রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২২ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ০২ জানুয়ারি ২০২২, ০০:০০

হঠাৎ ভালোবাসা

হঠাৎ ভালোবাসা
মরিয়ম আক্তার

ভাবতে পারেন, একটা মানুষকে আমরা কতটা ঘৃণা করলে তার মৃত্যু কামনা করতে পারি? অথচ তার সাথে এতোটাই স্বাভাবিক আচরণ করি যেনো সে আমাদের অনেক প্রিয়!

আমার সহ্যসীমা সম্পর্কে আপনার ধারণা নেই সাহেব। আমি এমন একটা মানুষকে ২৪দ্ধ৭ সহ্য করেছি যাকে আমি প্রচ- ঘৃণা করি। এতটাই ঘৃণা করি যে তাকে আমি মনে মনে হাজারবার খুন করে নিজেকে ঘৃণামুক্ত করেছি। যদি পৃথিবীতে একটি মানুষকেও খুন করা জায়েজ হতো তাহলে সেই কবেই আমি এই মানুষটাকে শেষ করে ফেলতাম। সে সম্পর্কে আমার কি হয় জানতে চাইবেন না?

: আমরা অযাচিত কোনো কারণে কাউকে ঘৃণা করি না। আর যাকে তাকে তো না-ই!

সে হয়ত একসময় আপনার খুব বেশি প্রিয় ছিলো.. যার কাছ থেকে আপনার আশা ছিলো অনেক বেশি কিছু, সে আপনার আশা ভেঙ্গে আপনারই সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছে কোনো আফসোস আক্ষেপ ছাড়াই। আর আপনি তার বর্তমান স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবন দেখে আপনার সাথে ঘটা খারাপ দৃশ্যগুলো কল্পনা করে তার প্রতি নিজের ঘৃণার পরিমাণ বাড়াচ্ছেন। আপনার এক সময়কার খুব প্রিয় মানুষটি যাকে আপনি খুব করে চাইতেন বর্তমানে সে আপনার খুব বেশি অপ্রিয় যাকে আপনি খুব করে শেষ করতে চাইছেন। এবার সে আপনার সম্পর্কে কি হয় না হয় তা জানানোর দায়িত্ব সম্পূর্ণ আপনার।

: বিশ্বাস করবেন কি না জানি না আমি তাকে একবার খুন করতেই চলেছিলাম...একটুর জন্য মানবতা বোধটুকু জন্মেছিলো বলে বেঁচে গিয়েছে।

যদি সে আমার জন্মদাতা না হতো তাকে আমি সেদিনই শেষ করে ফেলতাম। তার ভাগ্য কত ভালো যে আমার মানবতা বোধটকু অন্তত সময়মত জাগ্রত হয়েছে! যদি তা না হতো তাহলে এতোদিনে তার নাম স্মৃতির পাতায় খচিত হতো। আফসোস, এই মানবতা বোধটুকু যদি ওনার মধ্যে আসতো! তাহলে আমাদের এতো ভুগতে হতো না। আমি তাকে কতটা ঘৃণা করি তার পরিমাপ কেউ করতে পারবে না।

: সে আপনার জন্মদাতা!!!

: অবাক হলেন? যে কোনো সন্তান কেনো তার জন্মদাতাকে মেরে ফেলতে চাইছে?

আমার তাকে বাবা বলে ডাকতেও ইচ্ছা করে না। এমনকি-করে আসে জাবিন। শুভ্র সুন্দর নিষ্পাপ এই মুখটির শুধু ডান পাশটুকু দেখতে পারছে আশরাফ। গালের মাঝ বরাবর থেকে থুতনি পর্যন্ত বড় কাটা দাগ। ভয়ংকর করে তুলেছে এই দাগ জাবিনের মুখচ্ছবি। দাগটি দেখা মাত্র আশরাফ হকচিয়ে গেলো, মনে জাগলো কয়েকটি প্রশ্ন।

