প্রকাশ : ০৮ জানুয়ারি ২০২২, ০০:০০
লোকটার মুখের দিকে ভালো করে তাকানোর সাহস আমার হয়নি। একবার মাত্র তাকিয়েছিলাম। তাতেই আমার বুকের রক্ত হিম হয়ে এসেছিল। শুকনো হাড় জিরজিরে শরীর, চোখ দুটি এতটাই গর্তে বসা, যেন মনে হয় কেউ তুলে নিয়েছে। শরীরের চামড়া কুঁচকে গিয়েছে। দুচোখে কিসের যেন আকুতি। আমি চোখ নামিয়ে নিলাম। এমন মুখের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকার মতো সাহস আমার নেই।
সোলায়মান ফরাজী আজ দুদিন হলো আমাদের বাসায় এসেছেন। বাসা বলতে একটি টিনশেড বাড়ির দোতলা ভাড়া নিয়ে আমরা চারজন থাকি। আমার পাশের রুমে থাকে সোহেল। সোলায়মান ফরাজী সোহেলের বাবা। বাড়ি বগুড়ার শেরপুরে। ছেলের কাছে এসেছেন ডাক্তার দেখাতে। তার ধারণা, শহরের নামকরা ডাক্তার দেখালে রোগ নিশ্চয় ভালো হয়ে যাবে।
সোলায়মান ফরাজী খুক খুক করে কাশছেন। অনেকক্ষণ হলো তার কাশি চলছে। কিছুতেই থামছে না। আমার পাশের রুম হওয়াতে সব শব্দ স্পষ্ট শোনা যায়। বৃদ্ধ মানুষ, তার ওপর ছেলে রুমে নেই। আমি পাশের রুমে গেলাম। দরজা ভেজানো ছিল। হালকা ঠেলা দিতেই খুলে গেল।
‘আসতে পারি চাচা?’
অনুমতি প্রার্থনা করে হালকা সুরে বললাম।
‘এসো বাবা।’
তিনি তখনো কেশে চলেছেন। আমার কথার যখন জবাব দিলেন, তখনো কাশছেন।
‘কী হয়েছে আপনার চাচা?’
‘এই কেমন যেন কাশি আসে সবসময়। বুকের ভেতর তীব্র জ্বালা। খুব কষ্ট হয় বাবা।
সোলায়মান ফরাজীর চোখে অশ্রু এসে জমা হলো। তিনি নিজেকে সামলে নিলেন।
‘ছেলেকে অবশ্য ব্যথার কথা কিছু বলিনি। ও ভয় পেতে পারে।’
‘ডাক্তার দেখানো কি হয়েছে?’
‘হ্যাঁ, ডাক্তার রিপোর্ট করতে দিয়েছে। রিপোর্ট হাতে পেলে বোঝা যাবে আসলে কী হয়েছে।’
‘ইনশাআল্লাহ রিপোর্টে ভালো কিছুই আসবে। আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।’
সান্ত¡না দেওয়ার জন্য এর চেয়ে ভালো কোনো কথা আমি খুঁজে পেলাম না।
প্রসঙ্গ পাল্টানোর চেষ্টা করলাম। অসুখ-বিসুখ নিয়ে যত বেশি কথা বলবো মন ততই খারাপ হতে থাকবে।
‘বাড়িতে কী কাজ করেন চাচা?’
সোলায়মান ফরাজী প্রথমে আমার প্রশ্নটি ঠিকমতো বুঝতে না পেরে ফ্যালফ্যাল করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
আমি আবার প্রশ্ন করলাম, ‘আপনার পেশা কী চাচা?’
এবার উনার মুখে হাসি ফুটে উঠল। তারপর বললেন, ‘মূর্খ মানুষ বাবা। সবকথা ঠিকমতো বুঝতে পারি না। কিছু মনে কোরো না। আমি একজন কৃষক। নিজের অবশ্য তেমন জায়গা-জমি নেই। অন্যের কিছু জমি চাষ করি।’
‘শুনেছি আপনার আরেকটি ছেলেও সরকারি কলেজে পড়াশোনা করে। এদের দুজনের খরচ চলে কীভাবে?’
‘দুইটা গাভী আছে। প্রতিদিন গাভীর দুধ বিক্রি করে টাকা জমাই। মাস শেষে ছেলেদের টাকা পাঠাই।’
আমার বিস্ময়ের অন্ত থাকে না। আমি আবার প্রশ্ন করি, ‘গাভীর দুধ বিক্রির টাকায় সংসার চালিয়ে আবার ছেলেদের টাকা পাঠান কীভাবে?’
সোলায়মান ফরাজী এবার একটু হাসলেন। তার চোখ দুটি জ্বলজ্বল করে উঠল। তারপর বললেন, ‘একজন বাবা তার সন্তানের জন্য কতটুকু করতে পারে তা সাধারণ মানুষ বুঝবে না। আগে বাবা হও, তারপর ঠিকই সব বুঝবে।’
তার কথার মর্ম উদ্ধার করা আমার সাধ্য নয়। আমি তখনকার মতো বিদায় নিয়ে রুমে ফিরে এলাম।
বিকালবেলা সোহেল বাসায় ফিরে এলো। হাতে সব পরীক্ষার রিপোর্ট। ওকে কেমন যেন বিধ্বস্ত লাগছে। আমার বুকের ভেতর একটা ভয়ার্ত শিরশিরে অনুভূতি জেগে উঠল। সোহেলকে পাশে বসিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী হয়েছে সোহেল? রিপোর্টে কি খারাপ কিছু এসেছে?’
সোহেলের কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে এলো। কোনো রকমে বলল,‘ বাবাকে বোধহয় বাঁচানো গেল না ভাই!’
আমি সোহেলের হাত থেকে রিপোর্টের ফাইল নিয়ে চোখ বুলালাম। আমার অনভিজ্ঞ চোখে তেমন কিছুই ধরা পড়ল না। আমি ব্যাকুল হয়ে প্রশ্ন করলাম, কী হয়েছে আমার কাছে অন্তত বল।’
সোহেল গলার স্বর নামিয়ে বলল, ‘বাবার ফুসফুসে ক্যান্সার ধরা পড়েছে। সর্বশেষ পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। বাবা মারা গেলে আমাদের কী হবে?’
সোহেল কান্নায় ভেঙে পড়ল। আমি ওকে সান্ত¡না দিয়ে বললাম, ‘কান্নাকাটি করে কী হবে! ধৈর্য ধরো ভাই।’
এর চেয়ে বেশি কিছু বলার সামর্থ্য আমার নিজেরও আসলে নেই।
সন্ধ্যার সময় সোহেল রুমে ছিল না। এই ফাঁকে চাচা আমার রুমে এলেন। তাকে অনেক বেশি ক্লান্ত এবং বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে। চাচা আমার পাশে এসে বসলেন। তারপর আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘তোমরা বোধহয় আমার কাছে কিছু লুকোচ্ছো!’
আমি অবাক হওয়ার ভান করে বললাম, ‘কী বলছেন চাচা! আপনার কাছে আমরা কী লুকোবো!’ আমার কণ্ঠস্বর নিজের কাছেই কেমন যেন অপরিচিত লাগল।
চাচা ধীরে ধীরে বললেন, ‘আমি জানি আমার কী হয়েছে। এ রোগ আমার বহুদিনের। ধূমপান করতাম সেই ছোটবেলা থেকে। অভ্যাসটি আর ছাড়তে পারিনি। বুকের ভেতর এখন খুব বেশি ব্যথা হয়। শ্বাস নিতে বড্ড কষ্ট হয় বাবা।’
‘আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। সোহেল ওষুধ আনতে গেছে। সব ঠিক হয়ে যাবে।’
‘আমাকে মিথ্যা সান্ত¡না দিচ্ছ কেন বাবা? আমি আসলে নিজেকে নিয়ে কোনো চিন্তা করছি না। আমার বয়স হয়েছে। একদিন এমনিতেই চলে যেতে হবে। আমি বেশি দুশ্চিন্তা করছি আমার সন্তানদের নিয়ে। আমি মারা গেলে ওদের কী হবে? অন্তত একজনের পড়াশোনা এমনিতেই বন্ধ হয়ে যাবে।’ সোলায়মান ফরাজী ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন। তার সফেদ দাড়ি চোখের জলে ভিজে একাকার হয়ে গেল। আমি সান্ত¡না দেওয়ার কোনো ভাষা খুঁজে পেলাম না। নিজের চোখ বেয়েও তখন ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে।