প্রকাশ : ১৮ অক্টোবর ২০২১, ০০:০০
অফিস থেকে বের হয়ে সরাসরি শপিংমলের দিকে রওনা হলো প্রিয়ন্ত। সামনেই শারদীয় দুর্গোৎসব। মা আর ছোটবোনের জন্যে পূজার শপিং করবে। দুপুরে অফিসে বসে যখন কাজ করছিল তখনই ফোনে টেক্সট আসে তার ব্যাংক একাউন্টে পূজার বোনাসসহ বেতন ক্রেডিট করা হয়েছে। চাকরি পাওয়ার পর এবারই প্রিয়ন্তের প্রথম পূজা। তাই টেক্সটা দেখে অনেক বেশি খুশি হয়েছে সে। নিজের বেতনের টাকায় পরিবারের সবার জন্য শপিং করবে। ভাবতেই আনন্দে চোখে জল চলে আসে। টেক্সট আসার পর থেকে আর অফিসের কাজে মন বসাতেই পারেনি। কখন অফিস শেষ হবে, কখন সে পরিবারের সবার জন্যে শপিং করবে, সেটাই তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। পরিবার বলতে মা আর একমাত্র ছোটবোন। বাসায় এক ফাঁকে ফোন করে মায়ের কাছ থেকে জেনে নিয়েছে, তার কী কী লাগবে, ছোটকিটাকে জিজ্ঞেস করেছে, ‘কিরে কী কী লাগবে তোর এবার পূজাতে, বল? সব কিনে দেবো।’
বিকেলে অফিস আওয়ার শেষ হওয়ার কিছুটা আগেই অফিসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে জানিয়ে বের হয়ে পড়ে শপিং করার জন্যে। এরপর অফিস থেকে নেমেই একটা রিক্সা ডেকে চেপে বসে। রিক্সায় বসে সে তার ভেতরের উত্তেজনা চেপে রাখতে পারেনি। রিক্সাচালক মামাটি প্রিয়ন্তের মনের অবস্থা বুঝতে পারে। লোকটি প্রিয়ন্তকে জিজ্ঞেস করে, 'মামা, অনেক খুশি মনে হইতাছে আপনেরে। কারণ কী?' প্রিয়ন্ত মুচকি হেসে জবাব দেয়, 'মামা, আজকে বেতন পেয়েছি। চাকরি পাওয়ার পর এই আমার প্রথম পূজা। মা আর বোনের জন্যে নিজের টাকায় পূজোর পোশাক কিনব। ভাবতেই ভালো লাগছে!' রিক্সা চালাক মামাটি তখন বলে, 'হ মামা, ঠিকই কইছেন আপনে। পরিবারের সবাইরে নতুন পোশাক দেওনের মধ্যে একটা আলাদা সুখ আছে। তাগো মুখের হাসিটা দেখলে সারাদিনের সব কষ্টই ভুইলা যাওয়া যায়। ছোডো পোলাডা গতকাইল রাইত গলা জড়াইয়া ধইরা কয়, 'বাবু, আমারে পূজার নতুন জামা কিইন্না দিবা না?' গত দেড় বছরে করোনার লাইগা কাম কাইজও তেমন আছিল না। হাতে যা আছিল সব শেষ। এহন প্রতিদিন যা কামাই তা দিয়া কোনোমতে সংসার চালাই। পোলাডারে মনে হয় এইবার আর নতুন জামা কিইন্না দিতে পারমু না।'
কথাটা বলতে গিয়ে কেমন করুণ হয়ে গিয়েছিল রিক্সাচালক মামার কণ্ঠটি। প্রিয়ন্তের তখন ছোটবেলার কথা মনে পড়ে যায়। তখন সে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়তো। সেও পূজার আগে এভাবেই বাবাকে বলেছিল, 'বাবু, আমাকে পূজোর নতুন জামা কিনে দেবে না?' তার বাবা কিছুক্ষণ চুপ করেছিল। এরপর বলেছিল, 'হ্যাঁ, দেবো, খোকা।' সেদিন বাবার চুপ থাকার কারণটা বুঝতে পারেনি প্রিয়ন্ত। কিন্তু আজ ভালো করেই অনুধাবন করতে পেরেছে সে। বাবা সেদিন নিজের জন্যে না কিনে প্রিয়ন্তকে ঠিকই নতুন জামা কিনে দিয়েছিলেন। অথচ তার নিজেরই একটামাত্র জামা ছিল। সেটি গায়ে দিয়ে প্রতিদিন তাকে বের হতে হতো। বগলের নিচের অংশের সেলাই খুলে গিয়েছিল। সেটি নিজের হাতেই সেলাই করে নিয়েছিলেন সন্তানের মুখে হাসি দেখবেন বলে।
