প্রকাশ : ২৫ ডিসেম্বর ২০২১, ০০:০০
ঘড়িতে পাঁচটা বেজে চুয়াল্লিশ মিনিট। টিএসসিতে দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে একাকী বসে আছে প্রান্ত। মাঠের ঘাসগুলো মেশিনে কেটে ছোট করা হয়েছে। পুরো মাঠ বিস্তর মসৃণ। চারদিকে শোরগোল। চারজন ছেলে গ্রুপে গিটারের সাথে পাল্লা দিয়ে দিয়ে গান গাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করে যাচ্ছে। সুর-তাল-লয় কিছুই ঠিক নেই। দেখেই বোঝা শক্ত নয় যে এরা অপেশাদার। নিতান্ত শখের বশে গান গাওয়া। মানুষ গিজগিজ করছে এখানে। আগে শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আর শিক্ষার্থীদের জন্যেই ছিলো এটি। এখন পুরো ঢাকা শহরের মানুষের আড্ডাখানা যেনো। মানুষগুলো এখানে এসেছে যেনো এক মিলনমেলায়।
প্রান্তের মন ভালো নেই। আজ-কাল মন ভালোর চেয়ে খারাপই বেশি থাকে। মন খারাপ হলেই এখানে এসে বসে থাকে সে। এক আশ্চর্য বিষয় লক্ষ্য করেছে সে। এখানে আসলে মন কেনো জানি ভালো হয়ে যায় তার। হঠাৎ সামনে এসে দাঁড়ায় এক ছোট ছেলে। হাতে কিছু ফুল। গোলাপ, রজনীগন্ধা সাথে কিছু বেলী ফুলের মালা।
ছেলে : ভাইয়া ফুল নিবেন?
প্রান্ত : না, দরকার নাই।
ছেলে : ভাইয়া একটা গোলাপ নেন।
প্রান্ত : বললাম না আমার লাগবে না। যাও এখান থেকে।
ছেলে : ভাইয়া টাকা লাগবে না, একটা দিই?
এবার প্রান্ত লজ্জা পায়। কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে। ছোট ছেলেটির কাছে পরাস্ত হয় সে। মনে মনে ভাবলো একটা গোলাপ না হয় নেই!
প্রান্ত : আচ্ছা ঠিক আছে। আগে বলো তোমার নাম কি?
ছেলে : স্বাধীন।
প্রান্ত : তোমার নাম তো বেশ সুন্দর। তোমার নামের অর্থ কি জানো তুমি?
ছেলে : জ্বি, জানি। আমার নামের অর্থ মুক্ত।
প্রান্ত : তো তুমি ফুল বিক্রি করো কেনো? তোমার আব্বু-আম্মু কি করে?
ছেলে : আমার বাবা আমাদের সাথে থাকে না। আমি আর মা একসাথে থাকি। মা অন্যের বাসায় কাজ করতো। অনেক দিন কি জানি ব্যারাম হইছে। এখন আর কাজ করতে পারে না। আমি এজন্যে ফুল বিক্রি করি।
প্রান্ত : তোমার আব্বু তোমাদের সাথে থাকে না কেনো?
ছেলেটি কেনো জানি উদাস হয়ে গেলো। মুখ দিয়ে কথা বের হওয়ার চেয়ে চোখই বেশি কাজ করছে যেনো। দু’চোখ বেয়ে যেনো অশ্রু নামছে। প্রান্ত অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। এমন কিছুটা হতে পারে ভাবেনি সে। তারপর ছেলেটি আবার শুরু করলো।
ছেলে : আমার আব্বা মারা গেছে। আমরা চরে বস্তিতে থাকতাম। আব্বা রিকশা চালাইতেন। একদিন জ্বর নিয়ে সক্কালে বাইর হইছিলেন। দুপুরে আইসা আমাগো লগে খ্যাইয়া গেছিলেন। রাতে খবর আসলো আব্বা বাসের সাথে এক্সিডেন্ট করছেন। বাস আইসা পিছনে ধাক্কা দেয়। আব্বাসহ আরও দুইজন মারা যায়।
প্রান্ত : তারপর?
ছেলে : বাস মালিকের আমাগো জন্য কিছু টাকা দেওনের কথা আছিলো। পরে টাকাগুলা আর আমাগোরে দেই নাই। কারা যেনো ঐ টাকা খাইয়া পালাইছে। তখন আমি থ্রিতে পইড়তাম। পরে মা অন্যের বাসায় কাজ নেয়। ব্যারাম হওনের পর থেইক্যা আমি ফুল বেচি। আর মারে কিছু কিছু টাকা দেই। সারাদিন ২০০/২৫০ টাকা বেচতে পারি। আবার কোনো কোনো দিন ৫০ টাকা বেচি। কেউ কেউ ফুল কিনতে চায় না। অনেকে আবার বকা দেয়। একথা শুনেও প্রান্ত লজ্জিত হয়। নিজের কাছে নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। এই তো শুরুতে সে নিজে ও খারাপ ব্যবহার করেছে। প্রান্ত অনুতপ্ত নিজের আচরণের জন্যে।
প্রান্ত : তুমি আজকে কত টাকার ফুল বিক্রি করেছো?
