প্রকাশ : ১৫ মে ২০২৩, ০০:০০
শিশু কল্যাণ ভবন থেকে বের হয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে বিপুল বললো, শরীরটা ভীষণ রকমের ব্যাক গিয়ার দিচ্ছে বিরেন দা, শরীরটা একটু এলানো-কেলানো দরকার।
বিরেন দা বললেন, এলানো-কেলানো কী? বিপুল বললো, সব কিছু বোঝার দরকার নেই বিরেন দা। দেখুন আশেপাশে কোনো সেলুন পাওয়া যায় কিনা। বিরেন দা বললো, সোনার অঙ্গ আপনার ভাই। বিপুল বলল, সোনার অঙ্গ মানে? কোন্ সোনা এটা পজিটিভ না নেগেটিভ? বিরেন দা বলল, যেটা বোঝেন আপনি, একরাত না ঘুমিয়ে এই অবস্থা, আরে আমারে দেখেন শরীর এখনও তরতাজা। বিপুল বলল, দাদা আপনার শরীর হলো গাব গাছের মতন শক্ত, আমারটা তো সে রকম না। আমারটা হলো ফুলের মতো সৌখিন। বিরেন দা বললো, হইছে বুঝছি আমি। বিপুল বললো, বোঝার জন্য ধন্যবাদ। এবার বিরেন দা বিপুলকে সমর্থন দিয়ে বললো, আসলেই সারারাত ঘুম হয়নি। সেই ভোরে লঞ্চ থেকে নেমেছি, তারপর অফিসের ট্রেনিং। পাঁচ ঘন্টা ট্রেনিংয়ের কথা শুনতে শুনতে মনে হইছে ট্রেইনারদের গলা চেপে ধরে বলি, স্যার এবার মাফ করেন আর আমাদের বিদায় দেন। এখন আবার ফিরতে হবে চাঁদপুর, উফ্। বিপুল বললো, হাঁটেন। তারপর দুজনেই হাঁটা দিলো রাস্তা ধরে।
কিছু দূর হাটার পর একটা সেলুন পাওয়া গেলো। বিপুল দেখলো সেলুনে ভিড় নেই একেবারে। দুটো চেয়ার, একটি চেয়ারে ফর্সা মতন একটি অল্প বয়সী ছেলে বসে আছে, দেখে মনে হলো সে কিছু ভাবছে। বিপুল সেলুনে ঢুকে বললো, ভিড় নেই, ভালোইতো। ছেলেটি যেন আড়মোড়া দিয়ে বিপুলের দিকে তাকালো। বিপুল বললো, শরীরটা ম্যাসাজ করবো, চুলটা ম্যাসাজ করবো, তারপর মুখটা ফেসিয়াল করাবো। তবে খুব সফট হ্যান্ডে ধরবে। বিশেষ করে চুল ম্যাসাজ করার সময়। ছেলেটি বললো, একটু অন্য সেলুনে দেখুন। আমি এখন পারবো না।
কেন, পারবে না কেন?
ভাই আমার ইচ্ছা।
বিপুল বললো, সব ইচ্ছার গুরুত্ব নাই।
তোমার এই ইচ্ছাও গুরুত্বহীন।
ফুড ফর ওয়ার্ক বুঝেছ?
ছেলেটি কথা বাড়ালো না।
বিপুলের দিকে তাকিয়ে চেয়ার থেকে নেমে কাজে হাত দিলো।
বিপুল চেয়ারে বসছে ঠিক সেই মুহূর্তে বিরেন দা বললো, ভাই একটা খেইল আছে আপনার জন্য।
বিপুল চোখ দুটো অবাক করে বললো, খেইল! কী খেইল?
বিরেন দা বললো, আছে আছে। আপনি আগে ম্যাসাজ সারেন।
যাই হোক, সেলুনে বিপুল ক্লান্ত শরীরটা চেয়ারে এলিয়ে বসলো, ছেলেটা কাজ করছে। বিপুল বলল, কি নাম?
ছেলেটি বললো, নিমাই।
ও, মন খারাপ কেন?
আরে ভাই কী আর বলবো। সকালে দোকানটা খুলে ঝাড়ু দিয়ে মুখ ধুয়ে বসছি। এরপর এক বুড়া লোক আসছে চুল কাটবে, আমি তাকে বসিয়ে বাথরুমে গেলাম দোতলায়, এসে দেখি বুড়া লোকটি নেই। তারপর দেখি আমার মোবাইলটাও নাই। নিমাইয়ের কণ্ঠে আফসোস আর বেদনার আর্তি শোনা গেল।
বিপুল বললো, আর কিছু নিছে?
নিমাই যেন আঁৎকে ওঠে।
সে বললো, ভাগ্য ভালো ক্যাশটা তালা মেরে গেছি।
যুগ এতো খারাপ! বুড়া মানুষকেও বিশ্বাস করা যায় না।
বিপুল বললো, যুগ দিয়ে বিচার করলে হবে? সচেতন থাকতে হবে। তো মোবাইল কি খুব দামী ছিল?
না-ভাই পুরান একটা বাটন সেট। পাঁচশ টাকাও বিক্রি করতে পারবে না মনে হয়।
বিরেন দা চুপ ছিল এতোক্ষণ। কথাটা শোনার পর বললো, ধুর ব্যাটা এটা নিয়া তাইলে তোমার এতো টেনশন?
নিমাই বললো, সেট নিয়া টেনশন না, একটা ব্যাপার আছে।
বিরেন দা বললো, ব্যাপারটা কী?
নিমাই বললো, আছে একটা ব্যাপার।
বিরেন দা খুব আগ্রহ নিয়ে বললো, তো বলো। ব্যাপারটা কী?
নিমাই সেই একই কথা রিপিট করলো, ভাই আছে একটা ব্যাপার।
বিরেন দা আশাহত হয়ে ভ্রƒ কুঁচকে থমকে গেলো।
সে হয়তো ভাবছে বিষয়টা কী?
বিপুল বললো, আরে বুঝেন না বিরেন দা। সোজা ব্যাপার।
বিরেন দা আরও বিচলিত হয়ে বলে, আপনিও বুঝে ফেলছেন।
শালার আমিই দুনিয়াদারির কিছু বুঝলাম না। তো বলেন শুনি।
বিপুল বললো, পরে বলবো। বিরেন দা বিরক্ত হয়ে চুপ হয়ে বসে রইলো।
বিপুল চশমাটা চোখে দিয়ে চাদরটা কাঁধের ওপর রেখে উঠে দাঁড়ালো। ছোট চাদর কালো রংয়ের। কাঁধের পর থেকে একটু নিচের দিকে ঝুলে থাকে। মধু রংয়ের একটা পাঞ্জাবি সুন্দর মানিয়েছে তাকে। এমনিতেও সে সুদর্শন পুরুষ দেখতে। লম্বা ও পাতলা শরীরের গঠন, বয়স পঁয়ত্রিশ পেরিয়েছে বোধ হয়। যদিও অনেকে তার পঁয়ত্রিশ শুনলেই অবাক হয়। ব্যাপারটা এমন, কেউ ত্রিশের কোঠায় থাকলে বিপুলকে আদর করে ছোট ভাই ভেবে তুমি তুমি বলে, বিপুলও সেটা বুঝতে পারে। বিরেন দা বিপুলের অফিস সহকর্মী। বন্ধুর মতোই সম্পর্ক।
বিপুল বললো, চলেন দাদা যাত্রা করি।
বিরেন দা বললো, আপনি ফ্রেশ হলেন, আমিও হই। বাদ থেকে কোনো লাভ আছে?
বিপুল বললো, কোনো লাভ নেই।
বিপুল রাস্তায় এসে একটা সিগারেট ধরিয়ে দোকানের পাশেই দাঁড়ালো। তার কিছুক্ষণ পর বিপুলের মোবাইল বাজলো। দেখলো বিরেন দার কল। বিপুলের সেলুনের সামনে যেতেই বিরেন দা খুব উৎকণ্ঠায় বললো, ভাই ভাই প্লিজ একটু প্রেসক্লাবের সামনে যান। আমার একজন গেস্ট আছে, একটু নিয়া আসেন।
বিপুল বললো, আমি কিভাবে চিনবো। ধরেন আমার মোবাইলটা নিয়ে যান। কল আসবে, কথা বইলেন।
প্রেসক্লাব এখান থেকে দু-চার মিনিটের পথ। বিপুল মোবাইলটা নিয়ে হাঁটা ধরলো। রিং বাজলো বিরেন দার ফোনে। অচেনা নাম্বার। বিপুল ভাবলো ধরবে কিনা। তাছাড়া বিরেন দার গেস্টের নাম কী তাওতো জিজ্ঞেস করা হয়নি। গেস্ট হলেও তো নাম্বার সেভ থাকার কথা। যাক বিপুল কল রিসিভ করলো। বিপুল হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে রাগান্বিত ও খুব ঝাঁঝালো কণ্ঠ শোনা গেলো।
বিরেন দার গেস্টের কথা এরকম--আপনি আসলে কোনো মানুষের পর্যায়ে পড়েন না। বললেন সায়দাবাদ আসতে। এখন সেখান থেকে বললেন প্রেসক্লাবে আসতে, এসে অপেক্ষা করছি, আপনার দেখা নেই। বিপুল বললো, আসছি আর কয়েক সেকেন্ড লাগবে, আর আপনি কোথায় আছেন?
ওপাশ থেকে বললো, আমি সিএনজিতে আছি।
প্রেসক্লাবের গেটের একটু সামনে। আমি বললাম, নেমে গেটের সামনে আসেন। ওপাশ থেকে বললো, ভাড়া দিতে হবেতো। ঠিক আছে আসছি। বিপুল এই কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ভাবলো। বিরেন দা যে বলেছিলো খেইলের কথা, এটাই কি সেই খেইল?
আমি সিএনজির সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই মেয়েটি বললো, আসলে আপনার বন্ধু একটা ফাউল। আমার মাথার ওপর দিয়ে মনে হলো খুব স্পিডে একটা বাউন্স বল গেলো। কোনোক্রমে আত্মরক্ষা করে বললাম, আপনি আমাকে চিনেন?
খুব স্বাভাবিক উত্তর, চিনি।
বিপুল বললো, আপনার নাম?
খুব দ্রুত উত্তর, অনামিকা...।
আমি বললাম, কিভাবে চেনেন আমাকে বলা যাবে?
মেয়েটি বললো ধীরে ধীরে জেনে যাবেন।
বিপুল বললো, আরে সর্বনাশ। কী রহস্য। ধীরে বহে মেঘনা।
অনামিকা তির্যক রশ্মির উষ্ণ চোখে বিপুলের দিকে তাকিয়ে বললো, কোথায় আপনার বন্ধু? আছে, রাস্তা পার হয়ে সামনের গলিপথে যেতে হবে।
ওই গলি পথে-টথে যেতে পারবো না। তারে আসতে বলেন।
বিপুল বললো, তার মোবাইল আমার কাছে, বলবো কিভাবে?
মেয়েটি বিরক্ত চোখে রক্তজবার মতো লাল হয়ে আছে।
আমি বললাম, আচ্ছা আপনি কি হিন্দু না মুসলমান? অনামিকা বললো, ক্যান?
জমিনের কোনো হিন্দু-মুসলমান আছেনি, লাঙ্গল ফলাবেন, চাষবাস কমপ্লিট।
বিপুল বললো, আপনি কি জমিন?
অনামিকা বললো, হুম আমি জমিন।
বিপুল বুঝলো বিরেন দার খেইল বুঝি এখান থেকেই শুরু।
বিপুল বললো, চলেন এবার রাস্তার ওই পাড়ে যাই।
অনামিকা সায় দিলো। চোখে তার সানগ্লাস। চুল খোলা। ঠোঁটে লিপস্টিক দেয়া।
মাঝারি ধরনের লম্বা সে। শরীর শ্যাম বর্ণের। উজ্জ্বল শ্যামলা কথিত ভাষায় মানুষ যা বলে। সরিষা রংয়ের একটি জামা পরেছে মেয়েটি। তাকে দেখাচ্ছেও সুন্দর। চটপটে ও চঞ্চল ধরনের সে।
রাস্তা ক্রস করে সামনে এগুতেই বিরেন দার সাথে দেখা।
হন্তদন্ত হয়ে হাঁটছে। উ™£ান্ত আর উদ্বিগ্নতায় উদ্দেশ্যকে যেন তাড়া করছেন তিনি।
দেখা হতেই অনামিকা বললো, আপনার তো কথা কাজে ঠিক নাই। থাকার কথা কই, আছেন কই?
বিরেন দা বললো, এতো ভাব কিসের?
কাজ ও ব্যস্ততায় আছি।
আচ্ছা চলেন ধানমন্ডি লেকে যাই।
এই বলে বিরেন দা একটা সিএনজি ডাকার উদ্দেশ্যে সামনে গেলেন।
অনামিকা বিপুলের ঘা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে।
বললো, আপনার বন্ধু চায় কি?
বিপুল অপ্রস্তুত হয়ে যায়। সে একটু সরে দাঁড়িয়ে বলে, কী চায় আপনি জানেন না?
অনামিকা বললো, আমাকে আসতে বলেছে, আমি আসছি।
বিপুল বললো, আপনাকে আসতে বলছে কেন আপনি জিজ্ঞেস করেন নি? তাছাড়া বিরেন দার সাথে আপনার সম্পর্ক এমন কী যে আসতে বললো আর চলে আসলেন?
অনামিকা শরীরটা একটু দুলিয়ে বিপুলের চোখে তাকায় যেন প্রশান্তির দীর্ঘ কোনো সুখ আর আশ্রয় সে দিতে চায়। তারপর মেয়েটি বলে, বিরেন দার সাথে আমার সম্পর্ক হলো সময়ের।
বিপুল অন্তত এটুকু বুঝে সান্ত¡Íনা পেল যে, অনামিকা বিরেন দার আত্মীয় না, বিপুল মনে মনে ভাবছে গেস্ট? ধুর গেস্টের নমুনাও তো এমন না। তবে স্মার্ট কথা সম্পর্ক সময়ের। বিপুল একটা সিগারেট ধরিয়ে মনে মনে আওড়ায়, খেইল চলছে খেইল আর মেয়েটিকে বলে, আপনিতো দেখছি দর্শনের দিকপাল।
বিপুলের কথায় সে স্মিত হাসে। এই হাসিটা কেমন যেন। প্রেমিকা প্রেমিকা। আহ্লাদে ঠাঁসা বুনোট স্নিগ্ধতার।
সিএনজি নিয়ে বিরেন দা এসেই তাড়া দিলো, ওঠেন ওঠেন। আমি জানতে চাইলাম, আচ্ছা ধানমন্ডি কী?
আমরাসদর ঘাট যাবো। লঞ্চ ধরবো। চাঁদপুর যাবো।
ধানমন্ডি কেন? বিরেন দা বললো, চিনছেন এক চাঁদপুর।
রাত বারোটা পর্যন্ত লঞ্চ আছে, যাওয়া যাবে।
বিপুল ঘড়ির দিকে তাকালো। দেখলো সাড়ে তিনটা বাজে। সাড়ে চারটায় লঞ্চ আছে, সাড়ে পাঁচটা এবং লাস্ট বারোটার আগে বিরতিতে সাড়ে সাতটা। বিপুল এই ভেবে বিরেন দাকে বললো, কত রং নিয়া আসছেন আপনি চাঁদপুর থেকে যে, সব ঢাকায় মাখতে থাকেন।
বিপুল সিএনজিতে উঠলো। বিরেন দা উঠতে যাবে এমন সময় অনামিকা বললো, দাদা আপনার সাথে বসবো না। মেজাজ গরম করে ফেলছেন, আপনি শেষে বসেন। তার অর্থ হলো বিপুল মাঝখানে, মেয়েটি তার পাশে।
হলোও তাই। সিনজি চলছে বিপুলের ভদ্রতার অবয়বে। আর চোখে অন্যরকম একটি নিসর্গতা ফুটে ওঠে।
অনামিকা মেয়েটি বুঝতে পারে। মনে হয় মেয়েটিকে বিপুলের যথেষ্ট বুদ্ধিমান মনে হয়।
অনামিকা বিপুলের হাত ধরে অগোচরে। বিপুল নির্বাক চেয়ে রয় বাইরে।
অনামিকা বলে, দাদা অহেতুক ধানমন্ডি যাবেন।
লঞ্চে চলে যেতে পারতাম, শুধু শুধু দেরি করছেন।
বিরেন দা উত্তেজিত হয়ে বলে, আপনি কথা বেশি বলেন।
অনামিকা সেই কথার উত্তর দেয় না। শুধু মেয়েটি মাথা এলিয়ে দেয় বিপুলের কাঁধে। বিপুলের মনে হলো এই ব্যস্ত শহরে এক নিঃস্তব্ধতা তাকে পেয়ে বসেছে।
সিএনজি এসে থামলো লেকের সামনে। লেকে ঢোকার মুহূর্তে বিপুল বিরেন দার হাতটি ধরে একপাশে নিয়ে বললো, আচ্ছা এই মেয়েটি আমাকে কিভাবে চিনে?
বিরেন দা বললো, এতো কথা বললেন, জিজ্ঞেস করেননি?
কিভাবে চিনে?
বিপুল বলল, হুম জিজ্ঞেস করেছি।
বিরেন দা বললো, বলেছে?
বিপুল বললো, বলেছে?
কী বলেছে?
বিপুল বললো, সেতো ধীরে বহে মেঘনা।
বিরেন দা বললো, বুঝলাম না।
বিপুল বললো, বোঝার দরকার নাই।
বিরেন দা হতাশ ও বিরক্ত বিপুলের কথায়।
বেঞ্চে বসে তুমুল ঝগড়া বিরেন দা আর অনামিকার।
ঝগড়ার কারণ হলো, বিরেন দা চায় অনামিকা রাতে থাকবে। অনামিকার কথা হলো সে রাতে ঢাকায় থাকতে পারবে না। তুমুল হৈচৈ এই নিয়ে।
বিরেন দা ওঠে চলে যায়। যাওয়ার সময় বিপুলকে বলে, আপনি বোঝান তো ভাই। বিপুল চমকে ওঠে বলে, আমি?
বিপুল অনামিকাকে বলে, আপনি কোথায় থাকেন?
অনামিকা সহজ উত্তর দেয়, চাঁদপুর।
তাহলে সায়েদাবাদ কেন আসলেন?
কুমিল্লা থেকে বাসে এসেছি, কুমিল্লা কাজে গিয়েছিলাম।
দাদা বললো ঢাকায় আসতে, তাই আসছি।
আপনাকে বলেনি ঢাকায় থাকতে হবে?
না।
ঠিক আছে, চলে যেতে চাইলে চলে যাবেন।
আচ্ছা আমাকে কিভাবে চিনেন?
দাদার বাসায় যেতেন, সেখান থেকে।
দাদার ফ্ল্যাটে থাকেন? তবে?
উনার বাসার নিচ তলায় ডায়াগনস্টিক আছে, সেখানে কাজ করতাম।
এখন করেন না? না।
অনামিকা বললো, আচ্ছা আপনি কি আমাকে আসতে বলেছেন?
বিপুল বললো, না।
বিপুল বললো, দাদার সাথে আপনার কখনও সময় কাটানো হয়েছে?
অনামিকা বললো, না।
বিপুল বললো, এইসব নিয়ে তো দাদার সাথে কখনও কথা হয়নি। তাছাড়া দাদাকেও তো আমার এমন মনে হয়নি কখনও।
অনামিকা বললো, তা আমি জানি না।
তবে তিনি মিথ্যা বলছেন কেন?
আপনার কথা বলে আমাকে আসতে বলেছে।
আমার কথা বললে আপনি আসবেন কেন?
আপনাকে পছন্দ হয়েছে তাই।
বিপুল বললো, আপনার তো পছন্দ গুরুত্বপূর্ণ নয়, আপনার....। বিপুল থেমে গেলো, আর দেখলো অনামিকা মেয়েটি ম্লান হয়ে যেন ফুলের মতন মাটিতে ঝরে পড়লো।
অবিনীত কণ্ঠে অনামিকা বললো, দূরে এই প্রথম। হয়তো খারাপ জেনে গেছেন। তবে খুব টাকার প্রয়োজন হলে আমি....অনামিকা থেমে গেল।
বিপুল বললো, খেয়েছেন আপনি?
অনামিকা বললো, আসলে সময় পাইনি।
খিদে আছে?
অনামিকা বললো, আছে।
আর আপনার নামতো অনামিকা নয়, তাই না?
মেয়েটি নিরুত্তর।
খাওয়া শেষ করে কথা চূড়ান্ত হলো, সাড়ে সাতটার লঞ্চে চাঁদপুর যাবো, এখন ঠিক এক ঘন্টা পঁয়ত্রিশ মিনিট সময় আছে।
বিরেন দাকে বিপুল বললো, আপনি হঠাৎ এমন করতে গেলেন কেন? বিরেন দা খুব লজ্জিত হয়ে বললো, আসলে আপনি আমার বাসায় যখন মাঝে মাঝে আসতেন, সে আপনার কথা জিজ্ঞেস করতো, আজকে দুষ্টুমি করে আপনার কথা বলে ফেলেছি।
তবে ভাই মেয়েটা ততো খারাপ না।
বললাম, নাম কি মেয়েটার?
দাদা বললো, আমাকে তো অনামিকা বললো।
বিপুল বুঝলো অনামিকা দাদার ধরাছোঁয়ার বাইরে, দাদা ধরতে চায়। ধরুক।
বিপুল আপোষ মিমাংসা করে দিলো এইভাবে, কেবিনে বিরেন দা আর অনামিকা যাবে।
বিপুল একটা প্রথম শ্রেণিতে চলে যাবে।
সিএনজিতে উঠলো তিনজন। বিরেন দা আর অনামিকাকে একসাথে দিয়ে বিপুল অন্যপাশে বসলো। বিপুল ক্লান্ত। চোখটা একটু বুঁজলো। হঠাৎ অনামিকার ঝাঁঝালো কণ্ঠে বিপুলের চোখ খুললো। অনামিকা বললো, দাদা একদম স্পর্শ করবেন না। বিরেন দা লজ্জিত হয়ে চুপসে যায়।
বিপুল নিশ্চুপ উদাসীনভাবে গ্লাসে ড্রাইভারের দিকে তাকায়।
লঞ্চে উঠে বিপুল চলে যায় ফার্স্ট ক্লাসে।
বিরেন দা আর অনামিকা কেবিনে। বিপুল চোখ বন্ধ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বাইরে এসে দাঁড়ালো। সুন্দর চাঁদ দিগন্তে। চাঁদের আলোয় পৃথিবী সুন্দরতম আজ। জলের লহরে চাঁদের আলো শিশুর মতন হেসে ওঠে। হঠাৎ সেল ফোনটা বেজে ওঠে। বিপুল দেখলো বিরেন দার ফোন। আবার কী হলো কে জানে। বিপুল কল রিসিভ করলো। বিরেন দা বললো ওপাশ থেকে-‘ভাই একটু কেবিনের সামনে আসেন’। আমি গেলাম। গিয়ে যা শুনলাম তা হলো অনামিকা বিরেন দা কে কেবিনে ঢুকতে দিচ্ছে না। যদি বিরেন দা ঢুকে অনামিকা সিন ক্রিয়েট করবে।
দাদা তেলে বেগুনে আগুন। আমাকে বলে, ভাই আপনাকে যেতে বলেছে যান। আর ধরেন আমার কাছে পাঁচ হাজার চাইছে।
দিমু সমস্যা কী?
অনামিকা বললো, আপনি একটু শুনবেন?
বিপুলের সত্যি কোনো ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও বিপুল কেবিনে ঢুকলো। কারণ লৌকিক লজ্জা বিপুলের চরিত্রের অন্যতম আদর্শ দিক।
বিপুল অনামিকাকে বললো, আপনার প্রবলেম কী?
আপনারা কি প্রেমিক-প্রেমিকা শুধু ঝগড়া করছেন?
অনামিকা বললো, ধুর বাদ দিন।
বসুন আপনার সাথে। একটু গল্প করি।
বিপুল বললো, আমার সাথে গল্প করলে তো টাকা আসবে না।
অনামিকা বললো, টাকা নিয়ে ভাবছি না।
দাদার টাকা দিতে হবে। আর টাকা নিয়ে তিনি ঝামেলা করবে না। বিপুল বললো টাকা দিবে বিরেন দা, গল্প করবেন আমার সাথে, কাজটা কি ঠিক?
অনামিকা বললো, দাদাও ঠিক করেনি।
মিথ্যা বলেছে। বলেছে আপনার কথা।
বললাম, তো হয়েছে কি?
আপনার আকর্ষণ ক্ষমতা, ব্যক্তিত্ব, পোশাক, কথা বলার অপূর্ব সম্মোহন, আপনার ভদ্রতায় অহংকার এসে ছায়া ফেলে, নিমীলিত হয়ে আছি। একটু ভালোবাসা চাই।
বিপুল বলল, আপনি অসাধারণভাবে কথা বলতে পারেন।
অনামিকা হেসে বললো, বই পড়ার অভ্যেস ছিলো একসময় হয়তো সে কারণে।
অনামিকা বিপুলের হাতটি ধরে। বিপুল বললো, ঠিক নয় আমার বিবেক আছে। বিরেন দা বাইরে আছে, আমি পাঠিয়ে দেই এই বলে বিপুল বাইরে চলে আসে। দেখে বিরেন দা খুব মন খারাপ হয়ে দাঁড়িয়ে। আমাকে দেখে বললো, কী বলে ভাই? আমি বললাম, বিরেন দা দেখুন ওর থেকে ভালো ব্যবহার আশা করার কী প্রয়োজন। যান ভিতরে যান। বিরেন দা ভিতরে গেল। কেবিনটা লঞ্চের ছাদের একপাশে। বিপুল ছাদের অন্যপাশে দাঁড়িয়ে আছে।
কিছুক্ষণ পর বিরেন দা আবার এলো বললো, ভাই আমার সাথে খুব বাজে ব্যবহার করছে। টাকা দিয়ে আসছি পাঁচ হাজার। আপনাকে ডাকছে।
এতোগুলো টাকার কথা শুনে বিপুল কিছুটা রেগে গিয়ে কেবিনে ঢুকে বললো, আপনি বিরেন দার সাথে এতো খারাপ ব্যবহার করছেন কেন?
অনামিকা বিপুলের চোখে স্থির চেয়ে বললো, দুটি কারণ। এক. আপনাকেই চাই অন্য কাউকে মানতে পারছি না। দুই. আমি মুসলমান। আমার ছেলেকে মাদ্রাসায় পড়াই। আমি নামাজ পড়ি। আমি কোনো হিন্দু ছেলের সাথে সময় কাটাতে পারবো না। আপনার কাছে এটা খুব হাস্যকর। হয়তো হাস্যকর। কিন্তু আমি মনে করি, রুচির ব্যক্তি স্বাধীনতা আমার আছে।
বিপুল বললো, একদিক দিয়ে পাপ করবেন? অন্য দিকে ছেলেকে মাদ্রাসায় পড়িয়ে সওয়াব হাসিল করবেন। ভালোইতো, পাপ-পুণ্যে কাটাকাটি।
অনামিকা হেসে বললো, পাপ যদি বলেন তাহলে এটাও বলেন সমাজের যে নোংরা আবর্জনার স্তূপের ভেতর এই পাপের জন্ম হয়, সেখানে আপনার মতো ভদ্র মানুষের কি কোনো দায় নেই?
অনামিকা খুব দৃঢ়ভাবে বলে, আমাদের এই পাপ এই ভদ্র সমাজেরও নিতে হবে।
বিপুল কেবিন থেকে বের হয়ে আসে। কেবিনের সামনের রেলিংয়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়ায়।
বিরেন দা হয়তো ছাদে আছে। থাকুক।
বিপুল তাকায় মেঘনা নদীর জলে। দেখে উন্মাদনাহীন মেঘনা নদী। বয়ে যায় ধীরে ধীরে।