প্রকাশ : ২৯ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
বন্ধুত্ব
আমরা অনেকেই মনে করি, বন্ধুত্ব মানে শুধু সহায়ক বা উপকারী কোনো ব্যক্তি। আসলে বন্ধুত্বের মানে কি তাই? একে অপরের উপকারী হবে, তাছাড়া আর কিছু নয়? প্রকৃতপক্ষে বন্ধুত্ব বলতে কি বোঝায় শুধু সাহায্যকারী, না অন্য কিছু? বন্ধুত্ব কী? বন্ধুত্ব হচ্ছে দুই অথবা তার অধিক কিছু মানুষের মধ্যে একটি সম্পর্ক-বিশেষ। যাদের একে অপরের প্রতি পারস্পরিক স্নেহ, ভালোবাসা, শ্রদ্ধাবোধ রয়েছে। বন্ধুত্বকে ব্যক্তিগত সম্পর্কের খুব কাছের একটি অংশ ধরা হয়।
দার্শনিক এমারসন বলেছেন, ‘একজন বন্ধু হচ্ছেন প্রকৃতির সবচেয়ে বড় মাস্টারপিস’। বন্ধুত্বের গুরুত্ব উপলব্ধি করার জন্যে কবি বা দার্শনিক হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। আপনার আনন্দ এবং দুঃখে আপনার পাশে কেউ না থাকলে আনন্দ যেমন বহুলাংশে মাটি হয়ে যায়, তেমনি দুঃখও সহজে হালকা হয় না। মানুষ যখন বেদনা ভারাক্রান্ত হয়ে উঠে, তখন বন্ধুর কাছ থেকে সে প্রথম সান্ত¡না পায়; আর যখন আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠে তখন এ আনন্দের খবর সে প্রথম বন্ধুকেই জানায়।
বন্ধুত্বের সাথে যেহেতু আবেগের ব্যাপার জড়িত সেহেতু বন্ধুত্ব আনন্দের সাথে সাথে সমস্যারও সৃষ্টি করতে পারে। তাই বন্ধুত্বের সংজ্ঞা, বন্ধুর কাছ থেকে কতটুকু চাওয়া ও পাওয়া যেতে পারে, সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা থাকলে ভুল বোঝাবুঝির বা সমস্যার পরিমাণ অনেক কমে যেতে পারে।
ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা একে অন্যের জীবনের সবকিছুতেই ভাগীদার হবে--সাধারণভাবে এ ধারণা প্রচলিত হলেও আধুনিক নগরজীবনে এ ধারণা বাস্তবসম্মত নয়। অধিকাংশের কর্মজীবনের বন্ধু এবং পারিবারিক বন্ধু ভিন্ন। আবার পড়শিদের সাথে যে বন্ধুত্ব তা-ও আলাদা। শখ বা আগ্রহের ভিত্তিতে যে বন্ধুত্ব গড়ে উঠে তা-ও আলাদা। আবার ধর্মচর্চার বেলায় দেখা যায় সম্পূর্ণ আলাদা কারোর সাথে বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে। জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন ব্যক্তির সাথে বন্ধুত্ব এক সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ঘটনা। কারণ মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, জীবনের সব ব্যাপারেই দুই ব্যক্তির মধ্যে আগ্রহের মিল হওয়া খুব দুর্লভ ব্যাপার। এমনকি আপনার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধুদেরও এমন কিছু আগ্রহ ও শখ থাকতে পারে যেগুলোর সাথে আপনার আগ্রহের আদৌ মিল নেই।
তাছাড়া সদা নির্ভরযোগ্য বন্ধুত্ব কামনা, শিশুসুলভ নিরাপত্তাহীনতা বোধেরই প্রকাশ। একজন বন্ধুর উপর পুরোপুরি নির্ভরতা অনেক সময়ই দুঃখের কারণ হতে পারে। অপরপক্ষে তার সামাজিক পরিধি বাড়ানোর চেষ্টা করলেই প্রথম পক্ষকে দুঃখবোধে পেয়ে বসতে পারে। তাই একক বন্ধুত্বের চেয়ে একাধিক বন্ধুত্ব সবসময়ই আবেগগতভাবে ভালো। সত্যিকারের বন্ধুত্ব মানে আজীবন বন্ধুত্ব--এ ধারণা সবসময় ঠিক নয়। তবে এখন ভার্চুয়াল জগতের কারণে বন্ধুত্ব আজীবন টিকিয়ে রাখার সুযোগ রয়েছে। ছোটবেলায় যে বন্ধুত্ব গড়ে উঠে, শিক্ষাজীবনে যে ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে, কর্মজীবনে প্রবেশ করার পর তার অধিকাংশই হারিয়ে যায়। আবার বাসস্থান পরিবর্তনের কারণেও পুরানো বন্ধুত্বের জায়গায় নতুন বন্ধুত্বের সৃষ্টি হয়। কর্মজীবী মানুষের বেলায় এ ব্যাপারটি আরও সুস্পষ্ট। কর্মজীবনে বা শিক্ষাজীবনে অনেকের সাথে বন্ধুত্ব হয়, কর্ম ও শিক্ষাজীবন ত্যাগ করে পুরোপুরি সংসারি হয়ে গেলে তখন বন্ধুত্বের আওতা পুরোপুরি পাল্টে যেতে পারে। তবে এ ধরনের খণ্ডকালীন বন্ধুত্বকেও কম গুরুত্বপূর্ণ মনে করার কোনো প্রয়োজন নেই। জীবনের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কালে বিভিন্ন মানুষের সাথে প্রয়োজনীয় ও আনন্দদায়ক বন্ধুত্ব হতে পারে।
