প্রকাশ : ২২ জানুয়ারি ২০২২, ০০:০০
অস্থির লাগছে সদিচ্ছার। হাতে মোবাইল নিয়ে পায়চারি করছে সে। কল দিবে কি দিবে না ভাবছে। আজ-কাল ফোনের ওই পাশ থেকে কোনো সদোত্তর আসে না। কল রিসিভ করে না প্রান্ত। প্রান্তের সাথে আগের মতো প্রতিদিন দেখা হয় না তার। কথাও হয় না নিয়মত। সব কিছু ওলট-পালট মনে হয় তার। বাসার বেলকনিতে এসে ইজিচেয়ারে বসে একটু ইজি হওয়ার চেষ্টা করে সে। রাতের আকাশে পূর্ণ চাঁদ। আলো দিয়ে যাচ্ছে অবিরত। দূরের আকাশের তারাগুলোও মিটি মিটি করে জ্বলছে। পাখিরা সব নীড়ে ফিরে শান্তির ¯্রােতধারায় রাতের সুখ নিজের করে নিচ্ছে। দখিনের হিমেল হাওয়া দিনের প্রখর রৌদ্রের খরতাপের ক্লান্তিকে নিমিষে দূর করে দিচ্ছে। দূর থেকে নিয়ে আসছে প্রশান্তি। গাছের শাখা আর পাতাগুলো হিমেল হাওয়ায় বার বার নেচে উঠছে মনের আনন্দে। শান্তির বার্তা শহরজুড়ে। শুধু শান্তি নেই সদিচ্ছার মনে। কেনো যেনো বুকের বাঁপাশে চিন্চিন্ ব্যথা করছে। কিছুতেই ভালো লাগছে না তার। অগত্যা বেলকনি ছেড়ে আবার শোবার ঘরে যায় সে। ঘুমানোর চেষ্টা করে। কিন্তু ঘুম আসতে চাইছে না।
দুই.
ঘুমোতে চেষ্টা করেও কোনো লাভ হচ্ছে না। সদিচ্ছার স্মৃতিতে ভেসে আসছে বিগত দিনের স্মৃতি। চার বছর আগে দেখা প্রান্তের সাথে। ক্যাম্পাস স্যাডোতে। জায়গাটা তার খুব প্রিয়। ডিপার্টমেন্টের বন্ধুদের সাথে প্রায় সময় সকালের প্রথম ক্লাস শেষ করে এখানেই নাস্তা করা হতো তার। বাসায় সকালে নাস্তা করতো না বন্ধুদের সাথে নাস্তা করবে বলে। অবশ্য কখনো কখনো বাসা থেকে তার আম্মু জোর করে হটপটে করে নাস্তা দিয়ে দিতো। ক্যাম্পাসে এসে বন্ধুদের সাথে ভাগাভাগি করা খেতো সে। স্যাডোর রঙ-চা তার খুব প্রিয়। ক্যাম্পাস স্যাডো অবশ্য এই একটি কারণেই তার প্রিয় নয়। বরং প্রান্তের সাথে এখানে প্রথম পরিচয় তার। আর এজন্যেই তার ভালো লাগার একটা জায়গা এটা। সদিচ্ছার বন্ধু প্রেমা। কলেজে একই সাথে পড়াশোনা করেছে দুজনে। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে দুজনে দুই বিষয় নিয়ে পড়লেও আগের মতোই তাদের বন্ধুত্ব অটুট রয়েছে। তাই প্রায় সময়ই দেখা হয় দুজনের। প্রেমার ডিপার্টমেন্ট বন্ধু প্রান্ত। প্রেমাই সদিচ্ছাকে প্রান্তর সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। সে থেকে পরিচয়। হাই-হ্যালো দিয়েই শুরু। এখন নিয়মিত দেখা হয় সদিচ্ছা আর প্রান্তর। প্রান্ত খুব সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলে। পরিপাটি চলাফেরা, বাচনভঙ্গি প্রান্তকে সবার কাছে আকর্ষণী করে তুলে সহজেই।
