সোমবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২৪  |   ১৯ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০০:০০

অভিমানী প্রেম
কবির হোসেন মিজি

ডাকাতিয়ার তীরঘেঁষে ফেমাসের দক্ষিণের বারান্দায় বসে প্রায়ই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর দখিনা বাতাস উপভোগ করে আবির। ফেমাস একটি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের নাম। অবসর পেলেই আবির সেখানেই ছুটে যায়। দক্ষিণের ত্রিশ ফুট লম্বা এবং তিন ফুট দৈর্ঘের বারান্দায় প্লাস্টিকের চেয়ার টেনে বসে ডাকাতিয়ার মৃদু বাতাসে স্বস্তির নিঃস্বাস ফেলে। সেখানেই বসে রোজ অ্যান্ড্রোয়েড মোবাইলের স্ক্রিন চেপে ফেসবুক দেখেন। কখনো-বা গান শুনেন। কখনো মনে ভাব জমলে রচনা করেন গান কিংবা গল্প-কবিতা। এভাবেই ফেমাসের দক্ষিণের বারান্দাটা প্রিয় হয়ে উঠে আবিরের।

গত তিন মাস আগে তার কাছে বারান্দাটা ছিলো একটু ভিন্ন রকম। ডাকাতিয়ার তীরে বেদেপল্লীর নানা দৃশ্য দেখার ফাঁকে মনের অজান্তেই আবিরের চোখ আটকে যায় কালো রঙের বোরকা পরিহিত মেঘবালিকার দিকে। কালো নেকাপের আড়ালে চানগ্লাসে ঢাকা চোখ দুটো দারুণভাবে আবিরের দৃষ্টি কেড়ে নেয়। তার সমস্ত ভাবনা যেনো ওই কালো হরিণ চোখেই মিশে যায়। মনে মনে কতো কি ভেবে মনের ভেতর রচনা করছে সেই মেঘবালিকাকে!

হাতের আঙ্গুলের চিপায় সিগারেট নারাচারা, দিয়াশলাইয়ের কাঠিতে ঘষা দিয়েও দিচ্ছে না। কালো বোরকার নেকাপের আড়ালে চোখ পড়তেই সিগারেট জ্বালানো থেকে বিরত থাকলো। বালিকার মায়ের মুখে হঠাৎ শুনতে পেলো মেঘলা আমাদের রিপোর্টটা হয়েছে?

মেঘলা উত্তরে বললো না মা এখনো হয়নি। হয়তো

আরো আধাঘণ্টা সময় লাগতে পারে।

মেঘলা নামটি শুনতেই আবির একটু অন্য মনোষ্ক হয়ে পড়লো। নামটি মনে হচ্ছে তার লেখা কোনো গল্পের নায়িকার নাম। আবির কিছুটা আমতা আমতা করেই সংকোচ ভেঙ্গে জিজ্ঞেস করলো আপনার নামটি কি সত্যিই মেঘলা?

মেয়েটি কি যেনো ভেবে কয়েক সেকেন্ড পরে উত্তর দিলো হ্যাঁ, তবে কেনো এমন প্রশ্ন করলেন?

না মানে এমনিতেই। আমার লেখা একটা গল্পে নায়িকার নাম দিয়েছিলাম মেঘলা। তাই আপনার নামটির সাথে আমার গল্পের নায়িকার নামের মিল খুঁজে পাওয়াতে জানার কৌতূহল মনে হলো। এখানে কি ডাক্তার দেখাতে এসেছেন? প্রশ্ন করলো আবির। মেঘলার কথা বলার তেমন আগ্রহ না থাকলেও আবিরের প্রশ্নের মুখে পড়ে তাকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে উত্তর দিতে হচ্ছে। আবিরেকে নিচু স্বরে উত্তর দিলো জ্বি হ্যাঁ। আমার মা অসুস্থ তাই হাসপাতালে ডাক্তার দেখিয়েছি। কিছু পরীক্ষা দিয়েছে, তাই রিপোর্টের জন্যে অপেক্ষা করছি।

এভাবে একের পর এক নানান প্রশ্নে দুজনের অনেক কথোপকথন হলো। মেঘলা নামটি কেনো জানি আবিরের খুব করে মনে ধরলো। এ নামটির সাথে যেনো সে কিসের সুখ খুঁজে পেয়েছে। তাইতো ইচ্ছে করেই মানিব্যাগ থেকে তার ভিজিটিং কার্ডটি বের করে মেঘলার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো, আবার যদি কখনো হাসপাতালে আসেন প্রয়োজন হলে আমাকে নক দিবেন। এখানকার সবাই আমার পরিচিত। আপনাকে কিছুটা হলেও সহযোগিতা করতে পারবো। এর ফাঁকে হঠাৎ একজন স্বাস্থকর্মী এসে মেঘলার উদ্দেশ্যে বললো, স্যার এসেছেন, আপনাদের রিপোর্ট হয়ে গেছে। কিছু না বলেই মেঘলা তার পথ ধরে হাঁটতে শুরু করলো। আবির ডাকাতিয়ার জলে চোখ বুলিয়ে স্বপ্নজালে জড়িয়ে গেলো।

চৈত্রের কাঠফাটা রোদ্রে ঘাম ঝরছে আবিরের শরীর থেকে। গরমের তাপে ভিজে গেছে গেঞ্জি, শার্ট। কপাল বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম মুছতেই মোবাইলে রিংটোন বেজে উঠলো। জিন্সের পেন্টের পকেট থেকে মোবাইলটি বের করতে করতেই ততোক্ষণে লাইন কেটে গেলো। বুড়ো আঙ্গুলের সাহায্যে লক খুলে স্ক্রিনে চোখ পড়তেই বুঝতে পারলো একটি অপরিচিত নম্বর। ততোক্ষণে আবারো বেজে উঠলো রিংটোন। আবির রিসিভ করে স্বাভাবিক কণ্ঠে, হ্যালো। ওপাশ থেকে একটু কর্কস ভাষায় মেয়েলী কণ্ঠে বলে উঠলো, আপনি কি আবির?

জ্বি আমি আবির। কিন্তু আপনি কে? আবিরের প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই মেয়েলী কণ্ঠে একনাগারে বলতে লাগলো,

দেখুন আপনি যাই হোন না কেনো। আমি আপনাকে ভয় পাই না। আপনাকে পেলে মেরে তক্তা বানিয়ে দিবো। আপনারা এসব ভুয়া ডাক্তারি ছাড়–ন। আমার মাকে ডাক্তার দেখিয়েছি, কতগুলো ঔষধ, পরীক্ষা-নীরিক্ষা দিলো। অথচ এখনো কোনো রোগ সারেনি না। আপনারা এসব কেমন ডাক্তার রাখেন বলুন তো।

এসব কথা শুনতেই আবির ততোক্ষণে বুঝতে পারলো সে আর অন্য কেউ নয়, সেই মেঘলা মেয়েটি। হয়তো আবিরকে বুঝতে না পেরেই আবোল-তাবল বকছে। মেঘলার কথাগুলো খুবই সিরিয়াস ছিলো। তার কথা শুনে আবির যেনো ঘোখরা সাপের মতো ফুসে উঠছে।

তাই আবিরও অনেকটা উত্তেজিত কণ্ঠে বললো, দেখুন এতোক্ষণ আপনি যা ইচ্ছে তাই বকে গেছেন। এবার আমার কথাগুলো মন দিয়ে শুনুন। আমাকে যদি আপনার দালাল কিংবা ডায়াগনস্টিকের লোক মনে হয়, তাহলে ভুল ভাবছেন। আমাকে কেউ কখনো এ ধরনের কথা বলার সাহস পায়নি। আপনি আর কখনো কোনোদিন আমাকে কল দিবেন না। ভালো থাকুন। এই বলে রাখতেই মেঘলা যেনো বাঘ থেকে ছাগলে পরিণত হয়ে গেলো। অনেকটা নরম কণ্ঠে বললো, সরি। সত্যি আমি আপনাকে বুঝতে পারিনি। আমি ভেবেছি আপনি তাদেরই লোক। মেঘলার প্রথম কথাগুলোতে আবিরের মনে খুব ঘৃণা জন্মালো। তাই সে সেই ক্ষোভে বললো, ঠিক আছে আপনার প্রতি কোনো রাগ নেই, ভালো থাকুন। এই বলে হুট করে লাইন কেটে দিলো। রাগে-ঘৃণায় তার শরীর কাঁপছে। মনে মনে খুব কষ্ট হচ্ছে। শালার কি ভেবেছি আর কি হলো। মেঘলা মেয়েটির কাছ থেকে এতোটুকু ভালোবাসার আশায় বড় আশা নিয়ে কার্ডটি দিয়েছিলাম। অথচ সে আমাকে না বুঝেই এমন বাজে কথাগুলো বললো। যা জীবনে কখনো কোনোদিন ওর কলের আশা করবো না।

দু সপ্তাহ পর আবারো মেঘলার কল। আবির রাগে-ঘৃণায় তার কল রিসিভ করার উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছে। যতোবারই মোবাইল স্ক্রিনে মেঘলার দেয়া কলের রিংটোন বেজে উঠলো, ততোবারই আবির লাইনটি কেটে দিলো। কয়েকবার কল দিতেই শেষ পর্যন্ত আবির বাধ্য হয়েই কলটি রিসিভ করলো। মেঘলা প্রথমেই বললো, প্লিজ আমার লাইনটি কাটবেন না। আপনাকে খুব বিশেষ একটি প্রয়োজনে কল দিয়েছি। আমি যতোটুকু জানি আপনি সবসময় মানুষের উপকারে কাজ করেন। তাই আমিও আমার এতোটুকু উপকারের জন্যে আপনাকে স্মরণ করেছি। আমার বড় বোন একটি প্রাইভেট হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে। তার সিজারিয়ানে একটি সন্তান হয়েছে। ডাক্তার বলেছে তার দুই ব্যাগ রক্ত লাগবে। তাই বলছি আমার সব দোষ ভুল ক্ষমা করে দিয়ে দু ব্যাগ ও পজিটিব রক্তের ব্যবস্থা করে দিলে কৃতজ্ঞ থাকবো। মেঘলার কথা শুনে আবির অনেকটা নরম হয়ে গেলো। বললো আপনি কি এখন হাসপাতালে আছেন।

না। আমি বাড়িতেই আছি। রক্তের ব্যবস্থা হলে আগামীকাল সকালে বোনকে দেখতে হাসপাতালে যাবো।

আবির বললো, ঠিক আছে আমি দেখছি। আপনি রোগীর অ্যাড্রেস এবং হাসপাতালের বেড নাম্বারটি দিন। প্রায় এক ঘণ্টা পর রক্তের ডোনারের ব্যবস্থা করে মেঘলাকে জানিয়ে দিলো রাত আটটার মধ্যে তার বোনকে রক্ত দিতে একটি ছেলে হাসপাতালে যাবে। বোনকে রক্ত দেয়ার বিনিময়ে আবির এবং মেঘলার মাঝে যেনো বরফ গলতে শুরু করেছে। দুজনই যেনো মোবাইলে কথা বলার সময় বরফ গিলে খাচ্ছে। কথোপকথনে ধীরে ধীরে তাদের মুখ থেকে শীতল হাওয়া বের হচ্ছে। কেমন যেনো আবেগের নদীতে স্বপ্ন ভাসায় দুজন।

একদিন পর সকাল সকালই মেঘলা শহরের সেই প্রাইভেট হাসপাতালে পৌঁছলো। কিন্তু আবির সে কথা জানে না। মেঘলাও আবিরকে বিষয়টি জানায়নি। হাসপাতালের ৪র্থ তলার দুইশো তিন নাম্বার বেডে ফুটফুটে বোনের ছেলেকে আদর করছে মেঘলা। তাকে কোলে নিয়ে হাসপাতালের করিডোরে হাঁটাহাঁটি। হঠাৎ অনাকাক্সিক্ষত আবিরের ফোন পেয়ে চমকে গেলো। প্রথম কলটি রিসিভ করার সুযোগ হলো না। দ্বিতীয়বার কল বাজতেই রিসিভ করে মৃদু হেসে বললো, কেমন আছেন। জ্বি ভালো। মেঘলা কৃতজ্ঞচিত্তে বললো, আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ, রক্তের ব্যবস্থা করে দেয়ার জন্যে। কথার পাশ কাটিয়ে আবির প্রশ্ন করলো আপনি কি হাসপাতালে? না মানে আমি বাড়িতেই আছি। মেঘলার কথা তেমন ক্লিয়ার মনে হলো না। তাই আবির আবারো বললো, প্লিজ বলুন। তাহলে হাসপাতালে এসে শুধু দূর থেকে আপনাকে এক নজর দেখবো।

না আমি এখনো হাসপাতালে যাইনি। মেঘলার কথা স্পষ্ট না হওয়ায় অনেকটা অভিমান করেই লাইন কেটে দিলো আবির।

সেদিন শুধু বোরকার আড়ালেই মেঘলাকে হৃদয়ের চোখে এঁকেছিলো আবির। আসলে মেঘলা দেখতে কেমন, তার কিছুই বাস্তবে অনুভূত হয়নি। তাইতো সেই হৃদয়ে আঁকা মানুষটিকে দেখার বড় কৌতূহল আবিরের। কিছু না ভেবেই মোটরসাইকেল নিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে ছুটলো। প্রথম দিনের দেখায় মেঘলা আবিরকে ভালো করেই চিনে রেখেছিলো। কিন্তু মেঘলা বোরকা এবং মুখোশ পরে থাকায় মেঘলাকে চেনার কোনো উপায়ই আবিরের ছিলো না। হাসপাতালের কাউন্টারের সামনে থেকে আবিরকে দেখেই মেঘলা দ্রুত পায়ে হেঁটে কেটে পড়তে চেয়েছিলো। কিন্তু আবিরের বুদ্ধির কাছে হেরে যায় মেঘলা। আইডিয়া থেকে মেঘলার গতি প্রতিরোধ করে বললো, দাঁড়ান। আমাকে ফাঁকি দেয়ার কোনো মানে হয় না। আমি ঠিকই আপনাকে চিনে ফেলেছি। আবিরের কথা শুনে লাজে ওড়নাতে মুখ লুকায় মেঘলা। মুচকি হেসে বললো, কি ভাবে শিউর হলেন। সেটা আপনাকে বলবো কেনো। আমি আমার হৃদয়ের চোখ আর আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলতে পারি আপনিই মেঘলা। আবিরের কথায় অবাক তাকিয়ে রইলো মেঘলা।

তো আপনার বোনের কি অবস্থা এখন প্রশ্ন করলো আবির।

অনেকটা ভালো আছে।

আবির বললো, আচ্ছা একটা কথা বলবো?

বলুন।

আমার কাছ থেকে নিজেকে এভাবে আড়াল করতে চান কেনো বুঝিনি। আমি বাঘ নাকি সিংহ। মেঘলা কিছুটা হাসি টেনে বললো এমনিতেই ভালো লাগে তাই।

তারপর দুজনের অনেক কথোপকথনে দুজন যেনো দুজনার হৃদয়ের খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেলো। আবির বললো, চলেন না রেস্টুরেন্ট থেকে একসাথে একটু চা খেয়ে আসি। রাজি হলো না মেঘলা।

একটা সময় আবির সামন্য এই বিষয়টা নিয়ে ভালোবাসার গভীরতা থেকে ভীষণ অভিমানে হাসপাতাল থেকে বিদায় নিলো। মেঘলা যতোই ডাকলো পেছন ফিরে তাকালো না আবির। বারবার কল দিচ্ছে আবিরকে। তা-ও রিসিভ হচ্ছে না। ব্যর্থতা নিয়ে বাধ্য হয়েই হাসপাতালের নৈশপ্রহরীর ফোন দিয়ে আবিরকে কল দিয়ে বললো, সরি। আপনি আসুন, আমি আপনার কথা রাখবো।

দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা হলো। হাসপাতালের বারান্দায় বসে দুজনের আবেগ জড়ানো আলাপচারিতা। একসময় আবির মনের সব কথা খুলে বলে। মেঘলার উদ্দেশ্যে বললো, তোমার কাছে আমার তেমন কিছুই চাওয়ার নেই। আমি শুধু তোমার এতোটুকু ভালোবাসা চাই। এই বলেই মেঘলার ডান হাতটি টেনে নিয়ে আঙ্গুলের পাতার উপর আলতো করে একটি চুমু বসিয়ে দিলো। মেঘলা যেনো পৃথিবীতে নেই। কি করবে, কি বলবে কিছুই ভেবে উঠতে পারছে না। অনেকটা হতভম্ব হয়ে গেলো। আবার মনে, মনে আবিরের এই স্পর্শটুকু হাসিমুখে মেনেও নিলো। হাতের তালুর উপরে পবিত্র চুমু খাওয়া থেকেই যেনো তাদের দুজনের ভালোবাসার শুভসূচনা হতে লাগলো। তারপর থেকেই প্রতিদিন নিয়মিত দুজনের অনেক কথা হয়। প্রেম আর ভালোবাসার গভীর বন্ধনে দুটি হৃদয় হয়ে উঠলো একটি আত্মা।

ভালোবাসার শুরুটা যেমনই হোক না কেনো। আজ তাদের ভালোবাসার বয়সের সীমারেখা তিনটি বসন্ত পেরোতে চলেছে। কেউ কাউকে কখনো হারাতে চায়নি। সমস্ত পিছুটান আর বাস্তবতাকে হার মানিয়ে তারা তাদের ভালোবাসাটাকে জয় করতে চায়। দুটি হৃদয় একটি আত্মা হয়ে আজ তাদের সম্পর্কটা যেনো বহু পুরানো হয়ে গেছে। আপনি এবং তুমি শব্দ থেকে অনেক সময় তুই-তোকারও চলে তাদের ভালোবাসার সুখের আলাপনে। তবে দুজনের মাঝেই রাগ-অভিমানটা খুব বেশি। কথায় আছে অতি ভালোবাসায় অভিমান বেশি। হয়তো সে কারণেই তাদের এতো অভিমান। অভিমান থাকা ভালো। তবে কিছু অভিমানে অনেক সময় খুব প্রিয় মানুষটিও বহু দূরে হারিয়ে যায়। এমনটি যেনো কখনো না হয়, মেঘলার কাছে এমন অনুরোধই আবিরের।

মেঘলাকে আবির যতোটা না মনে-প্রাণে ভালোবাসে তার চেয়ে বেশি আবিরকে ভালোবাসে মেঘলা। কিন্তু মেঘলা খুব কঠিন প্রকৃতির মানুষ হওয়ায় কখনো আবিরকে তার দুর্বলতাটা বুঝতে দেয়নি। দু-একদিন পর পরই তাদের কথার মাঝে অনেক রাগ-অভিমান হয়ে থাকে। আবিরও একটু ভিন্ন প্রকৃতির মানুষ। তার ভেতর ঠিক যতোটা রাগ রয়েছে তার চেয়ে বেশি ভালোবাসাটাও রয়েছে। আর সে ভালোবাসার গভীরতা থেকেই প্রায়ই কথায় কথায় মেঘলার সাথে অভিমান করে বেড়ায়। মেঘলাটাও বড় দুষ্টু। নিয়ম হচ্ছে একজন রাগ বা অভিমান করলে সে অভিমানটা প্রিয়জনই ভাঙ্গানোর চেষ্টা করে। কিন্তু এ বিষয়ে মেঘলা একেবারেই আলাদা। আবির তার সাথে কথা বলার সময় যে কোনো প্রসঙ্গক্রমে রাগ কিংবা অভিমান করে মোবাইলের লাইন কেটে দিলে মেঘলা আবিরের সে অভিমান কখনো ভাঙ্গানোর চেষ্টা করেনি। অথচ মেঘলাকে হারানোর ভয়ে আবিরই বেহায়াপনার মতো বারবার তাকে কল দিয়ে কথা বলে। এসব বিষয় নিয়ে আবির সবসময়ই বলে বেড়ায় মেঘলা আসলেই তুমি কেমন জানি। তোমাকে আজো বুঝতে পারিনি।

একদিন মেঘলা আবিরকে কিছু না জানিয়েই তার অজান্তে শহরে বেড়াতে গেলো। আবির তখন ছিলো নিজ জেলার বাইরে। সমস্ত ব্যস্ততা শেষ করে মেঘলাকে কল দিয়েই আবির প্রশ্ন করলো তুমি কোথায়?

মেঘলা মিথ্যের আশ্রয় না নিয়ে সরল মনে উত্তর দিলো বিশেষ প্রয়োজনে একটু শহরে বেরিয়েছি। তোমার নাম্বার বন্ধ থাকায় জানানোর সুযোগ হয়নি। প্লিজ সোনা রাগ করো না। কথাটি শুনতেই আবির রাগে-ক্ষোভে-অভিমানে কিছু না বলেই হুট করে লাইনটি কেটে দিলো।

বিষয়টি আবির সহজভাবে মেনে নিতে পারেনি। কারণ আবির কখনই মেঘলাকে একা কোথাও চোখের আড়াল হতে দেয়নি।

মেঘলা বেশ কয়েকবার রিটেন কল করলো। কিন্তু আবির কিছুতেই মেঘলার কল রিসিভ করেনি। ঘণ্টাখানেক পর আবির বার বার মোবাইল স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখে মেঘলা তার অভিমান ভাঙ্গাতে আবার তাকে কল করলো কি না। কিন্তু না সেই প্রথম সময়ের পর থেকে মেঘলার নাম্বার থেকে আর কোনো কল আসেনি। মনে মনে আবির ভীষণভাবে মেঘলার কলের অপেক্ষায় রয়েছে। মেঘলাও পরবর্তী সময়ে আর দ্বিতীয়বার আবিরকে কল করলো না।

এভাবে কেটে গেলো কয়েক মাস। এর মাঝে আবির দুই-তিনদিন মেঘলাকে কল দিয়ে দেখলো মেঘলার নাম্বারটি বন্ধ রয়েছে। আবিরের মনটা ভীষণ খারাপ। কিছুই ভালো লাগছে না। কি করবে কিছুই ভেবে পাচ্ছে না। নিরূপায় হয়ে মেঘলাকে একটি মেসেজ দিয়ে রাখলো, তোমার সাথে আমার সেই প্রথম থেকে তিক্ততার পরিচয়। তাই হয়তো পরবর্তী সময়ে তোমার এতোটা গভীর ভালোবাসা পেয়েছি। আমি জানি মেঘলা, তোমার মতো করে পৃথিবীর আর কোনো নারী আমাকে এভাবে ভালোবাসতে পারবে না। এতোটা ভালোবাসা দিতে পারবে না। আমিও তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি সোনা। তাইতো সেই ভালোবাসার গভীরতা এবং অধিকার থেকে তোমার সাথে এতোটা অভিমান। তুমি হয়তো আমার সেই অভিমানটাকে কখনো মন থেকে বুঝতে চাওনি। সেদিনের অভিমানের জন্যে আমি নিজেই অনুতপ্ত। তোমাকে বেশ কয়েকদিন কল দিয়েছি। বারবারই ব্যর্থতা ছুঁয়ে গেছে আমাকে। মেসেজটি দেখার পর আমাকে অন্তত এক মিনিটের জন্যে হলেও একটু কল দিও। তুমি ভালো থেকো। মরে গেলে ক্ষমা করে দিও সোনা।

তিন মাস পর মেঘলা তার হারিয়ে যাওয়া সিমটি নতুন করে তোলে মোবাইলে ওপেন করতেই আবিরের মেসেজটি পৌঁছলো। আবিরের মেসেজ যেনো মেঘলার বেঁচে থাকার অক্সিজেন। সাথে সাথে মেসেজটি পুরোপুরি না পড়েই আবিরকে কল দিতে লাগলো। বেশ কয়েকবার কল ঢুকলো। কিন্তু কেউ রিসিভ করছে না। হাল না ছেড়ে আবারো কল দিতে লাগলো। এবার কল রিসিভ করতেই মেঘলা বললো, কেমন আছো তুমি। ওপাশ থেকে আবিরের কণ্ঠের পরিবর্তে এক কিশোরীর কণ্ঠে প্রশ্ন করলো কে আপনি? আমি মেঘলা। এটাতো আবিরের নাম্বার। জ্বি হ্যাঁ এটা আবির ভাইয়ার নাম্বারই। আমি তার ছোট বোন অবনী। আবির কোথায়? ওকে একটু ডেকে দাওনা প্লিজ। মেঘলার কথা শুনতেই আবিরের ছোট বোন অবনী হতবাক হয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলে উঠলো। ভাইয়া তো আর এই পৃথিবীতে বেঁচে নেই আপু। গত মাসের তিন তারিখ ভাইয়া স্ট্রোক করে মারা গেছেন। কথাটা শুনতেই মেঘলা যেনো বোবামূর্তি হয়ে গেলো। নিজের অজান্তেই হাত থেকে মোবাইলটা ছিটকে পড়ে চুর্ণবিচুর্ণ হয়ে গেলো। অনুতপ্ত আর অনুশোচনার আগুনে জ্বলে-পুড়ে জীবত মমির মতো দু চোখ থেকে গড়িয়ে জল পড়তে লাগলো।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়