়ি নোয়াখালী জেলার চাটখিল উপজেলার গোপাইরবাগে। পিতা খান বাহাদুর আব্দুল হালিম চৌধুরী এবং মা আফিয়া বেগম। বাবার চাকরির কারণেই তখন তারা বগুড়ায় বসবাস করতেন। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট আবদুল হালিম চৌধুরী ব্রিটিশ সরকার থেকে খান বাহাদুর খেতাব পেয়েছিলেন। আব্দুল হালিম ও আফিয়া বেগমের ১৪ সন্তানের মধ্যে নাদেরা বেগম তৃতীয়। শিক্ষাবিদ ও জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী (মানিক) তার বড় ভাই, শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরী তার মেজো ভাই, আর কিংবদন্তী নাট্য অভিনেত্রী ফেরদৌসী মজুমদার তার ছোট বোন।
‘নাদেরা বেগমের অন্য ভাই বোনেরা হলেন-নাসির চৌধুরী, আবুল কাইয়ুম (জহুর), রওশন আরা (কণা), মঞ্জুর এলাহি (মঞ্জু), দিলারা বেগম (দিলু), ড. মোহাম্মদ ইকবাল (শেলী), সমশের আজাদ রুশদি (রুশো), আয়মান আফতাব বানু, মাহবুব এলাহি ও রাহেলা বানু। (তথ্যসূত্র : ২৭ জুন ২০২১, দৈনিক একতা)
নাদেরা বেগমের পরিবারটি ছিলো শিক্ষিত, যা আমরা পরিবারের অন্য সদস্যদের দিয়েই বুঝতে পারি। খান বাহাদুর আবদুল হালিম চৌধুরীর ঢাকার বাসা ছিল সেন্ট্রাল রোডে। আবদুল হালিম চৌধুরী ছিলেন ধর্ম, শিক্ষা ও শৃঙ্খলার বিষয়ে খুবই কড়া। নিজেই বাড়িতে মেয়েদের পড়াতেন। নাদেরা বেগম তার বড় দুই ভাই কবীর চৌধুরী ও মুনীর চৌধুরীর সুবাদে বাড়িতে বসে আধুনিক বইপত্র পড়ার সুযোগ লাভ করেন। পরে এই দুই ভাইয়ের সংস্পর্শে তার মনে প্রগতিশীল ও বামপন্থি চিন্তা-চেতনার খোলা বাতাস বইতে থাকে। এরপর তাকে বরিশাল সদর বালিকা বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিতে ভর্তি করা হয়। তিনি বোরকা পরেই স্কুলে যেতেন, ক্লাস করতেন। বরিশাল সদর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৪৪ সালে মুসলিম মেয়েদের মধ্যে প্রথম বিভাগে প্রথম হয়ে ম্যাট্রিক পাস করেন।
ম্যাট্রিক পাস করার পর কলকাতার লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে ভর্তি হন। এটাই ছিল তার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট। লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ থেকে পরীক্ষা দিয়ে সম্মিলিত মেধা তালিকায় ষোড়শ স্থান অধিকার করে আইএ পাস করেন। ইংরেজিতে বিএ সম্মান পাস করেন তখন তার বয়স কেবল ১৮ বছর। ১৯৪৮ সালে কলকাতা থেকে ফিরে আসেন এবং বড় ভাই মুনীর চৌধুরীর উৎসাহে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে এমএ-তে ভর্তি হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ পড়ার সময়েই তিনি বড় ভাই মুনীর চৌধুরীর সাহচর্যে ও দীক্ষায় ধীরে ধীরে কমিউনিস্ট রাজনীতিতে জড়িত হন। সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন, এরপর কমিউনিস্ট ছাত্রীসংঘ পরিচালনার কাজে নেতৃত্ব দেন। অত্যন্ত রক্ষণশীল পরিবারে বেড়ে উঠা নাদেরা বেগম ১৯৪৮ সালের ১৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে অনুষ্ঠিত সভায় অংশগ্রহণ করেন। তখন তিনি ইংরেজি বিভাগের এমএ প্রথম বর্ষের ছাত্রী। এই সভায় পুলিশের লাঠিচার্জ হয়, সেদিন অনেকের সাথে তিনিও আহত হন।
