প্রকাশ : ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০
দিবাকর যেমন তার অফুরন্ত দীপ্তরশ্মি বলে সমগ্র বিশ্বকে আলোকিত ও উদ্ভাসিত করে, ঠিক তেমনি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথও (১৮৬১-১৯৪১) বাংলা সাহিত্যাকাশকে আলোকিত ও উদ্ভাসিত করেছেন। রবীন্দ্রনাথের আবির্ভাব বাঙালি জাতির জন্যে চরম সৌভাগ্যের ও এক পরম বিস্ময়কর ব্যাপার। ভাষার জন্যে, সাহিত্যের জন্যে, সর্বোপরি বাঙালি জাতির জন্যে এমন স্মরণীয় ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ইতঃপূর্বে আর কখনও ঘটেনি। তাঁর সাহিত্য সৃষ্টি দেশ-কাল-পাত্রের সংকীর্ণ গণ্ডি অতিক্রম করে এক সার্বজনীন রূপ ধারণ করে বিশ্বসাহিত্যকে করেছে প্রশস্ত ও বিকশিত।
‘সন্ধ্যাসংগীত’ হতে কবির কাব্যজীবন আরম্ভ হয়েছে বলে অনেকে ধারণা করেন। এর কারণ এই নয় যে, ‘সন্ধ্যাসংগীত’ কবির পরিণত শক্তির রচনা। ‘সন্ধ্যাসংগীত’ হতে পরবর্তী ৪/৫ খানি কাব্যের মূল্য আমাদের কাছে যতো না কাব্য হিসেবে, তার চেয়ে বেশি গ্রহণীয় ও মূল্যবান কবিজীবনের ইতিহাসরূপে।
রবীন্দ্রনাথের যখন পূর্ণ যৌবন সে সময়ে লেখা কবিতাগুচ্ছ একত্রিতভাবে ‘মানসী’ নামে পুস্তকাকারে ১২৯৭ সালের ১০ পৌষ প্রকাশিত হয়। অধ্যাপক সুরেন্দ্র নাথ দাসগুপ্ত ‘মানসীকে’ রবীন্দ্রনাথের কবি প্রতিভার উন্মেষ বলে উল্লেখ করেছেন। অতি বিশাল রবীন্দ্রকাব্যের পৌর্বাপর্ব বিচার-বিশ্লেষণ করে এবং একটি নির্দিষ্ট ধারায় তাঁর প্রতিভার ক্রমণ্ডপরিণাম লক্ষ্য করে ‘মানসী’ শেষ থেকেই ওই বিশিষ্ট প্রতিভার উন্মেষ বলে মনে করা হয়। ‘মানসী’ রবীন্দ্রনাথের পরিণত শক্তির কাব্য, কিন্তু তাঁর বিশিষ্ট শক্তির কাব্য নয়।
বিশিষ্ট কবিপন্থায় তিনি ‘সোনারতরী’তে এসে উপস্থিত হন, কিন্তু যার সূচনা ‘সন্ধ্যাসংগীত’। কবির ‘সন্ধ্যাসংগীত’ হতে ‘মানসী’ পর্যন্ত পাঁচখানি কাব্যের একটি পরীক্ষামূলক ভাব আছে। সে পরীক্ষা তাঁর বিশিষ্ট শক্তির স্বরূপ অন্বেষণে। একদিকে ‘সন্ধ্যাসংগীত’ (১২৮৮ বঙ্গাব্দ) ও ‘প্রভাতসংগীত’ (১২৯০ বঙ্গাব্দ), আবার অন্যদিকে ‘ছবি ও গান’ (১২৯০ বঙ্গাব্দ), ‘কড়ি ও কোমল’ (১২৯৩ বঙ্গাব্দ)। আর মানসীতে (১২৯৭ বঙ্গাব্দ) এসে দু কাব্যরীতির যুক্তবেণী গ্রথিত হয়েছে।
