বুধবার, ২৭ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২০ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জে সংবাদকর্মীর কন্যাকে অপহরণ চেষ্টায় অভিযুক্তদের অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবি ফরিদগঞ্জ প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন সংগঠনের
  •   লক্ষ্মীপুরে মাদকসহ বাবা ও দুই ছেলে আটক
  •   চাঁদপুর সদর মডেল থানা পুলিশের অভিযানে বিভিন্ন মামলার ৮ আসামী আটক
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার

প্রকাশ : ৩০ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

বগা
অনলাইন ডেস্ক

মাঘের মাঝামাঝি। এই সময়ে এসে শীত ঝেঁকে বসেছে। প্রচণ্ড এই শীতের ভোরে খড়ের বিছানা আর ছেঁড়া কাঁথা-কম্বলের ওম ছেড়ে আমাকে দৌড়াতে হচ্ছে শুকনো খালের দিকে। বিষকটালি লতায় ভরপুর খালের কোনো একটা সুবিধা মতো স্থানে আমাকে বসে থাকতে হবে অনেকক্ষণ। পরিষ্কার না হলে আবারও হবে হবে এমন একটা ভাব থাকে। সেটা ভালো না।

কিন্তু আজ প্রকৃতির ডাকে আয়েশ করে সাড়া দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। একটি কুকুরছানা অনবরত ডেকে যাচ্ছিল। এমন করে ডাকছিল যেন মরে যাচ্ছে। আমার অস্থির লাগছিল। মাটির ঢেলা দিয়ে দুইটা মুছা দিয়ে আমি কুকুরছানাটিকে খুঁজতে লাগলাম। দেখি ইঁদুরের গর্তের মাটি সরিয়ে ও কোনো রকমে আশ্রয় নিয়ে আছে। ওর অবস্থা খুবই খারাপ। মুমূর্ষু। আমার গায়ের চাদর দিয়ে ওকে আমি আমার শরীরের সঙ্গে জড়িয়ে নিলাম। দেখি মুহূর্তে ওর কান্নাকাটি শেষ। চরম এই দুরবস্থায়ও ও আমার শরীরের গন্ধ নিচ্ছে। আমার পেটে, বগলে গুঁতো দিচ্ছে। ও আমাকে বুঝে নিচ্ছে বুঝি।

মা ঘুম থেকে উঠে দেখছেন কী একটা বগলে নিয়ে আমি রান্না ঘরে ঢুকছি। কোনো কথা না বলে মা রান্নাঘরে ঢোকেন।

কী রে, তোর আতো এইডা কী?

আমি বললাম, কুত্তার ছাও।

মা বিরক্ত। তবে যতটা আক্রমণাত্মক হয়ে মা রসুইঘরে ঢুকছিলেন, এখন আর তা নেই। মা ভাবছিলেন, এই ভোরবেলা কোথাও থেকে কিছু চুরিদারি করে রসুইঘরে লুকাচ্ছি নিশ্চয়ই। কিন্তু এখন দেখলেন, নাহ্, চুরি করি নাই। এতেই নিশ্চিত হয়ে মা ঝোপঝাড় থেকে কুকুরছানা ধরে আনার অপরাধ কিছুটা মাপ করে দিয়েছেন।

তোর বাপেরগোত্তে কুত্তার ছাও দেহস নাই। এই মরাডা কোনহান থেকে আনলি?