তবুও আপাতত সে কিছুই বললো না। জাবিনের মুখ থেকে শুনবে বলে অপেক্ষায় রইলো।

পানি খাওয়া শেষে গ্লাসটি টেবিলে রাখার সময় খেয়াল করলো আশরাফ তার দিকে তীক্ষè দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আশরাফের দৃষ্টিকে পরোয়া না করে জাবিন তার কাহিনির বাকিটুকু বলতে শুরু করলো।

: আমার বাবা আর মায়ের বিয়ে হয় আমার দাদা-দাদু আর নানা-নানুর মতানুযায়ী। আমার আম্মু শ্যামবর্ণের হওয়ায় বাবা তাকে মেনে নিতে পারেননি। আম্মুকে বিয়ে করা ছিলো দাদা-দাদুর মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে তাদের হাত করে রাখা। বিয়ের পরেও তিনি বাহিরে তার প্রেমলীলা চালিয়ে যেতে থাকলেন।

আম্মুকে বিয়ের তিন মাসের মাথায় তিনি তার পছন্দমত সুন্দরী নারীকে বিয়ে করে আরেক বাসায় দিন-রাত্রী যাপন শুরু করলেন। ততদিনে উনি কিন্তু একবারো আমার মাকে এটা বুঝতে দেন নি যে উনি তাকে অপছন্দ করেন। দুইটা সংসার নির্দ্বিধায় চালিয়ে যেতে থাকলেন। আব্বু আম্মু কাজের সূত্রে ঢাকা শহরে বাসা ভাড়া থাকতেন আর দাদা দাদু গ্রামের বাড়ি। একবার কি হলো আব্বু প্রায় ৩ দিন বাসায় আসলেন না। আম্মু আব্বুর টেনশনে পাগলপ্রায়। আম্মুকে আব্বু তখনো কোনো মোবাইল দেয়নি যে আম্মু যোগাযোগ করবে আব্বুর সাথে। এই তিন দিন আব্বু কোথায় ছিলো জানেন? তার সেই নতুন বউয়ের কাছে। সে তখন অন্তঃসত্ত্বা। অথচ আমার মা ও কিন্তু অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন ওনার দিকে তার বিন্দুমাত্র খেয়াল নাই। তিনদিন পর আব্বু বাসায় আসায় আম্মু যখন চিৎকার-চেচামেচি-কান্নাকাটি করে এটা জানতে চাইলো যে উনি কোথায় ছিলেন? তিনদিন কিভাবে কেউ নিজের অন্তঃসত্ত্বা বউকে ছেড়ে অন্যত্র থাকতে পারে? উনি কি করলো তখন, আমার অন্তঃসত্ত্বা মাকে বেধড়ক মারলেন। শেষ পর্যন্ত মার খেতে খেতে যখন আম্মু অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলো তখন ওনার হুঁশ আসলো। কিন্তু তখন হুঁশ এসেও কোনো লাভ হয়নি ততক্ষণে আম্মুর মধ্যে বেড়ে ওঠা ছোট্টো প্রাণটি দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করেছিলো। এরপর ভাবছেন হয়তো ওনার দয়া হবে আম্মুর উপর, দৌড়াদৌড়ি করে হয়তো আম্মুকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছে, ডাক্তার ডাকাডাকি করে আম্মুর জ্ঞান ফিরাতে বলেছিলো, আম্মুর কিছু হলে ডাক্তারকে ছেড়ে দিবে না দেখে নিবে এমন হুমকিও দিয়েছিলো...তাই না? কিন্তু মজার ব্যাপার কি জানেন? উনি আমার সেই মার খেয়ে গর্ভপাত হয়ে যাওয়া মাকে রক্তাক্ত অবস্থায় ফ্লোরে ফেলে দিয়ে অন্য রুমে গিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে গিয়েছেন। ভেবেছিলেন এই কালী বউ মরে গেলেই ভালো। বেঁচে থাকলেই বরং ক্ষতি হতো। দুই দুইটা সংসার চালানো তো আর মুখের কথা নয়! কিন্তু দুর্ভাগ্যবসত আমার মা তখন বেঁচে যায়!