মানসী কাব্যে রাজা রবীন্দ্রনাথ ছন্দের উপর তার অধিকার কায়েমিভাবে সাব্যস্ত করে নিয়েছেন। ইউরোপীয় ছন্দের অনুরূপ নানা ধরনের নব নব ছন্দ তিনি সৃষ্টি করলেন। মধুসূদনের পক্ষে যেমন অমিত্রাক্ষর, কবিগুরুর পক্ষে তেমন ‘মুক্ত পয়ার’। ‘মানসী’ কাব্যে রবীন্দ্রনাথ তাঁর পূর্ববর্তী কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত ও হেমচন্দ্রের অনুবর্তী হয়ে কবিতার স্ট্যাঞ্জ বিভাগ অবলম্বন করলেন। এর পূর্বে বাংলার খ্যাতিমান কবিগণও অক্ষর গুণে কবিতা রচনা করতেন। গানের রাজা রবীন্দ্রনাথই প্রথমবারের মতো ‘মানসী’ কাব্যের মধ্যকার কবিতার মাত্রা গুণে, কানে শুনে তাল বোধের দ্বারা কবিতা রচনা আরম্ভ করেন। এটি বাংলা ছন্দে তার একটি বিশেষ অবদান।
‘মানসী’ কাব্য ছন্দের হতেই কবি মুক্তাক্ষরের পূর্ব স্বরকে দু মাত্রা ধরে কবিতা রচনা করতে লাগলেন। এ সম্পর্কে কবির নিজের বক্তব্য, ‘আমার রচনার এ পর্বেই যুক্ত অক্ষরকে পূর্ণমূল্য দিয়ে ছন্দকে নূতন শক্তি দিতে পেরেছি’। ‘মানসী’ কাব্যেই ছন্দের নানা খেয়াল দেখা দিতে শুরু করেছে। কবির সঙ্গে যেনো একজন শিল্পী এসে যোগ দিলো।
মানসী বস্তুরূপ হতে বস্তুস্বরূপে, কায়াময় সত্য হতে ছায়াময় সত্যে, কালীদাসীয় মানস হতে সূরদাসীয় অর্থাৎ চিত্ররীতি হতে সঙ্গীতরীতিতে সংক্রমের কাব্য। ভাবের দিক হতে মানসী কাব্যের কবিতাগুলোকে আমরা মোটামুটিভাবে তিন শ্রেণিতে বিভক্ত করতে পারি। যেমন : ১. প্রেমের কবিতা, ২. দেশ সম্বন্ধীয় কবিতা ও ৩. প্রকৃতির নিষ্ঠুরতা ও অমোঘ নিয়তির সম্বন্ধে কবিতা।
‘তোমারেই যেন ভালোবাসিয়াছি/শতরূপে শতবার/জনমে জনমে যুগে যুগে অনিবার’
‘মানসী’ কাব্যে এসে তার প্রেমের কবিতার একটি শান্ত সমাহিত ভাব এসেছে। পূর্বেকার কাব্যের উদ্দামণ্ডউচ্ছ্বাস অনেকখানি সংযত হয়ে এসেছে। অথচ যৌবনের আনন্দ-আবেগ কিছু মাত্র হ্রাস পায়নি। ‘মানসী’র প্রেমের কবিতাগুলোর মধ্যেই নর-নারীর পরস্পরের আকর্ষণের সুসঙ্গতি হয়েছে। একদিকে মানবীয়ভাবে কবিতাগুলো চিত্তাকর্ষক, আর অন্যাদিকে সংযত শালীনতায় তারা হৃদয় প্রসাধন। ‘ইংরেজ চেয়ে কিসে মোরা কম।/আমরা যে ছোটো সেটা ভারি ভ্রম/আকার প্রকার রকম সকম/এতেই যা কিছু ভেদ।’ মানসী কাব্যের মাধ্যমেই প্রথম কবিদৃষ্টি দেশের ত্রুটি ও দেশবাসীর চরিত্রের গলদ দেখতে আরম্ভ করেন। মানসী কাব্যেও তিনি দরদী হতে পারেননি লঘু বিদ্রূপের দ্বারা, তিনি দেশের ত্রুটি সংশোধনের চেষ্টা আরম্ভ করলেন মাত্র। এ কাব্যের মাধ্যমে দেশ ও সমাজের অবস্থার দিকে, দেশবাসীর মানসিক দুর্গতির দিকে কবি প্রথমবারের মতো নজর দেন।
‘মানসী’ কাব্যে এসে রবীন্দ্রকাব্যে প্রথম প্রকৃতির স্থানিক মূর্তির পরিচয় মেলে। এর পূর্বে যে প্রাকৃতিক চিত্র তিনি অংকিত করেছিলেন তা প্রীতিজাত বটে, কিন্তু তেমন অভিজ্ঞতাজাত নহে।’ ‘পাশাপাশি এক ঠাঁই দয়া আছে দয়া নাই/বিষম সংশয়/একি দুই দেবতার দ্যুত খেলা অনিবার/ভাঙা গড়াময়?। চিরদিন অন্তহীন জয়পরাজয়’।