বন্ধুত্বের যোগ্যতা যাচাইয়ে যে বিষয়গুলো আবশ্যক : পারস্পরিক বিশ্বাস, একে অপরের সঙ্গ উপভোগ করা, সহানুভূতি থাকা, পারস্পরিক কোয়ালিটি সময় দেয়া, পারস্পরিক যোগাযোগ রক্ষা করা, পারস্পরিক চিন্তা-ভাবনা ও মূল্যবোধের গুরুত্ব দেয়া, কম্প্রোমাইজ করার ক্ষমতা থাকা, মানসিক সমর্থন দেয়া, অন্যের ভালো কীভাবে হবে এই বাসনা থাকা, কঠিন সত্যের স্বীকার করে হলেও নিজের সততার প্রমাণ দেয়া, প্রয়োজনে সবার জন্যে ইতিবাচক, গভীর কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে নিজেদের মধ্যে সমঝোতা করা, তুমি কী করতেছ এটা নিয়ে বন্ধুদের মধ্যে কোনো সংশয় না থাকা, একে অপরের সাথে ঝগড়া করলে বা মনে কষ্ট দিয়ে থাকলে, সহানুভূতির সাহায্যে তা মিটিয়ে ফেলা।
বন্ধুত্বের প্রকারভেদ : বন্ধু হচ্ছে যাদের আমরা জানি ও বিশ্বাস করি এবং যারা আমাদের সামাজিকভাবে ও আবেগের জন্যে পছন্দের। সাধারণত বন্ধু হয় এমন যারা আমাদের নিজেদের মতো হয়ে থাকে। প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ বন্ধু হিসেবে এমন ব্যক্তি খোঁজে, যারা একসঙ্গে বড় হয়েছে, অনুরূপ পেশাতে কাজ করছে, সমবয়স্ক শিশুদের বাবা-মা, একই ব্যাপারে আগ্রহ আছে এমন ব্যক্তি, সাধারণত একই বয়স এবং একই লিঙ্গ, কখনো সমবয়সী বিপরীত লিঙ্গের ব্যক্তি।
প্রাপ্তবয়স্কদের তিন বা তার বেশি ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং ১০ বা তার বেশি বন্ধু থাকে। পুরুষ এবং নারীদের বন্ধু একই সংখ্যক আছে। কিন্তু পুরুষদের তুলনায় নারীদের বন্ধুত্ব বেশি নির্ভরশীল হতে দেখা যায়। তবে নারীদের তুলনায় পুরুষদের বন্ধুত্ব স্থায়ী হয় বেশি। শৈশবের শেষ ও কিশোর বয়সের শুরু থেকে বন্ধুত্বের শুরু হয়। তবে গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুত্ব আগের বন্ধুত্বের চেয়ে দীর্ঘস্থায়ী হয়। সবাইকে বন্ধু নির্বাচন করা যাবে না, বরং গুণ দেখে বন্ধু নির্বাচন করা উচিত। বন্ধুকে হতে হবে জ্ঞানী, বিচক্ষণ, সৎ, আন্তরিকতাসম্পন্ন, উদার ও ভালো মনের অধিকারী মানুষ।
ফরাসি এক প্রবাদে বলা হয়েছে, ‘বন্ধুত্ব হলো তরমুজের মতো। ভালো একশ’টিকে পেতে হলে, আগে এক কোটি পরীক্ষা করে দেখতে হয়। ইরানের বিখ্যাত মনীষী শেখ সাদী (রহঃ) বলেছেন, ‘সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ’। এ উক্তির মূলকথা হচ্ছে, একজন উত্তম বন্ধু যেমন জীবনের গতি পাল্টে দিতে পারে, তেমনি একজন অসৎ বন্ধু জীবনকে ধ্বংসের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে দিতে পারে। তাই যাকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করবে তাকে আগেই যাচাই-বাছাই করে নিতে হবে। বিশ্ব বিখ্যাত মনীষীরা বন্ধুত্বকে ব্যাপক গুরুত্ব দিয়েছেন এবং সবাইকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ না করতে বলেছেন। বেছে বন্ধুত্ব করলে তা দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং বন্ধুত্ব রক্ষা করার ব্যাপারে সতর্ক ও আন্তরিক থাকতে বলেছেন। মোদ্দা কথা, মানুষ জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে এক ও অভিন্ন।
মোঃ নূর ইসলাম খান অসি : নাট্যকার, প্রবন্ধকার ও সংগঠক। ছাত্রজীবনে দীর্ঘদিন (১৯৭০-১৯৮৭) মুজিবাদর্শের ছাত্র সংগঠনের সাথে সক্রিয়ভাবে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। সাবেক পরিচালক, ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি (সিপিপি), দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার।