প্রকাশ : ০৪ অক্টোবর ২০২১, ০০:০০
বুলেট ঠিক কপালের মাঝ দিয়ে বেরিয়ে গেলো। স্বভাবত পেছন থেকে গুলি করলে এমনটা হয় না। যে আঙুল গুলিটা ছুড়েছে টার্গেট খুব সুক্ষ্ম। লোকটি এক্সপার্ট। দক্ষ না হলে এতো মাপ মতো বুলেটটি কপাল দিয়ে বের হওয়া কথা নয়। সিনেমায় ভিলেন বা নায়ক ঠিক কপাল বরাবর পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করতে দেখা যায়। কিন্তু দূর থেকে বুলেট এমন মাপ মতো হবে তা কল্পনাতীত। কল্পনা করুক বা না করুক ঘটনা তো সত্য। চোখের সামনে বন্ধুর এমন মৃত্যু দেখে শওকত বাড়ি ফিরতে চায়। তখনো অনেক সময় বাকি। বন্ধুদের বলে, আমি ফিরবো। এই যে এখানে এসেছি, আমার পরিবারের কেউ জানে না। জানলে আসতে দিতো না। সুযোগ মতো ফের যোগ দেবো তোদের সাথে।
-ফিরবি কবে? যদিও এখন যাওয়াটা তোর ঠিক হচ্ছে না।
-বাড়ির সবাই জানে আমি ব্যবসায়িক কাজে ব্যস্ত। বাড়িতে গিয়ে ছেলেটাকে দেখে ফের চলে আসবো। বাড়ি গেলে দেশের এ পরিস্থিতে আসতে দেয় কি না সন্দেহ। তবুও আমি কৌশলে চলে আসবো। তোরা অপারেশন ঠিক মতো করিস।
মাস তিনেক পর বাড়ি ফিরে শওকত। আজকাল ভয়ে জানালার পাশে দাঁড়ায় না সে। বিশেষ করে নির্জনতায়। সে ভাবে বাহিরে না ঘরের ভেতরেই খুন হবে সে। দূর থেকে কেউ জানালা দিয়ে গুলি করবে। তাই শওকতের কাছে এখন বাড়ির দখিনের জানালাকে মৃত্যু দুয়ার মনে হয়। বাবার ঘাম ঝরানো টাকায় করা বাড়ি। তবে জানালাগুলো তৈরি হয়েছিলো শওকতের ইচ্ছায়। দখিনা বাতাস আলতো পরশ বুলিয়ে মিলিয়ে যাবে ঘরের কোণায় কোণায়। অনেকদিন পর বাড়ি ফিরে এখন আর দখিনা জানালা খোলা রাখে না সে। শুধু রাতে নয়, দিনেও জানালা বন্ধ রাখে। আগের মত সবসময় শওকত রাত করে ঘরে ফিরে। যুদ্ধ শুরুর কয়েক মাস বাড়িতে তো আসেই-নি। মা-বাবা ও স্ত্রী ভাবে, ব্যবসায়িক কাজে কখনো কখনো চট্টগ্রাম খুলনা যেতে হয়। কিন্তু এখন সময় ভালো না। দেশ উত্তাল।
রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ দেশের হাওয়ায় রহস্য ঘুরপাক খাচ্ছিলো। ২৫ মার্চ নির্দয় হামলা। ২৬ মার্চ রাতে বাবা হলো শওকত। বন্ধুরাসহ যুদ্ধে যাবার মনস্থির করে। কিন্তু কোথায় যেনো টান পড়ে। অসুস্থ স্ত্রী। নবজাতক সন্তান। দেশটাও শকুনের হাত থেকে মুক্ত হওয়া প্রয়োজন। নিজেকে সান্ত্বনা দেয় শওকত, আমি না গেলেও আরো অনেকেই যাবে। তাদের হাত ধরেই আমরা মুক্ত হবো। কিন্তু মনের ভেতর থেকে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী সাতদিন পর নবজাতকের নাম রাখা হয়। শওকত ছেলের নাম স্বাধীন রাখবে বলে স্ত্রীকে জানায়। ঘরে বাবা মা আর স্ত্রী নবজাতককে রেখে বেরিয়ে পড়ে শওকত। দিনটি ছিলো ত্রিশ মার্চ।
স্বাধীনের বয়স তিন মাস। স্বাধীন যতোটা দুঃসাহসী শওকত ঠিক ততোটা ভীতু। ভয় তাড়া করে বেড়ায়। রাস্তায় নির্বিঘ্নে চলতে পারলেও ঘরের ভেতর ভয় ঝাপটে ধরে। দক্ষিণের রুমে এখন যেতে ইচ্ছে করে না। এই যে ইচ্ছে করে না এ কথাটা কাউকে বলতেও পারে না শওকত।
ব্যবসায়িক কারণে বাইরে অনেক শত্রু গজিয়েছে। সেদিন গভীর রাতে সাপ সাপ বলে চিৎকার করে উঠে শওকত। পাশে স্ত্রী-সন্তান থাকলেও চিৎকারের শব্দ ঘুম ভাঙতে পারেনি। রাত কাটে ভয়ের চাদর মোড়িয়েই। পরদিন সকালে নাস্তা খাওয়ার সময় স্ত্রীকে শওকত রাতের ঘুমভাঙা খোয়াবের গল্প বলে।
একটা পাঁচ মাথাওয়ালা সাপ। হঠাৎ সামনে এসে পড়ে। যেনো কেউ ছুঁড়ে মারলো। সাপটির পাঁচ মাথা। ফণা তোলে আমার উদ্দেশ্যে। ভীত আমি ভয়ে কাঁপতে থাকি। তরঙ্গের মতো। দিশে না পেয়ে দৌঁড়াতে থাকি। পেছন পেছন সাপটি ছুটতে থাকে। দিগ্বিদিক ছুটতে ছুটতে আমি হাঁপিয়ে উঠি। শ্বাসকষ্টের রোগীর মতো যেনো আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। পা আর চলে না। জোর করেও চালাতে পারি না। হুমড়ি খেয়ে পড়ি জনহীন গাছের ছায়ায়। চোখবুঁজে বড় বড় দম ফেলি আর নেই। কিছুক্ষণ পর চোখ খোলতেই দেখি সাপটি ফণা তুলে আমার সামনে দাঁড়িয়ে। সে অপেক্ষা করছিলো প্রকাশ্যে ছোবল মারবে। আমার ভীতসন্ত্রস্ত চোখ দেখে সাপটির মায়া লাগলো ভাবি; কিন্তু ফণা নামায় না। কিছুটা নিরবতা শেষে আশ্বস্ত হই ছোবল আমার জন্যে নয়। ভাবনা মিথ্যে হতে কয়েক সেকেন্ড সময় নিলো না। ব্যথায় কাতর পায়ে ছোবল মারতেই চিৎকার দিয়ে উঠি। ঘুম ভেঙ্গে যায়। তুমি গভীর নিদে বিভোর।
-আমাকে ডাকলে না যে। স্বপ্নের অর্থ দাঁড়ায়, তোমার নতুন শত্রু জন্ম নিয়েছে। ক্ষতি করতে প্রস্তুতি নিচ্ছে। সাবধানে চলাফেরা করো।
শওকত দখিণের জানালার দিকে তাকায়। মিহি হাওয়া উঠে আসছে ঘরের ভেতর। যেভাবে ভয় মনের ভেতর আগলে রেখেছে।
শওকত ঘরে ঢুকলেই প্রথমে নিজের রুমের জানালা বন্ধ কি না দেখে নেয়। খোলা থাকলে ছিটকিনি আটকে নেয়। তার মনে ভয় ঘরের জানালা দিয়ে দূর থেকে যে কেউ গুলি করতে পারে অথবা জানালার দিকে পিছ দিয়ে বসলে বা উল্টো মুখে ঘুমালে গলায় ছুরি দিয়ে পোচ দিয়ে খুন করতে পারে। এ ভয়ে এখন আর দখিণের জানালা রাতের বেলায় খোলা রাখে না শওকত। ভাবে এই বুঝি কেউ গুলি ছুড়লো। ক্ষণিকেই বেরিয়ে আসবে গুলি। জানালা দিয়ে প্রবেশ করে মস্তকের পেছন দিকে ছেদ করে বেরিয়ে পড়বে।
রাতের আঁধারে দূর থেকে কেউ গুলি করে চলে গেলে টেরই পাওয়া যাবে না। এখন শওকত জানালার পাশে ঘুমায় না। জানালার পাশে স্ত্রীকে দিয়ে নিজে স্ত্রীর উল্টো দিকে ঘুমায় শওকত।
পাশের বাড়ির রমজান আলী শওকতের উধাও হওয়ার বিষয়টি জেনে যায়। ব্যবসা-টেবসা কিছু না। হেরা দল বাইন্দা আকামে গেছে। ক্রিমিনাল মানুষ সন্দেহের ভেতর দিয়ে বিশেষ কিছু নিশ্চিত হয়ে নেয়। বিকেলে হাঁটতে বেরিয়েছে শওকত। বাড়ির পাশের রাস্তা ধরে হাঁটছিলো। মূলত চলে যাচ্ছে। পথেই দেখা পেয়ে রমজান আলী বলে, কই যাও কাকা?
-এইতো হাঁটছি।
-আর যাইও না। তোমার সম্পর্কে সব জাইনা গেছে হেরা। হুদাহুদা নিজের লাইগা পরিবারটারে ধ্বংস কইরো না। চলতে চলতে কথা শুনছিলো শওকত। কিন্তু দাঁড়ায় না।
-কাকা আমি ব্যবসার কাজে খুলনা যাচ্ছি। আপনি তো জানেন আমি প্রায় সময়ই বিভিন্ন জেলায় যাই। দুদিন হলো আসছি। এখন আবার জরুরি কাজ পড়েছে। তাই যাচ্ছি।
-এই সময়ে বাইচ্চা থাকনই তো বড় দায়। ব্যবসার কথা কইয়া কই যাও আমি জানি। কথা ঘুরাইও না। দেশটার গণ্ডগোল বাড়াইও না। দেশ স্বাধীন হইয়া কী অইবো? সব দেখবি লুইটা পুইটা খাইবো। দেশের মানুষ স্বাধীন স্বাধীন বইলা চিল্লায়, স্বাধীন হইলে কিছুই পাইবো না।
-কাকা আমি এসব নিয়ে ভাবছি না। আমার অনেক কাজ বাকি। যাইতে অইবো। যুদ্ধ যুদ্ধের জায়গায় আছে। ব্যবসা-বাণিজ্য না করলে খাব কী? সংসার চলবে কী ভাবে?
-যাও যাও ভাতিজা। দেশ স্বাধীন হইলে তুমিও দেখবা আমিও দেখমু। প্রত্যেইক মিনিট কিইন্না এ দেশে থাকতে অইবো। তয় যাও ভাতিজা। নিজের দিকে খেয়াল রাইখো।
শওকত কোনো মতে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। রমজান কাকা এলাকায় অনেক প্রভাবশালী। ওনার লগে তক্কে যাওয়া বোকামী। বরং কথা না বাড়িয়ে হাঁটা শুরু করে শওকত।
স্বাধীন খুব অসুস্থ। নাভিতে ইনফেকশন করেছে। গ্রাম্যডাক্তার অসুখ একটু জটিল হলেই চিকিৎসা দেয়ার সাহস পায় না। দাদা ইফতেখার নাতি স্বাধীনকে নিয়ে চলে আসে সদর হাসপাতালে। ততোদিনে স্বাধীনের নাভিতে একটু বেশিই পচন ধরেছে। ডাক্তার কিছু ওষুধ লিখে দেয়। আর দুইদিন পরপর ড্রেসিং করতে হবে বলে জানায়। দাদা ইফতেখার দুইদিন পরপর নাতি স্বাধীনকে হাসপাতালে নিয়ে এসে চিকিৎসা করায়। আট-দশ কিলোমিটার হেঁটে আসতে হয়।
ইফতেখার উদ্দীন স্বাধীনের মাকে বলে, শওকত কী বলে গেছে কবে আসবে? এখন এতো ব্যবসা করার কী দরকার। দেশের যে হাল-অবস্থা। নাতিটাকেও একবার দেখে যেতে পারে।
-বাজান আমাকে কিছু বলে যায়নি। কোথায় গেছে জানি না। কবে ফিরবে তাও বলেনি।
-কিন্তু নাতিরে এভাবে আমি কয়দিন হাসপাতালে নিয়া যামু? দেশের এমন অবস্থায় কী ব্যবসা নিয়ে পইরা রইছে? আগে তো মানুষ। মানুষ বাঁইচা থাকলে ব্যবসা করন যাইবো। এবার এলে আর যাইতে দিও না।
-বাবা নাভী টান ধরেছে। পুঁজপড়া বন্ধ হয়েছে। শুকাতে শুরু করেছে। এখন না নিলেও চলবে। ওষুধ খাওয়ালেই ভালো হয়ে যাবে স্বাধীন। এখন আর আপনার কষ্ট করে হাসপাতালে যেতে হবে না। আল্লাহ ভরসা।
ইফতেখার উদ্দীন আলহামদুলিল্লাহ বলে ঘরে প্রবেশ করে। রাত নামে। দিন নামে।
দেশ স্বাধীন হয়। নতুন নতুন চোর জন্মায়। দিনদিন কোটিপতি বাড়ে। স্বাধীনতা বেড়ে উঠে। শুধু শওকত বাড়ি ফিরে না।