‘মানসী’র প্রকৃতি সম্বন্ধীয় কবিতাগুলোর মধ্যে একটা ভয়মিশ্রিত সম্ভ্রমের ভাব আছে, আর আছে গভীর রহস্যময় চিত্র পরস্পর। ‘মানসী’ কাব্যেই প্রথম কবির দৃষ্টিতে মমতাহীন নিষ্ঠুর দিকটি ধরা পড়ে। ‘মানসী’তে এসেই কবি উপলব্ধি করেছিলেন যে, যিনি শিব, তিনিই রুদ্র।
‘মানসী’ কাব্যগ্রন্থে রবীন্দ্রনাথের অখণ্ড সৌন্দর্য চেতনা ও নিষ্কাম প্রেমানুভূতির যে ঘোষণা করেন তা লক্ষ্য করা যায় এ কাব্যগ্রন্থের বিখ্যাত কবিতা ‘নিষ্ফল কামনা’য়। যেমন : ‘এ চির জীবন তাই আর কিছু কাজ নাই/রচি শুধু অসীমের সীমা/আশা দিয়ে ভাষা দিয়ে তাহে ভালোবাসা দিয়ে/গড়ি তুলি, মানসী প্রতিমা।’
‘মানসী’তে ভাষা ও প্রকাশভঙ্গি যেনো আপনা থেকেই রসমূর্তি লাভ করেছে। মাত্রাবৃত্ত ছন্দে অশিথিল বন্ধ রীতি নৈপুণ্যে ভাষা সাধারণ মানবীয় সুখণ্ডদুঃখের বিবৃতি ক্ষমতামাত্র অতিক্রম করে অতীন্দ্রিয় ব্যঞ্জনাময় সামর্থ্য লাভ করেছে। ‘কড়ি ও কোমল’ পর্যন্ত কোথাও কোথাও ভাষার মধ্যে আড়ষ্টতা আছে। কিন্তু ‘মানসী’তে এসে তা থেকে অনেকটা পরিমার্জিত রূপ লাভ করে। উচ্ছ্বাসময়তা থেকে মুক্তি লাভ করে রূপ ও রসের প্রগাঢ়ত্বের মধ্যে ‘মানসী’র কয়েকটি কবিতা অপরূপ প্রসন্নতা লাভ করেছে। যা মানসীর পূর্বের কাব্যগুলোতে তেমনটি দেখা যায় না। সত্যি কথা বলতে কী, রবীন্দ্রনাথের কাব্যভাষার প্রধান গুণাবলি ও বৈশিষ্ট্য ‘মানসী’র মাধ্যমেই জন্মলাভ করে।
‘রামায়ণ’-এর কবি বাল্মীকি ও ‘মেঘদূতে’র কবি কালিদাসের কবিত্ব শক্তিলাভ সম্বন্ধে যে কিংবদন্তি প্রচলিত আছে, তার মধ্যে এ মহৎ শিল্প তত্ত্বটি নিহিত যে, দিব্য কবিত্ব ভাব। রবীন্দ্রনাথের দিব্য শক্তি লাভও এ ধরনের আবির্ভাব। এ আবির্ভাবকে চূড়ান্ত বিশ্লেষণ করে বোঝানো সম্ভব নয়।
‘প্রভাতসংগীতে’র অভিজ্ঞতা যদি রবীন্দ্রনাথের জীবনে না ঘটতো তাহলেও তিনি মহৎ কবি হতেন, কিন্তু দিব্য দৃষ্টিসম্পন্ন কবি হতেন কিনা ও বিশ্ববোধ ঘটতো কিনা সন্দেহ। ‘প্রভাতসংগীতে’র প্রধান কবিতা ‘নির্ঝরের স্বপ্নভগ্ন’ ও ‘প্রতিধ্বনি’র মধ্যে বীজ রূপে রবীন্দ্রকাব্যের তত্ত্ব নিহিত। নির্ঝরের গতিময় বিশ্ব এবং প্রতিধ্বনির ছায়াময় বিশ্ব এ দুইয়ে মিলে রবীন্দ্রকাব্যের পূর্ণতত্ত্ব। ‘ছবি ও গান’ ও ‘কড়ি ও কোমল’-এ এসে কবির অভিজ্ঞতা যেনো কোনো দূর আকাশ হতে বাণীর বিদ্যুৎ দীপ্তিতে দিব্য দৃষ্টি বহন করে কবির মধ্যে যেনো দুটি সত্তা বাস করে। একটি অনুপ্রেরণানির্ভর কবিসত্তা অপরটি শিল্পীসত্তা। মূলে আছে নিছক শিল্প সৃষ্টির তাগিদ। ‘সন্ধ্যাসংগীত’ ও ‘প্রভাতসংগীত’- এ দুখানি কাব্যের অনুপ্রেরণা যদি আসে বাহির হতে, তাহলে ‘ছবি ও গান’ ও ‘কড়ি ও কোমল’ কাব্যদ্বয়ের প্রেরণা এসেছে কবির অন্তর হতে। সে শিল্পের একমাত্র উদ্দেশ্য সৌন্দর্য সৃষ্টি--‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে/মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।’ শুধু সৌন্দর্য সৃষ্টি নয়, সুন্দর ভুবনের সৃষ্টি। সর্বজনের অভিজ্ঞতা কেবল সর্বজনগ্রাহ্য ভাষাতেই প্রকাশ সম্ভব। পূর্ববর্তী কাব্যদ্বয়ে ‘সন্ধ্যাসংগীত’ ও ‘প্রভাতসংগীত’ ছিলো কেবল স্বকীয় জগৎভাব প্রকাশের ইচ্ছা। কিন্তু পরবর্তী কাব্যদ্বয়ে (‘ছবি ও গান’ ও ‘কড়ি ও কোমল’) মুখ্যত পরকীয়া জগৎভাব প্রকাশ পেয়েছে। অপরপক্ষে ‘মানসী’ কাব্যের মূল সুর প্রেম ও প্রকৃতি।
কবি ও সমালোচক বুদ্ধদেব বসু ‘মানসী’কে সমস্ত রবীন্দ্রকাব্য সাধনার অণুবিশ্ব বলে অভিহিত করেছেন। ‘মানসী’ কাব্যে পরিণত শক্তির কবিতা থাকা সত্ত্বেও তা রবীন্দ্রনাথের পরীক্ষা পর্বের শেষ কাব্য। পরীক্ষা উত্তীর্ণ পর্বের আদি কাব্য নহে। ‘মানসী’তেই এসে একটি পথের শেষ, ‘মানসী’র প্রারম্ভে চিত্ররীতি ও পরিণামে সংগীতরীতি। তার এক কোটিতে মেঘদূত অন্য কোটিতে সুরদাসের প্রার্থনা। এ কাব্যে এসে কবির সীমা টানার প্রয়াস পরিলক্ষিত হয়। ‘মানসী’র কবিতা কোনো নির্দিষ্ট স্থানের মধ্যে আবদ্ধ নয়, বিশেষত এ কাব্যে এসে ছন্দে স্বাধীনতা আসাতে রচনারীতিতে নূতন শক্তি আসায় পূর্বতন রচনা ধারা থেকে স্বতন্ত্র একটা কাব্যরূপের বহিঃপ্রকাশ। এ কাব্যে এসে একটা উদার উন্মুক্ততা ও কল্পনার অকৃত্রিম বিশালতা উপলব্ধি হয়।
‘মানসী’তে কবির প্রকাশ-সামর্থ্য সুনির্দিষ্ট হয়েছে। তাঁর চিন্তাশক্তি পরিপুষ্ট হয়েছে। তিনি দেশের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বিষয়সমূহ সুনিপুণভাবে এবং সমতার সঙ্গে চিত্রিত করেছেন। কবি এ কাব্যে এসে আত্মপ্রত্যয় লাভ করেছেন। এ সময় থেকে কবি তাঁর রচনার তারিখ নির্দেশ করতে আরম্ভ করেন। ‘মানসী’ কাব্যে এসে কবি দক্ষস্রষ্টা হয়ে ওঠেন।
সাহায্যকারী পুস্তকসমূহ : ১. রবীন্দ্র জীবনী (১ম খণ্ড) : প্রভাত কুমার মুখপাধ্যায়। ২. রবীন্দ্র কাব্য প্রবাহ : প্রমথ নাথ বিশী। ৩. কবি রবীন্দ্রনাথ : বুদ্ধদেব বসু। ৪. রবি রশ্মি : চারু চন্দ্র বন্দোপাধ্যায়। ৫. সংস্কৃত কথা : মোতাহের হোসেন চৌধুরী। ৬. রবীন্দ্রনাথ কবি ও দার্শনিক : মনোরঞ্জন জানা। ৭. বক্তৃতামালা : ড. আবু হেনা মোস্তাফা কামাল।
মোঃ নূর ইসলাম খান অসি : সাবেক পরিচালক, ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুত কর্মসূচি (সিপিপি), দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। মোবাইল : ০১৭১১-৫৮৫৮৭৫