প্রকাশ : ১৫ জানুয়ারি ২০২২, ০০:০০
আমার ‘রায় চৌধুরী’ দাদা কখনো সে আমার ডানে তো কখনো আমি তার। সে আগে কখনো, কখনো আমি তাঁর আগে। ঝগড়া লাগলে অপেক্ষায় থাকতাম কখন ফোন করে বলবে ‘কি রাগ কমছেনি আমনের, আইয়্যেন না কেন’। এমনই ছিলো দশবছর ধরে আমাদের সম্পর্ক।
বঙ্গবন্ধু আবৃত্তি পরিষদ চাঁদপুর জেলা শাখার সভাপতি পীযূষ কান্তি রায় চৌধুরীর সাথে সহ-সভাপতি মুক্তা পীযূষের মতের মিল হতো না প্রায় সময়। যে কোনো অনুষ্ঠানের সকল পরিবেশনা কেমন হবে সেটা আমার মতের সাথে এক না হলেই ঝগড়া শুরু করতাম আমি। আরে লোকে কি বলবে যদি অনুষ্ঠান খারাপ হয়! সব আপনার গান কবিতা আর এতো ছোট ছোট বাচ্চাকাচ্চা দিয়ে কি অনুষ্ঠান করবেন! দাদা খুব নরম সুরে আমাকে বলতেন, ‘শোনেন যারা জীবনে মঞ্চে উঠে গান গাওয়ার, আবৃত্তি করার সুযোগ পায় না আমি তাগো দিয়া সব করামু, যাতে লোকে তাগো চিনে, আর বড় বড় কবির কবিতার সাথে আমাগো কবিতাও থাকবো, যদি আমরাই লোকাল কবিগো কবিতা না পড়ি তই কারা পড়বো?’
২০০৯ সালের জানুয়ারির ২ তারিখ শুভ কল্পতরু উৎসবে পীযূষ কান্তি রায় চৌধুরী দাদার সাথে আমাকে প্রথম পরিচয় করিয়ে দেন রামকৃষ্ণ আশ্রমের নরেশ মহারাজ। ২০১২ সাল থেকে আমার প্রতেœর গানের গুরু হিসেবে রায় চৌধুরীকে পাওয়ার পরই আমাদের বন্ধন আরও দৃঢ় হয়। আসলে আমার বাবা বেঁচে থাকলে আমার ছেলেরা যে ভালোবাসা পেতো ‘রায় চৌধুরী’ তাই করেছেন।
২০১৫ সালে শ্রীকৃষ্ণের শুভ জন্মদিন জন্মাষ্টমীর রাতে বরাবরের মতোই আমরা রায় চৌধুরীর বাসায় গেলাম লুচি সুজি আর তালের বড়া খেতে; আমার ছোট ছেলে প্রখর পীযূষের আব্দার সে মাংস দিয়েই লুচি খাবে! অথচ তাদের দুদিন নিরামিষ খাওয়ার রীতি আমরা তা জানি। আমি তো বকাঝকা শুরু করলাম প্রখরকে, মীরা দিদিরও মন খারাপ কি করবে এখন, একে তো জন্মাষ্টমী আর প্রখরকেও খেতে দিতে হবে। রায় চৌধুরী দিদিকে বললো ‘শোন ডিপফ্রিজ থেকে রান্না করা মাংস বের করে গরম করে দাও প্রখরকে, কী জানি কোন দেবতা কখন কিসে তুষ্ট হয়’।
আমার মন খারাপ হলে রায় চৌধুরীর বাড়িই আমার কষ্ট লাঘবের স্থান হয়ে গেলো কখন বুঝতে পারিনি, সেখানে গিয়ে দাদার সাথে কথা বলে শান্তি মিলতো আমার। প্রতি বছরের ন্যায় দেয়া জেলাভিত্তিক শিল্পকলা সম্মাননা পদক, ২০১৭ সালেরটা আরও চারজনের সাথে পেয়েছেন রায় চৌধুরী দাদা, এ খবরটা যখন আমি জানতে পারলাম, তখন সবার আগে তাঁকে আমিই জানালাম।
আহারে দাদা শেষদিনও আমার কত বকা খেলো, কেনো সে অসুস্থ হলো, তাঁকে তো আরও বহুদিন বাঁচতে হবে আমার ছেলেদের আদর করতে।
সন্ধ্যায় তাঁকে বাড়ি নিয়ে আসবো বলে দুপুর দুইটায় হাসপাতাল থেকে বাসায় এলাম, বিকেল চারটা পঞ্চাশে দিদির ফোন এলো তাড়াতাড়ি আসো তোমার দাদা কেমন করছে, স্যালাইন খুলে ফেলতে চায়, অক্সিজেন মাস্ক ভালো লাগে না, তখনও দিদির ফোনে তাঁকে বকলাম এতো ছেলেমানুষি কেনো করছেন, দাঁড়ান আমি আসছি।
সন্ধ্যা ছয়টার একটু পরে পীযূষ কান্তি রায় চৌধুরী দাদা চলে গেলেন অমর্ত্যলোকে, জগতের মায়া ত্যাগ করে। ভালো থাকুন আমার রায় চৌধুরী দাদা অমর্ত্যলোকে।
লেখক : সভাপতি, বঙ্গবন্ধু আবৃত্তি পরিষদ, চাঁদপুর।