শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৬ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০

মব জাস্টিস : বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অন্যায় ও জঙ্গল আইনের চর্চায় নীরব দর্শক?

দেলোয়ার জাহিদ

ভিজিল্যান্টিজম বা জনতার সহিংসতা নামেও পরিচিত এ মব জাস্টিস। এটি তখন ঘটে যখন একদল লোক আইনগত কর্তৃত্ব বা যথাযথ প্রক্রিয়া ছাড়াই অপরাধের জন্যে অভিযুক্ত ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে শাস্তি দেওয়ার জন্যে আইন নিজের হাতে তুলে নেয়। বাংলাদেশে এই জঙ্গল আইন চর্চায় একটি উল্লেখযোগ্য উদ্বেগ হয়ে উঠেছে, বিশেষ করে আগস্ট ২০২৪-এ ছাত্র-নেতৃত্বাধীন বিক্ষোভের পর থেকে, যা নিরাপত্তা, শাসন এবং জনসাধারণের জবাবদিহিতার বিষয়ে ব্যাপক মনোযোগ আকর্ষণ করেছে ।

কাকতালীয়ভাবে ২০১৮ সালের আগস্টে ঢাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুতে ছাত্র আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। নিরাপদ সড়ক ও ট্রাফিক আইনের আরো ভালো প্রয়োগের দাবিতে হাজার হাজার শিক্ষার্থী তখন রাস্তায় নেমেছে। যদিও বিক্ষোভগুলো শান্তিপূর্ণ ছিল। তারা বাংলাদেশে আইনের শাসন এবং ন্যায়বিচারের বিরুদ্ধে ব্যাপক অসন্তোষকে তুলে ধরেছে। বিক্ষোভগুলো দুর্নীতির বিষয়ে গভীর হতাশা এবং ক্ষমতায় থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে জবাবদিহিতার অনুভূত অভাবকেও প্রকাশ করেছে।

বিক্ষোভের পর সারাদেশে জনতার বিচারের রিপোর্টের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। সম্ভবত আইনি ব্যবস্থায় বিশ্বাসের অভাব বা সরকারি চ্যানেলের মাধ্যমে ন্যায়বিচার প্রদান করা হবে না এমন বিশ্বাসের কারণে লোকেরা প্রায়শই বিষয়গুলো তাদের নিজের হাতে নিয়েছে বলে মনে হয়েছিল।

কথিত অপরাধের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মব জাস্টিসের কার্যকারিতা : অনুভূত কার্যকারিতা : কেউ কেউ যুক্তি দেন যে, জনতার ন্যায়বিচার অপরাধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করতে পারে, বিশেষ করে যেখানে আইন প্রয়োগকারী দুর্বল বা দুর্নীতিগ্রস্ত। নির্দিষ্ট কিছু সম্প্রদায়, যেখানে পুলিশ বা বিচার ব্যবস্থার প্রতি আস্থার অভাব রয়েছে, সেখানে লোকেরা মনে করতে পারে যে, তাদের নিজের হাতে বিচার নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। 'ন্যায়বিচার'-এর এই তাৎক্ষণিক রূপটিকে কেউ কেউ আইনি ব্যবস্থার চেয়ে বেশি কার্যকর হিসেবে দেখেন, যা প্রায়শই ধীর এবং অদক্ষ হিসেবে দেখা হয়। এর নেতিবাচক পরিণতি : এর অনুভূত কার্যকারিতা সত্ত্বেও, জনতার বিচারের অনেক নেতিবাচক পরিণতি রয়েছে। এটি প্রায় অন্যায় শাস্তির দিকে এবং প্রতিশোধ প্রতিহিংসার দিকে পরিচালিত করে, যার মধ্যে নিরপরাধ মানুষের মৃত্যুও রয়েছে। কারণ সঠিক তদন্ত বা প্রমাণ ছাড়াই মুহূর্তের উত্তাপে এ সকল সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। যথাযথ প্রক্রিয়ার অভাবের অর্থ হলো, অভিযুক্তদের আত্মপক্ষ সমর্থন করার কোনো সুযোগ নেই, যার ফলে ন্যায়বিচারের গর্ভপাত ঘটে।

