রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪  |   ১৮ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ১২ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০

জাতিস্মর জগতি রেলস্টেশন
মোঃ ইয়াকুব আলী

ইতিহাস বলছে, আজ থেকে দেড়শ’ বছরেরও আগে স্থাপিত হয় জগতি রেলস্টেশন। সেই সময় থেকে এখনও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে লাল রঙের ভবনটি। এই স্টেশনের সাথে আমার পরিচয় হয় ১৯৯১ সালে। চরভবানীপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক পাস করে এসে ভর্তি হলাম শহরতলীর জগতি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। তখনও জানতাম না, জগতি নামটা উপমহাদেশের একটা অন্যতম পরিচিত নাম। আর বাংলাদেশের সর্বপ্রথম রেলস্টেশনেরও নাম। আমাদের বিদ্যালয় ভবনটা ছিল ইংরেজি এল অক্ষরের আকৃতির। আর এর পেটের মধ্যে ছিল আই আকৃতির প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবন।

রাস্তার পাশের অফিস ভবনটা ছাড়া আমাদের বিদ্যালয়ের বাকি সব কক্ষ ছিল সেমি পাকা ভবন। একটা অংশের উপর ছিল টিনের ছাপড়া, অন্য অংশটার উপরে ছিল টিনের চৌচালা। একটু বৃষ্টি হলেই টিনের চালের ফুটো দিয়ে পানি পড়ে আমাদের বসার বেঞ্চ ভিজিয়ে দিত। তখন আমাদের সরে সরে বসতে হতো। আর বেশি বৃষ্টি হলে কক্ষের মধ্যে বন্যা বয়ে যেত। আমাদের মেঝে ছিল ইটের সোলিং করা, তাই পানি বেশিক্ষণ জমে থাকতে পারতো না। বিদ্যালয়ের সামনের রাস্তার পাশেই রেললাইনের জায়গায় খাল। আর খালের অপর পাড়েই রেললাইন। আমাদেরকে তাই রেলগাড়ি দেখতে আর দূরে যেতে হতো না।

রেলগাড়িগুলো জগতি স্টেশনে এসে থামতো। তারপর সেখান থেকে আরো মালামাল এবং মানুষ নিয়ে যাত্রা করতো। যাত্রা শুরুর আগে স্টেশন ঘরের পাশে ঝুলানো রেলের পাতে সজোরে একটানা আঘাত করে জানিয়ে দেয়া হতো, কিছুক্ষণের মধ্যেই গাড়ি ছেড়ে যাবে। বিদ্যালয়ে বসেও আমরা এই ঘন্টাধ্বনি শুনতে পেতাম। জগতি স্টেশনের অপর পাশেই ছিল রেলবাজার। সবসময় সরগরম থাকতো রেলবাজার। আশপাশের এলাকার মানুষেরা নির্দিষ্ট দিনে এখানে বাজার করতে আসতেন। আর ছিল জগতি হাট। সেখানেই সপ্তাহের দুই দিন হাট বসতো। তখন অনেক দূর-দুরান্ত থেকে মানুষ আসতো হাট করতে।

আমাদের বিদ্যালয়ের দেয়ালের পেছনেই রাস্তার ধারে ছিল জগতি ডাকঘর। সেখানেও ব্যস্ততা থাকতো সারাদিন। বিভিন্ন জায়গা থেকে চিঠি সংগ্রহ করে সেগুলোকে কুষ্টিয়া সদরে নিয়ে যাওয়া, আবার সদর থেকে বস্তাভর্তি চিঠি নিয়ে এসে বিলি করার তোড়জোড় চলতো সারাদিন। অনেকেই সরাসরি ডাকঘরে এসে খোঁজ নিতেন তাদের কোনো চিঠি এসেছে কি না? আমাদেরকেও বেশ ক’বার যেতে হয়েছিল আব্বার চিঠি এসেছে কি না জানার জন্যে। পোস্টমাস্টারের ছেলেমেয়েরা আমাদের সাথেই আমাদের বিদ্যালয়ে পড়তো।

অনেকদিন পর বেড়াতে গেলাম জগতি স্টেশনে। আগে স্টেশনের কাছাকাছি আসলেই লোকজনের গমগম আওয়াজ পাওয়া যেত। এখন স্টেশনে মানুষই খুঁজে পাওয়া দায়। স্টেশনের অপেক্ষাঘর ফাঁকা পড়ে আছে। স্টেশনের ট্রেনের তালিকা বোর্ডে কবেকার পুরোনো ট্রেনের সময়সূচি। তার উপর কেউ একজন দয়াপরবশ হয়ে ইংরেজিতে স্টেশনের নামটা লিখে রেখেছে। স্টেশনের ঘণ্টাটা এখন বড্ড নিঃসঙ্গ। স্টেশনের পানির ট্যাংকের উপর বটের চারা জন্মেছে। সেটাকে আর পানির ট্যাংক বলে চেনার উপায় নেই। অনেকক্ষণ ধরে স্টেশনে হাঁটাহাঁটি করলাম, কিন্তু কোনো যাত্রী বা রেলগাড়ির দেখা পেলাম না।

এরপর গেলাম রেলবাজারে। সেখানেও মানুষের আনাগোনা খুবই কম। রেলবাজারের পাশেই ছিল ভিসিআরের দোকান। সেটা উঠে গেছে অনেক আগেই। এরপর গেলাম বিদ্যালয়ে। বিদ্যালয়ের পুকুরপাড়ে লাগানো বটগাছটা ধীরে ধীরে মহীরুহের আকার নিচ্ছে। বিদ্যালয়ের ভবন এখন পাকা হয়ে গেছে। রাস্তার পাশে নির্মাণ করা হয়েছে দেয়াল এবং নাম সম্বলিত সুদৃশ্য ফটক। আরও নির্মাণ করা হয়েছে শহীদ মিনার। ডাকঘরটাও এখনো আছে, কিন্তু কোনো জনমানুষের দেখা পেলাম না। ডাকঘর পার হয়ে দয়াল বেকারি নামে একটা বেকারি ছিল, সেটাও আর নেই এখন। এরপর হেঁটেহেঁটে বাড়ির রাস্তা ধরলাম। চৌড়হাঁস মতি মিঞার রেলগেটে এসে দেখা পেলাম রেলগাড়ির।

সময়ের সাথে সাথে বদলায় প্রকৃতি, বদলায় মানুষ। কিন্তু মানুষ নির্মিত স্থাপনাগুলো কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এই স্থাপনাগুলোর গায়ে কত শত মানুষের সুখ, দুঃখের গল্প লেখা থাকে। জগতি রেলস্টেশনও এমনই এক জাতিস্মরের নাম।

অস্ট্রেলিয়াতে দেখেছি, পুরোনো স্থাপনাগুলোকে ‘ঐতিহ্য’ ঘোষণা করে সেগুলো রক্ষণাবেক্ষণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেয়া হয়। যে স্টেশনগুলো পরিত্যক্ত হয়ে গেছে, সেগুলোকে জাদুঘরে রূপান্তর করা হয়। সেখানে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ বেড়াতে আসে। হয়তোবা কান পেতে শুনে কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া মানুষদের প্রতিধ্বনি।

জগতি স্টেশনের জৌলুষ ফিরিয়ে আনতে সরকার পদক্ষেপ নিলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হাতে কলমে জানতে পারতো দেশের প্রথম রেলস্টেশনের ইতিহাস।

লেখক : অস্ট্রেলিয়ার মিন্টোতে বসবাস করেন।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়