সেই থেকে শুরু হলো আমার সাধারণ, সহজ-সরল মায়ের কঠিন হওয়া। একা একাই বাঁচতে চির শিখছিলেন। স্বামী থাকা সত্ত্বেও একা থাকা নিশ্চয়ই কোনো নারীর জন্য সুখের হবে না? আমার মায়ের জন্যেও হয়নি। আচ্ছা ইনি কি আদৌ স্বামী হওয়ার যোগ্যতা রাখে!

এই ঘটনার তিন বছর পর আম্মু আবার অন্তঃসত্ত্বা হয় এবং আমার জন্ম।

ওনার সেই দুই নম্বর বউয়ের বাচ্চা কিন্তু দুনিয়ার আলো দেখতে পারেনি। ওনারও গর্ভপাত হয়ে যায় বাথরুমে পা পিছলে পরে গিয়ে। যেহেতু ওনার দুই ঘরের দুই সন্তান গর্ভপাত হওয়ার পর তৃতীয়ত আমার জন্ম আমার সেই শ্যামবর্ণা মায়ের ঘরে তাই আমি ছিলাম তার স্বর্গসুখের কারণ। তখন আমার মায়ের প্রতি তার মায়া জন্মায়। কেনো না ওনার সেই স্ত্রী আর সন্তান জন্ম দিতে পারবে না। অক্ষম সে! আমাকেই তখন সর্বোচ্চ আদরে বড় করতে শুরু করলেন।

আমার যখন ১০ বছর বয়স আব্বুর সেই দ্বিতীয় বউ আমাদের বাসায় এসে যা তা বলে আমার সামনে আমার মাকে গালিগালাজ করলো। এর আগে আমাকে বাবা বা মা কেউই বাবার দ্বিতীয় পক্ষের বউয়ের কথা জানায়নি। বাবা তখন বাসায় না থাকলেও ওনাদের বাচনভঙ্গি, বাবাকে নিয়ে তর্ক থেকে এটা ঠিকই বুঝতে পারলাম যে উনি আমার বাবার নাজায়েজ স্ত্রী! আমার তখন পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গিয়েছিলো এমন অবস্থা। যেই বাবাকে আমি ফেরেশতা মানতাম শেষ পর্যন্ত তার এই রূপ বের হলো!

তখন থেকে বাবার প্রতি আমার ঘৃণা জন্মাতে শুরু করে। বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী আমাদের বাসা থেকে যাওয়ার পর মা সেদিন অনেক কান্না করেছিলো। এর আগে আমি মাকে কবে কান্না করতে দেখেছিলাম মনে আসছিলো না। তারপর মা যখন আস্তে আস্তে কান্না থামিয়ে শান্ত হয়েছে তখন বাবার করা শুরু থেকে এই পর্যন্ত সমস্ত অত্যাচারের কথা আম্মু আমাকে খুলে বলে। বাবার প্রতি অসীম রাগ, ক্ষোভ, ঘৃণা জন্মাচ্ছিলো মুহূর্তে মুহূর্তে। যে মানুষটাকে আমি দুনিয়ার সেরা স্বামী, সেরা বাবা মানতাম তার এই নিকৃষ্ট রূপ আমার সহ্য হচ্ছিলো না। মনে মনে তাকে শেষ করার প্রতিজ্ঞা করলাম।

এতটুকু কাহিনি বলার পর জাবিন কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো। আশরাফ এতোক্ষণ তার প্রতিটা কথা খুব মনোযোগের সাথে শুনেছে। ইশ! কিছু মানুষের জীবনে কত কষ্ট থাকে। কত কাহিনি থাকে যা কাউকে বলা যায় না, বললে যে পরিবার-নিজের সম্মানহানি হবে, অপমানজনক হবে! তাই তো সব মানুষদের উচিত নিজের মধ্যে এক গভীর কবর খনন করা। যার মধ্যে তারা দাফন করতে পারবে নিজের সব দুঃখ, কষ্ট, আপন মানুষদের থেকে পাওয়া অবহেলা, অবজ্ঞা, না বলা কথা। দাফন করলেই তো শেষ!