১৯৫২ সালে সাবেক অর্থসচিব ও মহা হিসাবনিরীক্ষক গোলাম কিবরিয়া (সুরুজ)-এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন নাদেরা বেগম। গোলাম কিবরিয়া ছিলেন তার আপন খালাতো ভাই, পৈতৃক নিবাস কুমিল্লা জেলার মুরাদনগরের কুড়েরপাড় গ্রামে। গোলাম কিবরিয়ার পিতা মৌলভী আবদুল আজিজ ছিলেন নোয়াখালীর চাটখিলের গোপাইরবাগ মুন্সিবাড়ির সন্তান। গোলাম কিবরিয়ার মা ফাহিমা বেগম ছিলেন মুরাদনগরের ভুবনঘরের মৌলভী আবদুস সোবহান ওরফে আবদু মিয়ার কনিষ্ঠা মেয়ে। বিয়ের পর গোলাম কিবরিয়া চাকরি সূত্রে করাচি, মস্কো ইত্যাদি স্থানে যেতে হয়। নাদেরা বেগমও স্বামীর সাথে সাথে বিভিন্ন স্থানে থাকেন। করাচিতে থাকাকালীন তিনি করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুদিন শিক্ষকতা করেন। মেয়েদের একটি কলেজেও তিনি পড়ান, কিছু সময় রেডিওতে খবর পড়েন। নাদেরা বেগম পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এমএ পাশ করেন এবং প্রভাষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন।
নাদেরা বেগমের ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ নিয়ে বিভিন্ন বিভ্রান্তিকর তথ্যও পাওয়া যায়। তবে এটা ঠিক যে ১৯৪৮-৪৯ আন্দোলনে অংশ নিয়ে কারাগারে যাওয়ার ফলে প্রত্যক্ষ উপস্থিতি ছিল না তার। তবে জেল থেকে বের হয়ে তিনি আবার আন্দোলনে পরোক্ষভাবে যুক্ত হন।
‘১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তিনি সশরীরে অংশ নেননি। তিনি মনে করেন ভাষা আন্দোলনে তার ভূমিকা ছিল না। তবে তুষার আবদুল্লাহ কোন সূত্র ছাড়াই তিনি ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন বলে উল্লেখ করেন। (সূত্র : ভাষা আন্দোলন ও নারী, ফরিদা ইয়াসমিন)
মেধাবী গোলাম কিবরিয়া ছাত্রজীবনে কমিউনিস্ট রাজনীতির আদর্শে অনুপ্রাণিত হন। ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। সে সময় তাকে কারারুদ্ধ করা হয়েছিল। তিনি স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের আবাসিক ছাত্র ছিলেন। লেখাপড়া শেষে সরকারি চাকরিতে যোগদানের আগ্রহ প্রকাশ করে সক্রিয় রাজনীতি থেকে সরে যান। ১৯৫৬ সালে গোলাম কিবরিয়া পাকিস্তান অডিট অ্যান্ড একাউন্টস সার্ভিসে যোগদান করেন। কিছুকাল পাকিস্তানের রাজধানী শহর করাচিতে চাকরি করেন। প্রেষণে বদলি হয়ে পাকিস্তানের মস্কো দূতাবাসে ফার্স্ট সেক্রেটারি পদে দায়িত্ব পালন করেন।
‘নাদেরা বেগম ও গোলাম কিবরিয়া : ইতিহাসের দুটো বিস্মৃত নাম’ শিরোনামের লেখায় পাওয়া যায়-‘নাদেরা বেগম ও গোলাম কিবরিয়া বাংলাদেশের ইতিহাসে এক সময়ের স্মরণীয় দুই ব্যক্তিত্ব। নাদেরা বেগম ভাষা আন্দোলনের এক অগ্নিস্ফূলিঙ্গ নারী। আর ভাষা আন্দোলনের পাশাপাশি পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমলে সিভিল প্রশাসনে গোলাম কিবরিয়া একটি উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। ছাত্রজীবনে গোলাম কিবরিয়া ও নাদেরা বেগম উভয়েই ছিলেন কমিউনিজম আদর্শে বিশ্বাসী। উভয়েই ছিলেন ভাষা সংগ্রামের অকুতোভয় সৈনিক। ভাষা সংগ্রামে গোলাম কিবরিয়া তার অসীম সাহসী অবদানের জন্য এবং নাদেরা বেগম কেবল ভাষা সংগ্রামেই নয়, ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধির জন্য সংগঠিত আন্দোলনের সমর্থনে বলিষ্ঠ অবদানের জন্য ইতিহাসে বিশিষ্ট স্থান দখল করে আছেন।’
ভাষা সৈনিক চেমন আরা বলেছেন, ‘নাদেরা বেগম ও লিলি হকের নামও ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে আছে। হামিদা খাতুন, নুরজাহান মুরশিদ, আফসারী খানম, রানু মুখার্জী প্রমুখ মহিলারাও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর নৃশংসতার প্রতিবাদে অভয়দাশ লেনে এক সভায় নেতৃত্ব দেন বেগম সুফিয়া কামাল ও নুরজাহান মুরশিদ। ধর্মঘট উপলক্ষে প্রটুর পোস্টার ও ব্যানার লেখার দায়িত্ব পালন করেন ড. শাফিয়া খাতুন ও নাদিরা চৌধুরী।’
সুপা সাদিয়া তার লেখা ‘বায়ান্নর ৫২ নারী’ বইতে লিখেন, ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ বিষয়ে নাদেরা বেগমের মুখোমুখি হলে তিনি স্পষ্টভাবে জানান যে, তিনি কেবল ১৯৪৮-৪৯ সালের ভাষা আন্দোলন সমর্থন করেছেন। এবং অনেক ক্ষেত্রে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন, কিন্তু ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তার কোন সংশ্লিষ্টতা ছিল না। তিনি আরো জানান, ১৯৪৮-৪৯ সালের ভাষা আন্দোলনে তার সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি স্মৃতিভ্রমজনিত কারণে অনেকে ১৯৫২ সালের কথা বলে উল্লেখ করছেন, যা সঠিক নয়। তবে নাদেরা বেগম নিজেই বলেছেন, ১৯৪৮-৪৯ সালে ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। তিনি হয়তো নিভৃতচারী বলেই ভাষা আন্দোলনে তার অংশগ্রহণের কথা এভাবে বলেছিলেন। মনের অগোচরে তার হয়তো আরো বেশি মাত্রায় সোচ্চার হওয়ার ইচ্ছা ছিল।’ (তথ্যসূত্র : পৃ. ৩৮-৩৯)
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্যে নাদেরা বেগমের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। কিন্তু পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে বিভিন্ন সময় পালিয়ে যেতেন তিনি। তৎকালীন ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক অ্যানি জেরান্ডাইন স্টক তার স্মৃতি কথা ‘মেমরিস অব ঢাকা ইউনিভার্সিটি ১৯৪৭-১৯৫১’ গ্রন্থে নাদেরা বেগমের এই ভূমিকার কথা উল্লেখ আছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নাদেরা বেগম পুলিশের হাতে ধরা পড়েন এবং তাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়েছিল। তিনি ১৯৪৯ সাল থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত ঢাকা আর রংপুর কারাগারে ছিলেন।
১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি আন্ডার গ্রাউন্ডে থেকে সার্বিক সহযোগিতা করেছেন। পরবর্তীতে অন্যান্য ভাষা সংগ্রামীদের স্মৃতি-চারণায় সেগুলো উঠে আসে।
ভাষাসৈনিক ড. হালিমা খাতুন বলেন, ‘মুসলিম গালর্স স্কুল আর বাংলাবাজার গালর্স স্কুলের মেয়েদের নিয়ে আসার দায়িত্ব ছিল আমার। আমাকে সবাই চিনে না, জানে না, ছাত্রীরা হয়তো আমার কথা শুনবে না। এই ভেবে ইংরেজি বিভাগের সিনিয়ার ছাত্রী নাদেরা বেগমের একখানি চিঠি নিয়ে হোস্টেলে গেলাম। নাদেরা বেগম তখন আন্দোলনের কিংবদন্তি নায়িকা। অনেকবার জেল খেটেছেন। ১০ ফেব্রুয়ারি রাতে আমি নাদেরা বেগমের কাছ থেকে চিঠি লিখিয়ে আনি। মেয়েরা পরদিন সকালে আমতলার সভায় অংশগ্রহণ করেন। তার চিঠির ভাষা ছিল এমন বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে যে ষড়যন্ত্র হচ্ছে এটাকে প্রতিহত করার জন্য আন্দোলন চালিয়ে যাও।’
১১ মার্চ ডাকা হলো সাধারণ ধর্মঘট, এখানেও সম্পৃক্ত ছিলেন জাগ্রত নারীসমাজ। নাদেরা বেগম ছিলেন ভাষা আন্দোলনের সূচনালগ্নের অন্যতম সংগঠক। যাদের মধ্যে অন্যতম নিবেদিতা নাগ, নাদেরা বেগম, লিলির খান, লায়লা সামাদ প্রমুখ। আর সক্রিয় অংশগ্রহণের জন্য গ্রেপ্তার হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ পড়ুয়া ছাত্রী নাদেরা বেগম। পাকিস্তান সরকার বাংলা ভাষাকে আরবি, রোমান ইত্যাদি বিভিন্ন হরফে লেখার সিদ্ধান্ত নিতে চাইলে বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করে এর তীব্র প্রতিবাদ জানান নাদেরা বেগম। ১৯৪৮ সালের ১৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেলতলায় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবীতে অনুষ্ঠিত সভাতে তিনি অংশগ্রহণ করেন।