হঠাৎ করেই প্রিয়ন্তের মধ্যে একটা শূন্যতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। পকেটে আজ তার এতোগুলো টাকা। কিন্তু সেই মানুষটাকে আজ সে এই টাকায় একটা নতুন জামা কিনে দিতে পারবে না, যে মানুষটা তাকে নতুন জামা কিনে দিয়েছিলেন নিজের জন্যে না কিনে। নিজেকে অনেক অসহায় মনে হলো তার। দুচোখ জলে ভারী হয়ে ওঠে প্রিয়ন্তের। দূর আকাশে তাকিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে সে। এরপর একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। আজ শুধু মা আর ছোটবোনের জন্য নতুন জামা কিনবে না। তার সাথে এই রিক্সাচালক মামা আর তার পরিবারের জন্যেও পূজার নতুন জামা কিনবে সে। নিজের বাবাকে তো আর নতুন জামা কখনোই কিনে দেয়া হবে না, তাই একজন বাবাকে নতুন জামা কিনে দেবে আজ। এরকম ভাবতে ভাবতেই রিক্সা পৌঁছে যায় শপিংমলের সামনে।
রিক্সা থেকে নেমে প্রিয়ন্ত রিক্সাচালক মামাকে বলে, 'মামা, চলেন আমাকে একটু সাহায্য করবেন শপিং করতে। অনেকগুলো ব্যাগ হবে। ফেরার সময় আপনার রিক্সাতেই যাবো। লোকটি মাথা নাড়িয়ে তাতে সায় দেয়। পুরো শপিংমল ঘুরে অনেক কেনাকাটা করলো প্রিয়ন্ত। নিজের মা আর বোনের জন্যে কেনার পাশাপাশি চল্লিশোর্ধ্ব এই রিক্সাচালক, তার স্ত্রী আর ছোট ছেলেটার জন্যেও নতুন পোশাক কেনে। নিজের জন্যে কিছুই নেয়নি। নেয়নি বললে ভুল হবে। সে নিজের জন্যে আত্মতৃপ্তি নিয়েছে। শপিং শেষ করে বাসায় পৌঁছে রিক্সা থেকে নামার পর রিক্সাচালক মামার হাতে তাদের জন্যে কেনা নতুন পোশাকগুলো ধরিয়ে দিয়ে বলে, মামা, এইগুলো তোমার জন্যে। তোমার ছেলেটাকে এই নতুন জামাটা দিও। তোমার জন্য আর মামীর জন্যও আছে। আর এই নাও এক হাজার টাকা। পরিবার নিয়ে ঠাকুর দেখতে যেও।
রিক্সাচালক মামাটি অবাক হয়ে তাকিয়েই থাকে। ভাবতেই পারেনি এমন কিছু হবে। আশীর্বাদের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে প্রিয়ন্তের দিকে। কিছু বলতে পারল না আর। প্রিয়ন্ত ততক্ষণে নিজের মা আর ছোটবোনের জন্যে কেনা পোশাকগুলো নিয়ে বাসায় ঢুকতে ঢুকতে একটা সুন্দর দৃশ্যের কল্পনা করতে থাকে। বাবা-ছেলে নতুন জামা পরে কোনো এক পূজাম-পে ঠাকুর দেখছে। যেটা পৃথিবীর সুন্দর মুহূর্তগুলোর একটি। প্রিয়ন্ত এটা ভেবেই তৃপ্ত হলো, কোনো এক বাবাকে আর তার ছোট্ট ছেলেটাকে আজ সে নতুন জামা দিতে পেরেছে আর ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে, 'ওপারে ভালো রেখো আমার বাবাকে।'
লেখক : মিঠুন চন্দ্র ত্রিপুরা, সভাপতি, চাঁদপুর সরকারি কলেজ ডিবেট ফোরাম (সিসিডিএফ)।