জাবিন আরো এক গ্লাস পানি খেয়ে আবার তার গল্প বলা শুরু করলো।

সেদিন বাবা কেনো জানি বাসায় ফিরলেন না। বাসায় না আসার জন্যে তার প্রতি রাগ আরো বেড়ে যাচ্ছিলো। পরের দিন সকালে খবর পেলাম বাবার দ্বিতীয় স্ত্রীর বস্তাবন্দি মৃত কাটা লাশ উদ্ধার করা হয়েছে তার বাসার নর্দমার মধ্যে! টোকাই বাচ্চা বোতল কুড়াতে গিয়ে নর্দমায় বড় রক্তে ভেজা বস্তা দেখতে পেয়ে চেচামেচি করে মানুষ জড়ো করে। শরীর থেকে মাথা আলাদা করা এক নারীর বিবস্ত্র লাশ! কতটা জঘন্যভাবে মারা হয়েছিলো তাকে! যারা যারা লাশ দেখেছে শিউরে উঠেছে তারা। যে নরপিশাচ তার গলা কেটেছিলো তার আগে তাকে হিং¯্র জানোয়ারের মতো মেরেছে। যাতে ব্যাথায় কাতরাতে কাতরাতে জান যখন বের হয়ে যাওয়ায় তড়পাবে তখন সে গলা কাটবে তার।

এই খবর পাওয়ার পর আম্মু আর আমি খুব হকচকিয়ে গিয়েছিলাম কিন্তু বাবা ছিলেন একদম নির্বিকার। এই খুনের কোনো রূপ প্রমাণ পায়নি নিরাপত্তা বাহিনী। যেনো একসময় এমনটা হওয়ারই ছিলো এমন আচরণ করেছিলেন বাবা! একদম নির্বাক ছিলেন ওনার দ্বিতীয় স্ত্রী খুন হবার পরেও। যা আমার আর আম্মুর মনে সন্দেহ যোগায়।

তখন থেকে বাবা তার আসল রূপ দেখানো শুরু করেছে। এই দশ বছর উনি আম্মুর গায়ে একবারো হাত তোলেনি, গালিগালাজ করেনি, খারাপ ব্যবহারও করেনি। কিন্তু সেইদিন! সেদিন থেকে আমাদের দিন খারাপ হওয়া শুরু। আম্মুর সাথে সাথে উনি আমাকেও মারা শুরু করলেন। তার আদরের চোখের মণি হয়ে উঠলো চোখের বালি!

এই যে আমার গালে কাটা দাগটা দেখলেন এটা ওনার মারের ফলেই হয়েছে। ভাঙ্গা কাঁচের টুকরো দিয়ে উনি আমার গালে গায়ে আঁচর কেটে দিলেন যাতে করে কাউকে আমি আমার এই মুখ দেখাতে না পারি। আমার গালে এই দাগ কাটা হয় আমি যখন কলেজে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি। ক্লাসের এক ছেলের সাথে আমার খুব সখ্যতা গড়ে উঠে আর বাবা তা জানতে পেরে যায় এবং এর শাস্তিম্বরূপ আমার গায়ে হাত তোলেন।

এরপরেও আমি ওনার সাথে খুব ভালো ব্যবহার করতে থাকি। ওনার কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করতাম। ওনার সাথে আগের মত মিলেমিশে থাকতে চেষ্টা চালাতে থাকলাম এবং একদিন সফল হলাম। বাবা আবার আমার সাথে আগের মত ব্যবহার করা শুরু করলেন। আবারো হয়ে উঠলাম আমি তার চোখের মণি! তার সাথে ভালো আচরণ করার একটাই উদ্দেশ্য তাকে শেষ করা! যা ছিলো আমার নিজের কাছে করা প্রতিজ্ঞা।

(আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়