প্রান্তের গোছালো কথা, বুদ্ধিদীপ্ত চিন্তা-ভাবনা সদিচ্ছার খুব ভালো লাগে। এই ভালো লাগা ক্রমশ বাড়তে থাকে। আসতে আসতে ভালোলাগা যে কখন ভালোবাসায় রূপ নেয় বুঝতেই পারেনি সে। প্রান্তও পছন্দ করে সদিচ্ছাকে। আর এভাবেই শুরু হয় দ্বি-পক্ষীয় ভালোবাসার। প্রথমদিনের ক্যাম্পাস স্যাডোর দেখা হওয়াটা ছিলো তার কাছে দৈবঘটনা। আজও দিনটিকে ভুলতে পারেনি সে। এরপর অসংখ্যবার এসেছে এখানে। বন্ধুদের সাথে দুজন মিলে চায়ে চুমুক, গরমের দিনে কোল্ডড্রিংকস্ কিংবা সকালের নাস্তা। প্রতিটি দিন স্বপ্নের মতো।
অথচ গত একমাসে দুজনের দেখা হয়েছে মাত্র তিনবার। ইদানীং কি যেনো ভর করেছে প্রান্তের উপর। মনে হচ্ছে, চোখগুলো গর্তে চলে যাচ্ছে। চোখের নিচে কালো দাগ পড়ছে। অনেক দিন রাত জাগলে যা হয়, তাই আরকি। কিন্তু প্রান্ত তো খুব বেশি রাত জাগে না। তাহলে এ রকম হওয়ার কারণটা কি? সদিচ্ছার সামনে আসে হাজারো কারণ কিংবা অকারণ। কারণ-অকারণগুলোর কারণও খুঁজে পায় না সে। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে যেনো দূরে সরে যাচ্ছে দুজনের সম্পর্ক। এ যেনো বালির বাঁধ। থিতু হয় না বেশি সময়ের জন্যে। তীব্র জলের ¯্রােতে যে বাঁধ ভেঙে যায় আচমকা। অথচ সদিচ্ছা-প্রান্তের মধ্যকার বাঁধতো এতো ঠুনকো নয়। তবু কেনো জানি আগের সেই খুনসুটি, অভিমানও যেনো আগের মতো নেই। হারিয়ে যাচ্ছে কোনো এক অজানায়।
তিন.
প্রান্তকে কল দিয়ে যায় সদিচ্ছা। ক্রিংক্রিং ক্রিংক্রিং রিং হয়। কিন্তু কোনো সাড়া নেই। আধাঘণ্টা চেষ্টার পর কল রিসিভ হয়। ওই পাশে প্রান্ত।
সদিচ্ছা : কেমন আছো তুমি?
প্রান্ত : ভালো আছি।
সদিচ্ছা : কতবার কল দিয়েছি তোমায়। কল ধরছিলে না কেনো? প্লিজ, কি হয়েছে বলো।
প্রান্ত : কিছু হয়নি। আর এভাবে কল দিও না আমায়।
সদিচ্ছা : কিন্ত কেনো? বলবে তো।
প্রান্ত : তোমায় বলার মতো কিছু নেই আমার। আমার জন্যে অনেক সময় অপচয় করেছো তুমি। এখন থেকে নিজেকে সময় দাও। আমায় অনর্থক কল না দিয়ে ভালো করে পড়াশোনা করো। বিরক্ত করো না তো।
সদিচ্ছা : সব বুঝলাম, কিন্তু এভাবে বলছো কেনো?
প্রান্ত : বললাম না তোমায় কল না দিতে। ধমক দেয় প্রান্ত। সাথে সাথে কল কেটে যায়।
সদিচ্ছা কয়েকবার চেষ্টা করে। কিন্তু কিন্তু কোনো কল যাচ্ছে না আর। প্রান্ত ফোন বন্ধ করে দিয়েছে।
চার.
সদিচ্ছা চতুর্থ বর্ষের স্টুডেন্ট হলেও প্রান্ত এখনো তৃতীয় বর্ষে। একই ইয়ারমেট হলেও প্রান্ত একবছর পেছনে পড়ে গেছে সদিচ্ছার। একাডেমিকভাবে প্রান্ত এখন এক বছর জুনিয়ার সদিচ্ছার। সবই কপালগুণে হয়। দুজন দুই বিষয়ে পড়াশোনা করলেও তাদের রিলেশনশিপ যেমন করে অদ্ভুত, আজও অদ্ভুত এক পরিস্থিতিতে এসে দাঁড়িয়েছে। প্রাপ্তির বন্ধু-বান্ধবীরা এ নিয়ে বিভিন্ন কটূ কথা বললেও কিছু যায় আসে না সদিচ্ছার। সদিচ্ছার কেনো জানি মনে হয় মানুষ হিসেবে প্রান্ত অসাধারণ। আর বাকি সব কিছু সে প্রান্তের জন্যে বিসর্জন দিতে পারে শুধু প্রান্তকে পাওয়ার জন্যে। অথচ যে মানুষটিকে এতো বিশ্বাস করে সে ওই মানুষটি দিব্যি বদলে যাচ্ছে কোনো কারণ ছাড়া। খুব কষ্ট হচ্ছে এসব ভেবে। সদিচ্ছা ভাবতে পারে না এসব।
ইদানীং সদিচ্ছার ঘুম আসে না। শুধু কি সব চিন্তা এসে ভর করছে সময়ে অসময়ে। সেভাবে আর ভাবে। ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুম আসে সদিচ্ছার।
পাঁচ.
আজ রোববার। আজ সে তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠেছে। প্রান্তের সাথে দেখা করবে আজ। দেখা যে তাকে করতেই হবে। কতোগুলো প্রশ্নের উত্তর তার পাওয়া চাই। প্রান্ত উত্তর না দিয়ে পারবে না এসব প্রশ্নের। সদিচ্ছার সাথে দেখা হয় আয়ানের। আয়ান প্রান্তের ডিপার্টমেন্ট বন্ধু। আয়ানের কাছে জানতে পারে প্রান্ত গত দুই মাস কোনো ক্লাস করছে না। গত মাসে তিনবার দেখা হলেও প্রান্ত এ ব্যাপারে কিছুই বলেনি তাকে।
সব কিছু যেন অবিশ্বাস্য লাগছে তার কাছে। সদিচ্ছা আর নিজেকে বিশ্বাস করতে পারে না। আর স্থির থাকতে পারে না সে। রিকশা নিয়ে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে যায় সে। বাসার কেউ এভাবে সদিচ্ছার বাসায় ফিরে আসার কারণ নিয়ে ভাবে না। নিজের ঘরে গিয়ে অঝোরে কাঁদতে থাকে সে। কান্না যেনো থামতেই চায় না। চোখ দুটো ফুলে গেছে। নীল নয়না কাজল কালো চোখ লাল রক্তজবা হয়ে আছে।
ছয়.
আজ ডাক্তারের সাথে প্রান্তের দেখা করার কথা। গত দুই মাসে আজকেসহ পঞ্চমবারের জন্যে দেখা। প্রথম দিনের কথা আজও কানে বাজে তার। এ যেনো অবিশ্বাস্য ছিলো তার জন্যে। সব স্বপ্ন সেখানেই দুমড়ে-মুচড়ে যায়। দিগন্তবিস্তৃত সব স্বপ্ন মাটিতে নেমে আসে। হতাশা এসে ভর করে প্রান্তের রাজ্যে। গত বছরের ছোটখাটো উপসর্গগুলো অবহেলা না করলে হয়তো ব্রেন টিউমার ক্যান্সারে রূপ নিলেও এমন না-ও হতে পারতো। আজ এমন অবস্থায় প্রান্ত পৌঁছেছে যে আজ পৃথিবীর কোনো ডাক্তারের দ্বারাই তার চিকিৎসা সম্ভব নয়। সম্ভব হলেও প্রান্তের সেই সাধ্য নেই। মৃত্যু পথযাত্রী মানুষ কারো সঙ্গী হতে পারে না। কারণ অনিশ্চিত গন্তব্যে কেউ ভিড়ে না। এই অনিশ্চিত গন্তব্য শুধু একা নিজের। একাই যাওয়া যায় এখানে। কাউকে নিয়ে নয়। আজ এই পৃথিবীর কারো জন্যে উপযুক্ত নয় সে। সদিচ্ছার জন্যে তো নয়ই। প্রান্ত জানে সদিচ্ছা এই সব জানলে সহ্য করতে পারবে না। তাছাড়া কিভাবেই-বা দিবে এই খবর। সে জানে সদিচ্ছার মতো এতো বেশি ভালো অন্য কেউ বাসতে পারবে না তাকে। কিন্তু তার যে করার কিছুই নেই। তাই সদিচ্ছাকে কিছুই জানায়নি সে। হাতে সময় নেই খুব একটা। আর অল্প কিছু দিনের মধ্যে যে জীবনের গল্পের সমাপ্তি হবে তার।
পরবর্তী এক মাস যোগাযোগ নেই দুজনের। সদিচ্ছার এখন আর আগের মতো পড়াশোনায় মনোযোগ নেই। আর প্রান্ত বুকে পাথরচাপা দিয়ে নিজের নিয়তিকে মেনে নিতে প্রস্তুত। ...মৃত্যুর প্রহর গুণে প্রান্ত আর সদিচ্ছাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খায় বিরহ ব্যথা, প্রান্তের সাথে দেখা না হওয়ার ব্যথা, কথা না হওয়ার ব্যথা। দূরত্বের ব্যথা, চোখাচোখি না হওয়ার ব্যথা।
সাত.
মাসের ১ তারিখ আজ। সদিচ্ছার ফোনে রিং বেজে উঠলো, অপরিচিত একটি নাম্বার স্ক্রিনে ভাসছে। ভাবছে ফোন রিসিভ করবে, কি করবে না। অবশেষে ফোন রিসিভ করলো সে।
: হ্যালো, কে বলছেন?
: আমি প্রান্তের বন্ধু বলছি।
: হ্যাঁ, বলেন।
: আপনাকে একটু...হ হ হ...হহহ...হস্পিটাল আসতে হবে।
: কিন্তু কেনো? কোন্ হস্পিটাল?
: বাংলা মোটরের...। আপনি একটু তাড়াতাড়ি আসেন প্লিজ।
: আচ্ছা ঠিক আছে, আসছি।
আট.
বাসা থেকে বের হয়ে যায় সদিচ্ছা। রাস্তার অনেক জ্যাম। জ্যাম ঠেলে রিকশা এগিয়ে চলছে হস্পিটালেরর দিকে। প্রতিটি মিনিট যাচ্ছে চরম অস্থিরতায়, ভয়ে এবং অনিশ্চয়তায়। কি হয়েছে কে জানে! কোনো খারাপ কিছু নয় তো! ভাবতে থাকে সদিচ্ছা। কিন্তু কোনো কূলকিনারা খুঁজে পায় না সে। ইতিমধ্যে ২৬ মিনিট পার হয়ে গেছে। এখনো রিকশা সামনে চলছে। প্রায় ৩০ মিনিট পর হস্পিটাল পৌঁছে সদিচ্ছা।
দৌড়াতে দৌড়াতে দোতলায় উঠে।
সদিচ্ছার সামনে একটি মানুষের লাশ। আঁৎকে উঠে সদিচ্ছা। এ লাশ যে তার প্রিয় মানুষের। সদিচ্ছা সহ্য করতে পারে না এ দৃশ্য। মুহূর্তে আকাশ ভেঙ্গে পড়ে তার মাথায়। হাত পা অসার হয়ে আসছে, চোখে মুখে অন্ধকার দেখছে সে। অজ্ঞান হয়ে যায় সদিচ্ছা। কালের গর্ভে হারিয়ে যায় সব স্বপ্ন। চুরমার হয় জীবনের সব প্রত্যাশা। সদিচ্ছার জ্ঞান ফিরেছে ঠিকই কিন্তু মানসিকভাবে সে সুস্থ নয়। ডাক্তার বলেছে সদিচ্ছা আর কখনো ঠিক হবে কি না তারা নিশ্চিত নয়। সে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে গেছে।
প্রান্তের মৃত্যুর পর আজ দশ বছর হয়েছে। ভারসাম্যহীন হয়ে বেঁচে আছে সদিচ্ছা। চেহারায় আগের সে জৌলুষ নেই। উসকোখুসকো চেহারা। কেউ দেখে চেনার উপায় নেই এই মেয়েটি সেই লাস্যময়ী রাণী সদিচ্ছা। দিন আসে দিন যায়, সদিচ্ছা বেঁচে থাকে না থাকার মতো করে। নশ্বর পৃথিবী সদিচ্ছার সকল ইচ্ছেকে মেরে ফেলে, সঁপে দেয় প্রকৃতির হাতে, মহাকালের হাতে। যেখানে সব হিসেব মিলায় প্রকৃতি। আর মানুষ এখানে অযাচক হিসেবে তাকিয়ে থাকে হিসেবের দিকে, যে হিসেব কখনো মিলে না, মিলবার নয়। এই হিসেব যে মহাকালের অনিশ্চিত গন্তব্যের হিসেব।