১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধির আন্দোলনে তিনি অংশগ্রহণ করেন। ১৯৪৯ সালের ৮ জানুয়ারি জুলুম প্রতিরোধ দিবসে অনুষ্ঠিত ছাত্রদের সভায় বক্তৃতা করেন। একই বছর জুন মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৭ জন ছাত্রছাত্রীর বিরুদ্ধে আন্দোলন করার অপরাধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়, তাদের একজন নাদেরা বেগম। পুলিশ তার নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করলে তিনি আত্মগোপনে চলে যান। এ অবস্থায় তিনি পালিয়ে থেকেই পিকেটিং-মিটিং-মিছিলে নেতৃত্ব দিয়েছেন। পরবর্তীতে গ্রেপ্তার হলে ১৯৪৯ সাল থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত ঢাকা আর রংপুর জেলে দুই বছর কারাভোগ করেন তিনি।
লেখক ও গবেষক জয়নাল হোসেন তার রচনা গ্রন্থে লিখেন, ‘বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সময় ভাষাকন্যা নাদেরা বেগমকে পুলিশি-গ্রেপ্তার থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আত্মগোপনে যেতে হয়েছিল। সে সময় সুফিয়া কামালের হাটখোলার তারাবাগের বাসায় ‘জাহানারা’ ছদ্মনামে তার বোনের মেয়ের পরিচয়ে তাকে থাকতে হয়েছিল। কিছুদিন পর ঘটনাটা জানাজানি হয়ে গেলে পুলিশ তাকে বন্দি করে। কারাগারে অন্য রাজবন্দিদের সঙ্গে তিনি কঠোর নির্যাতন ও অত্যাচারের শিকার হন। তার বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকা-ের জন্য সে সময় তিনি কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছিলেন। নাদেরা বেগম ১৯৪৯ সাল থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত ঢাকা এবং রংপুর জেলে থাকেন। তখন সহবন্দিদের সঙ্গে রাজবন্দির অধিকারের দাবিতে একবার ২৮ দিন, আরেক বার ৫৮ দিন অনশন ধর্মঘট করেছিলেন।’
নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশ অ্যান্ড লিবারেশন ওয়্যার স্টাডিজ বিভাগের প্রভাষক সুস্মিতা দাস এক লেখায় লিখেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা ভাষা আন্দোলনে দুঃসাহসিক অবদান রেখেছে। ১৯৫১ সালে ভাষা আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন ছাত্রীরাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সঙ্গে এক কাতারে দাঁড়িয়ে ভাষা আন্দোলনে গৌরবময় ভূমিকা রেখেছেন। ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি খাজা নাজিম উদ্দিন পল্টন ময়দানে জিন্নাহ সুরে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার কথা পুনর্ব্যক্ত করেন। ২৯ জানুয়ারি থেকে এ বক্তৃতার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ শুরু হয়। ৩১ জানুয়ারি আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সভাপতিত্বে ৪০ জন প্রতিনিধি নিয়ে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। এ কমিটিতে নারীদের মধ্যে নাদেরা চৌধুরী, লিলি খান প্রমুখ নেতৃবৃন্দ অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। সংগ্রাম কমিটির লিফলেট বিলি, নারী জমায়েত, প্রণোদনা দান প্রভৃতি কাজে নিয়োজিত হন কামরুন্নাহার লাইলী, হামিদা খাতুন, নূরজাহান মুরশিদ, আফসারী খানম, নিবেদিতা নাগ, রানু মুখার্জি, প্রতিভা মুৎসুদি, রওশন হক প্রমুখ নেতা-কর্মী। (তথ্যসূত্র : ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, দৈনিক জনকণ্ঠ)
নাদেরা বেগম ও গোলাম কিবরিয়া দম্পতির তিন সন্তান রয়েছে। ছেলে মাহমুদ কিবরিয়া (বিকাল) ও মাসুদ কিবরিয়া (টিবলু) এবং একমাত্র মেয়ে দিশা কিবরিয়া। ১৯৮৮ সালে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তার জীবনসঙ্গী গোলাম কিবরিয়া ২০১১ সালে ৮৪ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করা সংগঠক এবং কর্মী ভাষাসৈনিক নাদেরা বেগম বার্ধক্যজনিত কারণে ২০১৩ সালের ১২ এপ্রিল উত্তরায় তার নিজের বাসায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর।
লেখক : সাহিত্যিক, কলামিস্ট ও প্রাবন্ধিক।