প্রকাশ : ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০
অমরতা
যাবার আগেই যেতে দিতে চাও
এ কেমন কথা, পতনের মতো অহঙ্কার?
সব নিঃশেষ হয়ে গেলে কেবল কবি থাকেন
পৃথিবী ফুরিয়ে গেলে পড়ে থাকে শব্দের শহর
অজস্র কবিতা প্রেমিকা হয়, ওড়ে যায় নগর নিয়মে
তবু যাবার আগেই যেতে দিতে চাও-এ কেমন কথা!
ঘুমের গভীরে বেঁচে থাকে কাঁটা-রং-গাঙচিল
উজ্জ্বল পায়ে পথ হেঁটে যায় প্রাচীন সাধু, গেরুয়া বাউল
সুর থেকে ছড়ায় সুধা, সুধা থেকে ধ্বনি, মর্ত্যরে কোলাহল
তবু সবশেষে থাকে না বনলতা সেন, না থাকে অন্ধকার-না তপ্ত রোদ
পড়ে থাকে ধুলোপড়া-বইঘর, কবির মুখ, পৃথিবীর সব পংক্তিমালা-
তবু যাবার আগেই যেতে দিতে চাও, এ কেমন কথা!
.
দেহভিটা
কথকের দাঁতে তোমার হাসিগুলো গেঁথে আছে স্থির
যত্নবান উইপোকাও শুনেনি সেইসব রাতের শীৎকার
যারা নুয়ে পড়েন অজস্র চেরীফুলের স্বপ্ন নিয়ে
অথবা রোদ হতে চাইতেন যেসব প্রেমিকযুগল
তাদের মৃত্যুতে জ্যোৎস্নারা আসেনি; কেবল
শীতল উন্মাদের মতো বৃষ্টির ট্রেনে
ভেসে এলো মুমূর্ষু গ্রাম, আততায়ীর রক্ত!
তখনো আলোর ফুৎকারে রাত হয়নি
দেহভিটায় আঁতকে উঠেনি হাবিয়ার কষ্টেরা...
তখনো আকাশ চিরে মাঝিরা জাগেনি
কেবল তুমিই প্রথম জেনেছিলে-
দিনেরা বেঁচে নেই। খুন হয়েছে নিঃশ্বাসগুলি...
হাহাকার, চারদিকে
পাখিরা সব উড়ে গেছে দূরে গ্রাম ছেড়ে
আকাশের নীল ঘুড়ি ন্যাংটো ঘুরছে শো শো, বাতাসে
আধুনিক বালকের দু’হাত ভরা রক্ত, প্রাণহারা শৈশবে
ওড়ছে মাছি ভনভন, ঘুম ভেঙে যায় সাইরেনে-
চোখ পেতে দেখি অজস্র কাক, লাশের মিছিলে
বেঘোর ঘুমোচ্ছে পুতুলখেলা, ভালোবাসার দিন-
তখনো ঝুমঝুম নূপুর বাজে পতিতার পায়ে, সাজে কথারা
গায়ে নিয়ে বিভ্রম শাড়ি- পার্লার দেখে বাড়ি ফিরে গেছে
যাবতীয় কোমল মুখ আর নাটোরের বনলতা সেন।
ফিরে আসি ইটের নগরে, ফিরে যাই গ্রামে
দেখি, পাখিরা সব উড়ে গেছে গ্রাম ছেড়ে দূরে, বহুদূরে...
.
মধ্যরাত্রির মাতাল
রাতকে বলো গোলাপ হবো-
স্কুল পেরিয়ে ছুটন্ত ঘুড়ির পেছন পেছন
তুমিও ওড়ে যেও পালক হয়ে
যদি না পাও কাঁটা কিংবা নিঃশ্বাসের চিবুক
তবে মিশে যেও মেঘে মেঘে, কোমল সুরায়-
আমি মধ্যরাত্রির উন্মাদ, মাতালের চোখ
বৃক্ষের পথে গোলাপ হতে শিখি নি কখনো...
.
রোদের গল্প
রোদ যতটুকু পালিয়ে যেতে চায় বনে
মেঘ তাকে ঘিরে রাখে ততোটুকু মায়ায়
আমাদের রোদ ও মেঘ কিছুই নেই
মাথার উপরে যে আকাশ দ্বিধাগ্রস্ত দাঁড়িয়ে
আমরা হাত বাড়িয়েও তাকে ছুঁতে পারি না।
আমরা অমলকান্তির মতো রোদ হতে প্রার্থনা করি
প্রেমের চৌচির মাঠে দাঁড়িয়ে মেঘ হতে আরতি করি
আমরা প্রার্থনা করি নূহের মতো দিগন্তব্যাপী প্রলয়ে
জীবন থেকে কিনেছি জীবন, কিনেছি তীব্র দাহ-সন্তাপ
যতটুকু পালিয়ে যাই সবুজ বৃক্ষের দিকে, রৌদ্র ছুঁতে-
ততটুকু পোড়ে শরীর ততটুকু উত্তাপে।
.
স্রষ্টার তীর মেখে গায়ে
যদিও মুছে যাবে সূর্য রঙিন, উড়ে যাবে কথার বিষাক্তবাণ
আর পাখির ঠোঁটে জমা জীবন থেকে অনেক দূরে
নিবিড় কোনো বৃক্ষচূড়ায় ছড়িয়ে যাবে হাসি, উদাসে...