অধিকন্তু, মব জাস্টিস সহিংসতার একটি চক্রকে স্থায়ী করতে পারে এবং ভয় ও নিরাপত্তাহীনতার পরিবেশও তৈরি করতে পারে। এটি আইনের শাসনকে ক্ষুণ্ন করে এবং ন্যায়বিচার বজায় রাখতে ও শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্যে প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্বল করে চলেছে । অনেক ক্ষেত্রে মব জাস্টিস বাংলাদেশে সংঘাত ও সংঘর্ষ ক্রমে বাড়িয়ে তুলেছে, যার ফলে চরম হতাশা, উদ্বেগ ও সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে।

মব জাস্টিসের দীর্ঘ তালিকা থেকে একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে।

যেমন-রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক নেতা আবদুল্লাহ আল মাসুদের মৃত্যুর দুই দিন পরও তাকে মারধরের ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি। ৩১ বছর বয়সী মাসুদ ৭ সেপ্টেম্বর রাতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে হামলার শিকার হন এবং গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। হামলার পরে মাসুদের কথা বলার একটি ভাইরাল ভিডিও থাকা সত্ত্বেও কোনো প্রত্যক্ষদর্শী এগিয়ে আসেনি এবং পুলিশ তার পরিবারের কাছ থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক অভিযোগ পায়নি। প্রতিশোধের আশঙ্কায় মাসুদের পরিবার আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা করার কথা বিবেচনা করা হচ্ছে। মাসুদ, যিনি তার মৃত্যুর কয়েকদিন আগে একটি কন্যা সন্তানের পিতা হয়েছিলেন। এর আগে ২০১৪ সালে যখন তাকে আক্রমণ করা হয়েছিল, তখন একটি পা হারিয়েছেন এবং গুরুতর আহত হয়েছিলেন। তার পরিবার হতবাক এবং ভয় পায় যে, তারা ন্যায়বিচার নাও পেতে পারে।(সূত্র : প্রথম আলো, ৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪)

বাংলাদেশে পুলিশ সংস্কারের অগ্রগতি নিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ইউএনডিপির আবাসিক প্রতিনিধিকে জানালেন সংস্কারের পদ্ধতি, প্রক্রিয়া এবং নেতৃত্বের রূপরেখার জন্যে শীঘ্রই একটি প্রাথমিক কমিটি প্রতিষ্ঠিত হবে। ইউএনডিপি প্রতিনিধি স্টিফেন লিলাল জনগণের আস্থা তৈরি করতে এবং পুলিশের সমালোচনা দূর করতে সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন এবং প্রক্রিয়াটির জন্যে প্রযুক্তিগত ও আর্থিক সহায়তারও প্রস্তাব দেন। (সূত্র-দৈনিক আমাদের সময় ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪)

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংখ্যালঘু ও পতিত সরকারি দল ও তার নেতা-কর্মীদের রক্ষা করতে পারেনি বা চেষ্টাও করেনি। এমনকি থানা লুট, পুলিশ হত্যা, সরকারি সম্পদ লুটতরাজের ঘটনাও ঘটেছে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর নজরের সামনে এবং একটি বাহিনীর পোশাকে জাতীয় ঐতিহ্যগুলোকে ভাংচুর করার ভিডিও ফুটেজও দেখা গেছে।

যদিও মব জাস্টিসকে কেউ কেউ কথিত অপরাধের দ্রুত সমাধান হিসেবে দেখতে পারেন। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, এটি শেষ পর্যন্ত অকার্যকর এবং বিপজ্জনক। এটি আইনের শাসনকে সম্পূর্ণভাবে ক্ষুণ্ণ করে, সহিংসতাকে স্থায়ী করে এবং প্রায়শই নিরপরাধ ব্যক্তিদের শাস্তির দিকে নিয়ে যায়। অপরাধের বিরুদ্ধে কার্যকরভাবে লড়াই করার জন্যে বাংলাদেশকে তার আইনি ও বিচারিক প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করতে হবে, আইন প্রয়োগের উন্নতি করতে হবে এবং বিচার ব্যবস্থার প্রতি জনগণের অবিশ্বাসের মূল কারণগুলোকে মোকাবেলা করতে হবে। শুধুমাত্র তা করার মাধ্যমেই দেশ একটি আরও ন্যায়পরায়ণ ও ন্যায়সঙ্গত সমাজ গঠন করতে পারে, যেখানে সকল নাগরিক আইনের শাসনে নিরাপদ ও আত্মবিশ্বাসী বোধ করবে ।

লেখক : বাংলাদেশ নর্থ আমেরিকান জার্নালিস্ট নেটওয়ার্কের সভাপতি, মানবাধিকার ও আইন বিষয়ে গবেষক এবং বিশ্লেষক।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়