প্রকাশ : ১৫ নভেম্বর ২০২১, ০০:০০
গলিটা সোজা নরকে গিয়ে পৌঁছেছে। আর নরকটা ঠিক শ্যামতলা বস্তির ওই কোণে, যেখানে দিন শেষে রাত হয় আর রাতগুলো হয় বহুরূপী রাত। এই রাতের আলো আর অন্ধকারের মাঝে যে পসরা জমে তা নেহাত কোটি কোটি টাকার কোনো মোহ নয়। এই রাত শুধু সাধারণ কিছু অর্থ দেওয়া আর নেওয়ায় সীমাবদ্ধ।
আর এই সীমাবদ্ধতার নাম রূপালি। এই মেয়েটির নাম কবে রূপালি হয়েছে তা সে নিজেও জানে না। সে শুধু জানে, একদিন কোনো এক সন্ধ্যায় তার আগমন এই নরকের এক ছোট্ট ঘরে। সেই ঘরে তাকে প্রতিরাতে নাচতে হতো। গলায় মেকি হার, কানে দুল, ঠোঁটে লাল লিপস্টিক। পায়ে ঘুঙ্গুর। বাজার তালে তালে শরীর দুলতো। সেই দোলানো শরীরের বাঁকগুলো দেখতে ভ্রমরের আমদানি হতো। মক্ষীরাণি ইন্দুবালাকে টাকা পরিশোধ করেই তারপর রূপালির কোমর দোলানো নাচের পসরায় সামিল হতো কতক ভ্রমর।
তারপর এভাবেই দিনগুলো কাটাতে হয় তাকে এই নরকের ভাঙ্গা ঘরে। প্রতিদিন নাচ, নাচের তালে ভ্রমর আর ভ্রমরের সাধ-আহ্লাদ পূরণ।
জীবনে কত পুরুষ দেখেছে রূপালি। সবারই চোখ একই কথা বলে। সবারই হাত একইভাবে চলে। আর চলে নরকের কীটগুলোর চাহিদা পূরণ।
রূপালির মাঝে মাঝে অসুখ হয়, কিন্তু সেই অসুখেও তাকে নাচতে হয়। এখানে কান্নার কোনো সুযোগ নেই। আর কান্না শোনার মতো কোনো মানুষও নেই। শুধু আছে শয়তানের হাসি শোনার মতো মানুষ। এখানে সব রাক্ষস আছে, তারা নরোম মাংসের স্বাদ পেতে চায় টাকার বিনিময়ে। টাকা তাদের কাছে তুচ্ছ একটি বিষয়, শুধু চাই সম্ভোগ।
সন্ধ্যা। আজ রূপালি ভাবে, এভাবে কত বছরে কেটে গেলো। আর কত বছরই বা সে এভাবে নরকের মাঝে কাটিয়ে দিবে। এভাবে কাটাতে মন্দ নয়। তবে সে যেহেতু মানুষ, তাকে তাই এই নরকের তলা থেকে অন্যজগতে পাড়ি দিয়ে দেখতে হবে দুনিয়াটায় আর কী কী অপেক্ষা করছে তার জন্য।
সে মনে মনে স্থির করে ফেলে। হ্যাঁ, আজই হবে তার নরকের শেষ রাত। এই রাতেই সে নরক জীবনের অবসান ঘটাবে আর বেরিয়ে পড়বে অন্ধকার ছেড়ে আলোর সীমানায়।
রূপালির মনে আছে, যে মানুষটি তাকে এখানে এনে বিক্রি করেছিল সে সমাজের একজন কীট। ওই কীটগুলোকে মানুষ মান্যগণ্য করে, তোয়াজ করে। কিন্তু তাদের অন্তরের খবর সবাই রাখে না। তেমনি রূপালিও ওই কীটটাকে ভালোবেসেছিল। মায়ায় জড়িয়েছিল। তারপর তার সাথেই অজানায় পাড়ি জমিয়েছিল।
হঠাৎ চিন্তায় বাধা পড়ে যায়। সচকিত হয়ে ওঠে সে। ইন্দুবালা। সর্দারনি। সাথে একজন মানুষ। তবে এ ধরনের লোকদেরকে সে মানুষ মনে করে না।
এরা খুব সাধু-সন্যাস ভাব নিয়ে সমাজে বিচরণ করে। কিন্তু রাতের আঁধারে এদের চেহারা পাল্টে যায়।
সে রাতে নাচ শেষে অতিথি হয় একজন মানুষ, যে কিনা তাকে মক্ষীরাণির কাছ থেকে এক বান্ডেল টাকার বিনিময়ে পেয়েছে। লোকটি ঘরের কপাট বন্ধ করে আর ট্রাউজারের কপাট খোলে।
রূপালির মনে হলো, একটা জ্যান্ত সাপ তার ঘরে। এই সাপ তার বহু পরিচিত। সে কমনীয় হাতে সাপের লেজ ধরে। আদরের ছলে হঠাৎ করে ঘটিয়ে দেয় ঘটনাটা। ক্যাঁত করে ওঠে সাপটা। কিন্তু তার আগেই রূপালি যা করার তা শেষ করে ফেলে। সাপের অসাড় দেহ পড়ে থাকে মেঝেতে।
তারপর রূপালি নরকের দুয়ার খোলে। নরকের দুয়ারে বহু কীটপতঙ্গ। সেই কীটপতঙ্গের চোখ ভেদ করে এক সময় সে মূল রাস্তাটায় ওঠে পড়ে।
তারপর শ্বাস নেয় বড় করে। সে দেখে এখানেও অজস্র সাপের চোখ ভীড় করে আছে। তবুও ভাবে নরকের সাপগুলোর চেয়ে এই সাপগুলোর চোখ ভিন্ন, হয়তো এদের মাঝে কোনো দন্তহীন সাপ পেয়ে যাবে সে, তারপর তার জীবনের শেষ সময়গুলো অতিবাহিত করবে তার মতো করেই।
সকাল হয়। তার কাছে কোনো অর্থ নেই। সে পথ চলছে এলোমেলো...। নিঃসঙ্গ পথ, তবুও মনে হয় এই পথে আনন্দ আছে, এই পথই তার চাওয়া, এই পথেই সে পাড়ি দিবে বহুদূরে, যেপথে নরকের সাপগুলো তাকে জ্বালাতে পারবে না।