প্রকাশ : ১৯ ডিসেম্বর ২০২১, ০০:০০
দাদিমা আজ উঠোনের কোণে বসে আছেন। সেই সকাল থেকেই মন খারাপ। বাবা অবশ্য আজ চুপচাপ। নীলয় সকাল থেকেই খেয়াল করছে কারো মন ভালো নেই। মন ভালো থাকার কোনো কারণ নেই। কারণ নীলয় একেবারে দেশ ছেড়ে বিদেশ চলে যাচ্ছে। অথচ এ দেশে থাকার জন্যে তার দাদা-দাদির কতোটা সংগ্রামী জীবনযাপন করতে হয়েছে।
যুদ্ধের পর তাকে জীবনের দুর্বিষহ জীবনযাপন করতে হয়েছে। একমাত্র ছেলে মতিউর রহমানকে নিয়ে কতো না দারিদ্র্যতার ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে।
নীলিমার দাদি সুফিয়ার বাবার বাড়ি যুদ্ধে বিধস্ত হয়ে গিয়েছিলো। তাই একমাত্র ছেলেকে নিয়ে কারো আশ্রয়ে ঠাঁই নিতে পারেনি।
সম্পদ বলতে দুটি জমি ছিলো। আর ছোট্ট একটা বাড়ি। তার দাদা শহিদুল রহমান সেই জমিতে ধান ফলিয়েছে। সারা বছরের ভাতের যোগাড় করেছে। আর শাকসবজি বলতে নিজের জমিতে যতোটুকু শস্য রোপণ হতো।
তবু যেনো একটা স্বস্তি ছিলো। একটা পুকুর ছিলো। বছর শেষে যা মাছ পেতো ততোটুকু যেনো অর্থ সঞ্চয়। আর গাছভরা নারকেল, হাঁস-মুরগীর ডিম এগুলোই অর্থের উৎস। এতোটুকুই দিয়েই ছেলেকে কোনো মতে পড়াশোনা করিয়েছেন। নীলয়ের বাবা মতিউর রহমান একজন কৃষি অফিসার। তিনি একটা বাড়ি করেছেন। জীবনে যা কিছু প্রয়োজন সবই আছে। অথচ আজকাল তার ছেলেমেয়েরা উন্নত জীবনযাপনের আশায় দেশ ছেড়ে যেতে চলেছে। মতিউর রহমান যেনো নিরূপায়। চোখের সামনে যুদ্ধের পরবর্তী দিনগুলো ভেসে যাচ্ছে। একবেলা ভাত না জুটলে আরেক বেলা জুটতো। তবু একটা শান্তি ছিলো। সবাই একসাথে থেকে সুখে-দুঃখে ছিলো। এতো এতো টাকা আজ তবু ছেলেমেয়েকে কাছে বা পাওয়ার আক্ষেপ হয়তো নীলয় বুঝবে না। মতিউর রহমান বারান্দায় দাঁড়িয়ে দুঃখ লুকানোর চেষ্টা করছে।
নীলয় : বাবা তুমি এইদিকে?
মতিউর রহমান : বাবা বল।
নীলয় : বাবা প্লেনে যাওয়ার সময় কি পোশাক পরবো?
মতিউর রহমান : বাবা বিদেশে না গেলে কি হয় না?
নীলয় : বাবা আমেরিকার মতো দেশের সুযোগ তো হাতছাড়া করা উচিত নয়
মতিউর রহমান : ঠিক আছে যাও।
রাতে নীলয় ব্যাগ গুছিয়ে নিলো। এমন সময় তার দাদি সুফিয়ার হাত ধরে ফেললো।
নীলয় : দাদি কিছু বলবে?
হুম।
আমি তোকে বলবো তুই বিদেশে যাস্নে। জানিস্ নীলয় তোর বাবা যখন ছোট ছিলো আমাদের ভারী কষ্টের দিন ছিলো। এই যে তোদের ড্রয়িংরুম, ডাইনিংরুম, বারান্দা আমাদের কিছুই ছিলো না।
আমরা শীতলপাটি বিছিয়ে খাবার খেতাম। আর খাটের উপর বসে সবাই মিলে গল্প করতাম। আর উঠোনে চাঁদের আলোতে গল্প করতাম। তবু আমাদের সুখ ছিলো। সুখে-দুঃখে একে অপরকে পাশে পেতাম।
আমি জানি না আর কতোটা উন্নত জীবনের আশা তুই করিস্!
আমরা যেখানে অভাবে দিন কাটিয়েছি তোরা সেখানে অভাবের ছিটেফোঁটা দেখিসনি। তোর বাবার জন্যে আমরা যা করেছি সে আমাদের তার চেয়ে বেশি করছে। জীবনের শেষ প্রান্তে সন্তানদের কাছে পাওয়া অনেক সুখের।
আমি আজ ৭৮ বছরের বৃদ্ধা জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তোর বাবার সান্নিধ্যে পাচ্ছি। আমার ছেলে রাতদুপুরে এসে দেখে আমার গরম লাগছে নাকি শীত লাগছে। কিন্তু তুই যখন বিদেশে যাবি তখন তোর মা-বাবা একা হয়ে যাবে। তাদের তো রাতে কেউ দেখবে না তারা ভালো আছে কি না। ইন্টারনেটে শুধু মুখ আর কণ্ঠ শোনা যাবে। কিন্তু হৃদয়ের ক্ষত দেখা যাবে না।
এই যে কয়েকদিন আগে চাকরিটা পেলি তা-ই কর। সন্ধ্যা শেষে যখন দেখবি তোর মা-বাবা তোর মুখখানা দেখে হাসবে। এই হাসিটুকু তোর দোয়া।
নীলয় : দাদিমা দাঁড়াও। আমি আসছি।
বাবা...বাবা...মা...মা...
মতিউর রহমান, সায়লা দৌড়ে এসে কিরে বাবা কি হয়েছে?
নীলয় : আমি আমেরিকা যাচ্ছি না।
সুফিয়া বেগম বারান্দায় দাঁড়িয়ে কাঁদছেন। এমন সময় সবাই মিলে হাজির। মতিউর রহমান বললো, মা নীলয় যাচ্ছে না।
সুফিয়া বেগম : এতো বড্ড খুশির খবর। শোনলে নীলয় দেশ আর সন্তানের সান্নিধ্যে মানুষের ভরসা আর সুখের উৎস।
নীলয় : তাই তো দাদিমা। তাহলে দাদিমা তোমার সঙ্গীটা তাড়াতাড়ি নিয়ে আসো যাতে আমি তোমার পুন্তিদের ভরসার স্বপ্ন দেখতে পারি।
তখন সারা ঘর হাসির রোল পড়ে গেলো।