পৃথিবী তখন বারফিধোয়া ঘুমে, ক্ষয়ে ক্ষয়ে উঠোন রোদে
মুখ হারিয়ে কোলাহলে আমি কবন্ধমানব, বখে যাওয়া বেদুইন...
তখনো নদীর জলে উবু হবে নিথর দেহ, তলায় অজ্ঞাত করোটিস্তূপ
আর মায়ের মুখে প্রতীক্ষা এঁটে পালিয়ে যাবে সহস্ররাত
আমি তখনো কোনো স্বপ্নের দিকে ছুটে যাবো অবিরাম মেঘের মতো
তীব্র তীরের মতো ছুটে যাবো জীবনের দিকে, বারবার-
আকাশ থেকে যতোই নামুক স্রষ্টার তীর, অমোঘ নিয়তি...
.
হরিৎ বর্ণমালা
কথারা বুনে গেছে স্বপ্নের মুখ, সোনালী ধান
আর ‘মা’ ডাকের লোভে প্লে-কাড হাতে আমার পূর্বপুরুষ-
পকেটে রেখেছে হরিৎ জীবন, অনাগত সব বসন্ত।
অক্ষরের সাথে অক্ষর মিলে হয় জীবন
শব্দের সাথে শব্দ জুড়ে ওড়ে শাড়ি, গাঁয়ের বধু-
পাতায় পাতায় জড়িয়ে থাকে বাংলা বর্ণমালা
আর আমার পূর্বপুরুষ বুকে রেখে তাজা বুলেট, মলিন হেসেছে,
মুখে তাঁর ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ শ্লোগান।
রক্তে রক্তে লাল হয়ে হয় খর¯্রােতা নদী
আমি বাঙালি, এমন সহস্র নদী দেহে আমার
পরানে হরিৎ বর্ণমালা।
.
নিজেকে ভুলে যাই
আজকাল গল্প ভুলে গেছি
একটা বিষণ্ন দুপুরের রঙভরা গল্প
ধোয়া উড়া চায়ের গল্প
ভুলে গেছি পথ হারানো রাতের প্রহর, পদাবলি।
সাঁতার শিখেছি শৈশবে, মনে নেই কৌশল কোমল
ভুলে গেছি প্রেমিকার চোখ
নরোম জ্যোৎস্নার অবিরাম প্রহার
মুছে গেছে উদ্দাম ঘুড়ির লেজ, ধুলোয় ধুলোয় বিক্ষত বিকেল।
আজকাল নিজের নাম হারিয়ে যায়
স্মৃতি থেকে মুছে যায় অশ্রু, মালা, সংসার
এপথ ওপথ হন্যে হয়ে ঘুরিফিরি
পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা উড়ে, উড়ে যায়
লাল চোখ কালো ভ্রু রক্তিম মুখগুলো...
আজকাল ভুলে যাই নিজেকে নিজেই
ডাস্টারে মুছে রাখি জীবন
মুছে থাকি চিরপুরাতন এই আমি...
.
বিসর্জন
বহুদিন ভেতর থেকে ক্লান্ত হয়ে
দরোজায় দাঁড়িয়েছি একা
অদৃশ্য ছুরির ফলায় কেটেছি শরীর
আহা জংপড়া মন, প্রাচীন জংশন
কত দূরে গেলে পাবো নক্ষত্র, আকাশ?
জানি, ভীষণ অভিমানে নিভে গেছে কেউ
ফিরে গেছে পথিক সঙ্গহীন, নির্লোভ
স্মৃতির জলপত্রে কে তারে ফেরায়?
ভাঙা মঞ্চে আষাঢ়ের জোয়ার এলে
ফিরে যাবো বনভূম, নিশ্চিন্তে
এবার দাঁড়াও মেয়ে, অখণ্ড নির্জনতায়।
.
কদম ফুল
সূর্য ভেসে গেলো মেঘে।
তুমি প্রতিরাত জলপরী
সম্মোহন ঘুমে
রেখে যাও মুখ নদীর কিনারে
সাগর মুছে যায় সৈকতে।
আমি বিবরবাসী, না দেখি আলো
না জল, না কিনার
গাঁথি প্রেম অস্ত্রের কোলাহলে
বানভাসী জীবন, অপার—
তবু দেখা হোক আমাদের
জলে কিংবা রণাঙ্গনে
গুলির পাশে না হয় ফুটুক দুটি কদম ফুল।
.
মাছ
ইদার্নিং যাকে আমার খুব মনে পড়ে
সাদাসিদে লোকটি, সরল তাঁর চোখ ও চাহনি
তিনি আমার বাবা হন।
তার কথায় কী যেন এক মায়া আছে
আমি ধরতে পারি না, ধরি না।
এমন কোমল সুরের অর্থ আমার জানা নেই।
তিনি পুকুরে মাছ ধরতেন
ছিপ ফেলে বসে থাকতেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা
বড় মাছেরা কেউই তাঁর কাছে আসতো না
কেবল ছোট মাছেরা ছিলো অপেক্ষাকৃত দয়ালু
তাই আমার বাবা কেবল পুঁটি মাছই পেতেন...
আমি জানি আমাদের পুকুরের ছোটছোট মাছেরা
এখনো ঘুরে বেড়ায় পাড়ে পাড়ে, জলে জলে...
কখন ছিপ ফেলবেন বাবা?
বোকা মাছ! এতবছর গেলো তাও বুঝলে না কিছু
সেই সাদাসিদে লোকটি আর নেই
যাঁর চোখ ছিলো সহজ ও সরল...