প্রকাশ : ১৫ জানুয়ারি ২০২২, ০০:০০
সাতশো কোটির অধিক মানুষ নিয়ে ভর-ভরান্ত সংসার পৃথিবীর। তার মাঝে সার্থক মানুষের সংখ্যা অতি নগণ্য। সফল মানুষ হয়তো অনেক কিন্তু সার্থকতার মানদ-ে এ সংখ্যা বেশি নয়। সার্থকতা মানে হলো পৃথিবীতে তাঁর পদচ্ছায়া রেখে যাওয়া। প্রাণে প্রাণে তাঁর সু ও সৎকর্মের তরঙ্গপ্রবাহ রেখে যাওয়া। প্রয়াত পীযূষ কান্তি রায় চৌধুরী একজন প্রশ্নাতীতভাবেই সার্থক মানুষ। সার্থক মানুষ নিজের সামর্থ্যকে ছাপিয়ে গিয়ে মানবতাকে বিভূষিত করেন তাঁর প্রাণের প্রজ্ঞায়।
আধ্যাত্মিক জনপদ চাঁদপুরের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিম-িত শাহরাস্তি উপজেলার শ্রীপুর গ্রামে দাসরাজবংশের ঐতিহ্যের সুরভি আত্মপরিচয়ে মেখে সাহাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন প্রয়াত পীযূষ কান্তি রায় চৌধুরী ওরফে অঞ্জন। পিতা ভুপেশ রায় চৌধুরী আর মাতা রেণু রায় চৌধুরীর তৃতীয় ছেলে অঞ্জনই সন্নিহিত অগ্রজের অতি অকাল প্রয়াণে হয়ে যান দ্বিতীয় পুত্রের মতো। আশৈশব সংস্কৃতি ও সাহিত্যের সরোবরে অবগাহিত হয়ে বিনির্মিত হওয়া এই সুকুমার দাসরাজবংশধর ক্ষুণিœবৃত্তির জন্যে রেলওয়ের সরকারি দায়িত্বে কর্মজীবনের সদ্ব্যয় করলেও সংগীত ও সাহিত্যে আত্মমগ্ন রেখে নিজেকে লক্ষ্মীর নয় বরং সরস্বতীর ¯েœহার্দ্র পুত্ররূপেই তপস্যায় ব্রতী হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধপূর্ব সময়ে চাঁদপুরের কুলীন সংগীত নিকেতনে যার সাংগীতিক কলাকুশলতার উপনয়ন ঘটে তাঁর হাতে সুরের স্বীকৃতি ওঠে ঊনিশশো আটাত্তর সালেই। নজরুল সংগীতে কুমিল্লায় প্রথম হয়ে তাঁর প্রতিভা শুরু করে পথচলা। এরপর হতে কীর্তন ও আধ্যাত্মিক সংগীত চর্চা তাঁকে করে তোলে গণমুখি। রাজপথে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের দাবিতে গাওয়া গণসংগীত কিংবা শিশু থিয়েটার ও অনন্যার জন্যে নেপথ্য সংগীতের অপরিহার্য কণ্ঠ হয়ে তিনি নিজেকে প্রমাণ করেছেন বহুমুখি প্রতিভা রূপে। যে কোনো সাংস্কৃতিক আন্দোলন ও প্রগতির যাত্রায় তিনি এক স্মরণীয় অগ্রসেনা। সংগঠক হিসেবে তাঁর প্রতিষ্ঠিত বঙ্গবন্ধু আবৃত্তি পরিষদ, চাঁদপুর তাঁকে দিয়েছে জাতীয় বিস্তার। আগামী প্রজন্ম হতে শিল্পী ও যোগ্য মানুষ তৈরিতে তাঁর শ্রম উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে উক্ত সংগঠনের পরিচয়ে গর্বিত হয়ে। তাঁর অবদানের যোগ্য সম্মাননায় তিনি লাভ করেছেন জেলা শিল্পকলা একাডেমী সম্মাননা, চাঁদপুর-২০১৮। বিটিভির তালিকাভুক্ত এ গীতিকারের একটি গান ‘শত গানে বঙ্গবন্ধু’ গ্রন্থে স্থান পেয়েছে। মাছরাঙার ‘রাঙা সকাল’ তাঁকে নিয়ে একঘণ্টাব্যাপী অনুষ্ঠান প্রচার করেছে।
তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থে অসাম্প্রদায়িকতা যেমন ফুটে উঠেছে তেমনি বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাঁর প্রগাঢ় নিবেদনও প্রস্ফুটিত হয়েছে। তাঁর গ্রন্থে মিঠাজলের রূপালি ইলিশেরা বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে। শাহরাস্তির দুই সম্প্রদায়ের দুই সাধকের জীবনবৃত্ত নিয়ে তাঁর গবেষণা-প্রয়াস উল্লেখ করার মতো।
কেবল সাহিত্যে নয়, নিজের জীবনেও তিনি অসাম্প্রদায়িকতার চর্চা করেছেন মনের গহীন হতে। যতো মত ততো পথের রামকৃষ্ণ আর অভিক্ষা মন্ত্রের উদ্গাতা স্বামী স্বরূপানন্দ তাঁর মনের শেকড়ে দিয়েছেন উদারতার নির্যাস। নিজের মেয়ের মতো মমতায় তিনি আয়েশাকে সাক্ষরতা জ্ঞানই শুধু দেননি, তাকে হেঁশেলে বিচরণের দায়িত্বও অর্পণ করেছেন অবাধ। সংগঠনের ইফতার মাহফিলে যেমন তিনি রোজাদার সংস্কৃতি কর্মীদের ইফতার করাতেন, তেমনি ঠাকুরের ভোগ শেষে লব্ধ প্রসাদে নিজের জঠর জ্বালা মিটিয়েছেন।
প্রয়াত পীযূষ কান্তি রায় চৌধুরী সহজ মানুষ কিন্তু আলোকিত সত্তা ছিলেন বিধায় তাঁকে নিয়ে প্রয়াণের দুবছর পরেও স্মৃতিচারণের সভা আয়োজিত হয়। বড় ভাইয়ের হোমিওপ্যাথির চর্চায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনিও কিছুটা দক্ষতা অর্জন করেন এ বিষয়ে।
সংগীতবিষয়ক মাসিক ম্যাগাজিনের তিনি চাঁদপুর জেলা প্রতিনিধি হলেও তেমন কোনো উচ্চবাচ্য ছিলো না তাঁর। সৃজন ও সংসারে তিনি গোছানো ছিলেন বলেই মৃত্যুর পরও তার সহধর্মিণী মীরা রায় চৌধুরীকে কারো গলগ্রহ হতে হয়নি।
প্রয়াত পীযূষ কান্তি রায় চৌধুরী সমকাল সুহৃদ সমাবেশের সভাপতি থাকলেও অন্যান্য সদস্যদের কাছে তিনি নিজের মহৎ জীবনাচরণের কারণেই সাদামাটা। খুব কম কষ্ট পেয়ে পরিণত বয়সে তাঁর প্রয়াণ হলেও তাঁর জীবনোত্তর সময়ে তিনি হয়ে উঠেছেন তাঁর উত্তরসূরিদের কাছে উদ্যাপনীয় এক সার্থক মানুষের উপমা।
তাঁর দ্বিতীয় প্রয়াণবার্ষিকে আমাদের বিন¤্র শ্রদ্ধা।