ছেলেটি শার্টের পকেট থেকে সবগুলো টাকা বের করে। বেশির ভাগ ভাংতি টাকা। গুণে সব মিলিয়ে ৯৩ টাকা।
প্রান্ত : তোমার কাছে যতোগুলো ফুল আছে সবগুলো কতো দিয়ে বিক্রি করবে?
ছেলে : একটা গোলাপ ১০ টাকা বেচি। ফুলের মালা ২০ টাকা। কেউ কেউ ৫ টাকা ও দেয়। আবার কেউ কেউ বেশি ও দেয়।
প্রান্ত : আমি তোমার সব ফুল কিনবো। কতো টাকা দিতে হবে তোমাকে?
ছেলেটির বিশ্বাস হচ্ছিলো না। সে ভাবলো প্রান্ত তার সাথে দুষ্টুমি করছে।
ছেলে : আপনি তো কইছিলেন ফুল লাগবো না আপনার!
প্রান্ত : হ্যাঁ, বলেছিলাম। কিন্তু এখন তোমার সব ফুল আমি কিনবো। এই নাও ৩০০ টাকা।
ছেলে : আমার ফুলের তো এতো দাম নাই। আপনি কিনলে আমায় ১৫০ টাকা দেন।
প্রান্ত : আচ্ছা, ঠিক আছে। এই নাও তোমার টাকা।
স্বাধীন খুব খুশি। এক সাথে সব ফুল বেচা হয়ে গেছে। আজ তাড়াতাড়ি মার কাছে যেতে পারবে।
প্রান্ত : চল আমার সাথে!
ছেলে : কই যাইবেন ভাই?
প্রান্ত : দেখো আমি কি করি।
প্রান্তের হাতে সবগুলো ফুল। স্বাধীন তার পেছনে পেছনে। তার মাঝে কৌতূহল কাজ করছে। কি করবে এই ভাই!!
প্রান্ত নিজের টাকায় কি না ফুলগুলো নিয়ে টিএসসিতে বসে থাকা মানুষগুলোর সামনে সামনে যাচ্ছে। লক্ষ্য ফুল বিক্রি করা। আজ সে নিজেই ফুল বিক্রেতা।
প্রান্ত : এই আপু! একটা গোলাপ নিন। না হয় একটা বেলি ফুলের মালা নিন। একবারে তাজা ফুল। আপনার খোঁপায় ভালো মানাবে। অন্য কাউকে-এই ভাই একটা ফুল দিবো? প্রান্ত থেকে সবাই ফুল কিনছে। এইভাবে ৩০ মিনিটে সবগুলো ফুল বিক্রি করে ফেলে প্রান্ত। ফুল বিক্রি শেষে টাকা গোণার পালা। সব মিলিয়ে ৬৩৯ টাকা! ১৫০ টাকা দিয়ে কেনোা ফুল মাত্র ৬৩৯ টাকায় বিক্রি করছে সে। প্রান্ত অনুধাবন করে এইখানে কেউ প্রাপ্যকে বিচার করে না। বিচার করে পোশাক-পরিচ্ছেদ কিংবা মুখশ্রী ও আমাদের বাহ্যিক ফ্যাশনকে। কেনোনা ওই ছেলে বিক্রি করলে হয়তো এই ফুলগুলো সর্বোচ্চ ২০০ টাকা বিক্রি হতো। আবার না ও হতে পারতো। প্রান্ত বিক্রি করেছে বলে নায্য দামের চেয়ে ও বেশি পেয়েছে। আর এটাই আমাদের সমাজ। যার যা প্রাপ্য সে তা পায় না।
প্রান্ত : স্বাধীন! ধরো এখানে ৬৩৯ টাকা আছে। এ টাকাগুলো তোমার।
ছেলে : না ভাইয়া এই টাকা তো আপনার। আপনি টাকা দিয়ে ফুল কিনে, নিজে কষ্ট কইরা বেচ্ছেন।
প্রান্ত অবাক না হয়ে পারে না। এখানে পথে-ঘাটে চলা টোকাই কিংবা রাস্তার মানুষগুলোর মাঝেও মুল্যবোধ এবং নীতি-নৈতিকতা আছে। অথচ যাদের মধ্যে থাকার দরকার তাদের মধ্যে নেই। আমরা তাই প্রতিদিন হেরে যাই কিছু বাহ্যিক দৃষ্টিতে দেখা ছোট লোকের কাছে, যারা সত্যিকার চেতনার লালন করে। অনেক জোরাজুরির পর স্বাধীন টাকাগুলো নেয়।
ঘড়িতে সন্ধ্যা ৮টা বেজে ২০ মিনিট। প্রান্ত বের হয়ে আসে টিএসসি থেকে। হাঁটতে থাকে ফুটপাত ধরে হলের উদ্দেশ্যে। আর নানা ভাবনা এসে ভর করে তার উপর। কেনো জানি আজ এক অজানা ভালো লাগা কাজ করছে প্রান্তের।
এভাবে বিকেল কিংবা সন্ধ্যার আড্ডাগুলো প্রাণবন্ত হয়ে ধরা দেয় টিএসসি, সমাজ বিজ্ঞান চত্বর, স্মৃতি চিরন্তন কিংবা ফুলার রোডে। শত মানুষের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। স্বপ্নগুলো বেড়ে উঠে ক্রমাগত। গল্প, আড্ডা আর হাসিতে জীবনে আসে পূর্ণতা।
এক অজানা প্রশান্তি জীবনকে এনে দেয় নতুন জীবন।