আমি বুঝতে পারি মা কিছুটা সদয় হয়েছেন। বললাম,

মা, খালের তলে আছিল। কান্দে আর কান্দে। মনে অয় মইরা যাইতাছে। এলিগা লইয়া আইলাম।

হইরা খাড়া। পাহাত আগুন ধরাইয়া দেই। কুত্তার ছাওডারে লইয়া আগুনের কাছে বয়।

আমি পরিষ্কার বুঝতে পারলাম, সমস্যা শেষ। মায়ের পক্ষ থেকে তেমন কোনো অসুবিধা আর হবে না। এখন বাবাকে সামলানো খুবই কঠিন। কিন্তু এখনই এই সব ভাববার সময় নয়। এখন দরকার কুকুরছানাটিকে উষ্ণ করা আর কিছু খাওয়ানো।

শুকনো কাঠের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে না, কিন্তু বেশ তাপ। কিছুক্ষণের মধ্যে আমি এবং আমার এই নতুন সঙ্গী উষ্ণ হয়ে উঠলাম। এর মধ্যেই শীতের কুয়াশা ভেদ করে ডিমের কুসুমের মতো লোভনীয় হয়ে সূর্য মামা দেখা দিয়েছেন পুবের আকাশে।

আমার দলবলও ঘুম থেকে ওঠে গেছে। কেউ শীতের পিঠা নিয়ে, কেউ মুড়িমুড়কি নিয়ে এবং কেউবা পান্তাভাত আর মরিচপেঁয়াজের ভর্তা নিয়ে দক্ষিণের পুকুর পাড়ে গিয়ে বসবে। তরুণ সূর্যের আলো ওখানে পুরোপুরি পাওয়া যায়। সেই স্নিগ্ধ আলো ও মিষ্টি উষ্ণতার মধ্যে চলবে শিশু উপনিবেশের এই সম্মেলন। যতক্ষণ পর্যন্ত তাপ বিশ্রীরকম অসহ্য না হয়ে উঠবে ততক্ষণ পর্যন্ত চলবে এই মেলা।

কিন্তু আজ বিষয়টি অন্যরকম হবে। দক্ষিণের পুকুরপাড়ে আজ আমার সঙ্গে থাকবে একটি কুকুরছানা। এর চেয়ে আনন্দের, আলাপের, তর্কের, বিতর্কের এবং এমনকি ঝগড়ার আর কী হতে পারে? সুতরাং আজকে জমবে ভালো।

এর মধ্যেই মা মাটির ভাঙ্গা সানকিতে করে ওর জন্যে কিছু খাবার দিয়ে গেলেন। গোস্ত, হাড় আরও কী কী খেতে পছন্দ করে কুকুর। কিন্তু ওইসব খাবার ঘরে নেই। ওকে খেতে হলো ভাত আর কয়েক টুকরো রুটি। ক্ষুধার্ত কুকুরছানাটি ওই খাবারই খেয়ে নিল। একটি পুরানো গামছা দিয়ে প্যাঁচিয়ে ওকে নিয়ে গেলাম দক্ষিণের পুকুর পাড়ে। ততক্ষণে এখানে শুরু হয়েছে শিশুদের সাম্রাজ্য।

গামছার আড়াল থেকে যখন ওকে বের করলাম তখন সবাই এসে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। আর অসংখ্য প্রশ্ন।

কুত্তার ছাওডা কই আছিল?

কী করছিল?

তুই ওরে পাইলি কেমনে?

ওর মা কই?

মনে হলো ওরা প্রশ্ন করতে চায়। উত্তর জরুরি না।

শেষে পারুল বলল, ওর নাম কী?

তাই তো, ওর তো কোনো নাম নাই। একটা নাম থাকা দরকার।

আমি বললাম, এইডারে একটা নাম দে।

শুরু হয়ে গেল নাম নিয়ে গবেষণা।

গ্রামে তো সব কিছুরই একটা নাম থাকে। গাছের নাম থাকে, গোরু-ছাগলের নাম থাকে, পুকুর খাল বিল- এগুলোরও নাম থাকে। আমাদের বাড়িতে অনেকগুলো হাঁস-মুরগি আছে। ওদেরও নাম আছে। আমাদের ঝুটিওয়ালা একটি মোরগের নাম ছিল রাজা। আর কুকুরের নাম থাকবে না-এইটা কি হয়!

মুশকিল হলো কুকুরের নাম কেমন হবে। নিশ্চয়ই মানুষের নামের মতো হবে না।

তিনু বলল, ওর নাম কালু।

বিল্লাল বলল, কলিমুল্যা কাকুর ডাকনাম কালু। কাকু যদি হোনে, তোরে দিব অনে ছেচা।

এখানকার সবচেয়ে দুষ্টু ছেলে রবি। খারাপ কথা না বললে ওর পেটের ভাত হজম হয় না।

নাম পাছ না? নাম পাছ না? ভালা নাম কই। রাখবি তো? কুত্তাডার নাম অইল গু।

এর মধ্যেই কুকুরছানাটি সবার সঙ্গে চোখাচোখি সেরেছে। সবার সঙ্গে ওর খাতির হয়ে গিয়েছে। তাই গু নাম শুনে সবাই খ্যাপে গেল।

বিপদ টের পেয়ে রবি দূরে গিয়ে মাজা দুলাতে লাগল এবং আমাদের সবাইকে ব্যঙ্গাতে শুরু করল। কিন্তু ও ভাবতেই পারেনি যে আমরা সবাই একসঙ্গে ওর দিকে ঢিল ছুড়ব। উপায়ন্তর না দেখে রবি চম্পট দিল।

অনেক তর্কবিতর্ক, অনেক যুক্তি অযুক্তি আর ঝগড়াবিবাদ শেষে কুকুর ছানাটির নাম রাখা হলো বগা। অধিকাংশের কণ্ঠভোটে পাস হওয়ার পর যখন এই নাম রাখা হলো তখন প্যাঁচ লাগানোর চেষ্টা করে থ্রিতে পড়ুয়া আম্বিয়া। বলে, অ টুলু, তোর কুত্তার নাম বগা রাখবি ক্যামনে? বগা তো বকের নাম।

আমি খুবই বিরক্ত।

বললাম, বকের নাম তো বক, বগা অইব কিলিগা?

আম্বিয়া নাছোড়বান্দা।

বলে, একটা গান আছে না, ফান্দে পড়িয়া বগায় কান্দিল রে। ওইখানে বকের নাম বগা।

সুরুজ আরও বিরক্ত হয়ে বলল, আজব! গানের মধ্যে বকের নাম বগা না ঠগা ওইডা দিয় আমাগ কী কাম? কুত্তাডার নাম বগাই থাকব।

সুরুজ আমাকে পরিষ্কার জানিয়ে দিল,

টুলু তোর কুত্তার নাম বগা, ঠিক?

আমি বললাম, আচ্ছা।

আমার ছোট কাকার নাম বটু কাকু। সব সময় আমাদের প্যাঁচে ফেলে মজা নেয়। সূর্যের তাপ তখন প্রখর হয়েছে, আমরা অধিবেশন সাঙ্গ করে চলে যাচ্ছি । এমন সময় বটু কাকুর সামনে পড়ে গেলাম। কাকু আমাকে ডেকে বলে, টুলু, তুই তো বিনা পয়সায় একটা কুত্তা পাইলি। আমারে কী খাওয়াবি?

আমি খুবই অবাক হয়ে কাকুকে জিজ্ঞাসা করলাম, আচ্ছা কাকু, তোমার কি মাথা ঠিক আছে? কোনো দিন হুনছ মাইনসে কুত্তা কিনে?

আরে কস্ কী! কুত্তার তো মেলা দাম। কত জাতের যে কুত্তা আছে তার হিসাব নাই, ঝুঝলি? জাত বুইঝা কুত্তার দাম। দশ হাজার টাকা দামের কুত্তাও আছে।

আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, তোমার এই সব বক্কু কতা। আমাগ গ্রামে কত কুত্তা আছে। বল, এগুলো কে কারথিকা কিনছে?

কাকু হাসে। বলে,

আরে, এগুলি তো ফহিন্নি মার্কা কুত্তা। পথে অয়, পথে থাহে। এগুলির আবার দাম কী!

কাকুর কথা শুনে আমার খুব মন খারাপ হয়ে যায়।

বলি, কাকু, তুমি এইভাবে কতা কইয়ো না। আমার কইলাম ভালো লাগে না। বুঝছ?

কাকু আমার কষ্ট বুঝতে পারে। তারও মন খারাপ হয়।

বলে, আরে না না। তোরটার কতা কই নাই। তোর কুত্তাডা তো খুব ডহের। ওই যে পথে পথে ঘুরে, ন্যাড়ি কুত্তা, ওইগুলির কতা কইলাম। বুঝছস্?

এখন আমার সর্বক্ষণের সঙ্গী বগা। ভাই-বন্ধুরা তো জেনে গেছেই যে ও আমার পোষা কুকুর। পরিবারের সবাই ওকে মেনে নিয়েছে। এমনকি বাবাও কিছু আর বলেন না। শুধু একবার বলে দিয়েছে,

কুত্তা পাইল্লা যদি পড়ার ক্ষতি অয়, মনে রাখিস্, একদম মাইরা হালামু। মনে থায়ে যেন।

বাবার জারিজুরি ওই পর্যন্তই। কিন্তু তবুও বাবাকেই ভয় পাই।

কুকুরছানাটা আমার অনেক প্রিয় হয়ে ওঠে। এরও আগে আমার দিনগুলো আনন্দেই কাটছিল। কিন্তু কুকুরছানাটি পাওয়ার পর এখন মনে হয়, এ অন্য রকম আনন্দ। এর কোনো তুলনা চলে না। তাই পড়াশোনা অনেক বাড়িয়ে দিলাম।

পড়াশোনার প্রতি এখন খুব মনোযোগ হয়েছে, তা কিন্তু মোটেই নয়। বরং কুকুরছানাটি পেলে পড়াশোনা করছি না-এই দোষে যেন ওকে হারাতে না হয় তার জন্যই পড়াশোনা বাড়িয়ে দিয়েছি।

রান্নাঘরের সাথেই ঢেঁকিঘর। ওখানেই বগা ঘুমায়, অবসর সময় কাটায়। আর প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার জায়গা ওর আর আমার একই-বাড়ি থেকে দূরে, উত্তরের খালে। ওখানেই আমি বগাকে পেয়েছিলাম।

বগাকে আমি বুঝিয়ে দিয়েছি, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে। টয়লেট সেরে সোজা নেমে যেতে হবে পুকুরের জলে। কিছুক্ষণ সাঁতার কেটে উঠে আসতে হবে। যেখানে সেখানে হিসু করা যাবে না, মুখ দেওয়া যাবে না, শোয়া যাবে না। ও খুব ভালোভাবে এইসব রপ্ত করেছে।

আমি অনেক বড় হয়ে গেলাম। ক্লাস থ্রিতে উঠে গেছি। বন্ধুদের সঙ্গে মারামারি করছি। হৈহৈ রৈরৈ করছি। বগাও অনেক বড় হয়ে গেছে। কিন্তু মুশকিল হলো ওইসব বন্ধুদের মারামারিতে বগা নাক গলাতে শুরু করেছে।

এর মধ্যে অনেকের সামনে কামড় দিয়ে অন্তুর লুঙ্গি খুলে ফেলেছে।

ঘেউঘেউ করে সুমনকে তাড়া দিয়েছে।

এখন আর আমার গায়ে হাত তোলার সাহস কারো নেই। বরং আমার পক্ষ হয়ে বগা বন্ধুদের শাসিয়ে আসে। এতে আমার অসুবিধা হতে শুরু করল। বগাকে আমি কিছুতেই বোঝাতে পারছি না যে, ওরা আমার বন্ধু। ওদের সঙ্গে এই ঝগড়া করব এই খেলব। এসবের মধ্যে তোর নাক গলানো দরকার নেই। কিন্তু ও কিছুতেই মানছে না। ওর এই আক্রমণে আমার কিছুমাত্র ভূমিকা নেই, হলফ করে তা বলতে পারব না। কেননা, কখনো কখনো আমিই ওকে উস্কানি দিই ও যাতে আক্রমণ করে।

এর মধ্যে শান্ত আমাকে হুমকি দিয়ে গেছে, দেহিস, তোর কুত্তার ঠ্যাঙ ভাইঙা আতে ধরায় দিমু।

বল্টু ভয়াবহ কথা বলে গেছে। ইহ্! কুত্তা লইয়া মস্তানি! গরম পানি ডাইল্যা দিলে বুঝবি নে, কুত্তার ছড়বালকা কই থায়ে।

এই সব হুমকি যে শুধু আমাকেই দেওয়া হচ্ছে তা নয়, বাবা-মা-র কাছেও কেউ কেউ নালিশ করে গেছে।

আমি খুবই ভয় পাচ্ছি। বগার কোনো ক্ষতি হলে আমার অনেক কষ্ট হবে।

লম্বা একটি টিনের ঘরে আমার স্কুল। চার দিকে মুলির বেড়া। বেড়ার মাঝে মাঝে মুলি সরে গিয়ে খুপড়ির মতো হয়েছে। এইসব ফাঁকফোকর দিয়ে ছাগল, ছাগলছানা, বাছুর, কুকুর সহসাই ক্লাসে ঢুকে পড়ে। বগা প্রতিদিন আমার সঙ্গে স্কুলে যায়। কখনো কখনো ওই ফাঁক গলিয়ে ও আমার পায়ের কাছে চুপচাপ বসে থাকে। আমাদের স্যারদের নাম হেড স্যার, সেকেন্ড স্যার আর থার্ড স্যার। হেড স্যার কোনো সমস্যা না, থার্ড স্যারও না। ওনারা বগাকে খুব পছন্দ করেন। আমার পড়াশোনার খবর না নিয়ে জিজ্ঞাসা করেন, এই টুলু, তোর বগার খবর কী? আমি খুবই লজ্জিত হয়ে বলি, ভালা স্যার। আমার অনেক ভালো লাগে। স্যারদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা অনেক বেড়ে যায়।

কিন্তু সেকেন্ড স্যার বগাকে একদম সহ্য করতে পারেন না। ক্লাসে গিয়ে প্রথমেই তিনি দেখবেন, লো ব্যাঞ্চের নিচে আমার পায়ের কাছে বগা বসে আছে কি না। যদি দেখেন বগা আছে তা হলেই ওনার মেজাজ টন করে ওঠে। চিৎকার করে বলেন,

এই টুলু, নচ্ছার ছেলে কোথাকার, তুই পড়তে আইছস ভালা কথা, তোর কুত্তাডা আইছে কিলিগা? ভাগা। এহ্, কুত্তারেও জজ ব্যারিস্টার বানাইবে।

স্যারের বিদ্রূপ শুনে আমার বন্ধুরা খুব মজা পায়। ওরা এক সঙ্গে খিলখিল করে হাসতে থাকে।

অন্য সময় হলে স্যার বেশিক্ষণ হাসতে দেয় না।

বলেন, থাম থাম, এতক্ষণ হাসার কী অইল।

এখন আর তা বলেন না। ওরা ইচ্ছা মতো হেসে নেয়, আর আমার লজ্জা বাড়তে থাকে। অপরাধীর মতো আমি চুপচাপ বসে থাকি।

ঘটনা ওখানে শেষ হয়নি। সেকেন্ড স্যার বাবাকে বলেছেন, আমি কুকুর নিয়ে স্কুলে যাই, সারাক্ষণ মেতে থাকি কুকুর নিয়ে, আমি গোল্লায় যাচ্ছি ইত্যাদি।

বাবা কিছুতেই বুঝতে পারেন না। ছেলেডা তো পড়াশোনা করে ভালই, মাস্টর এইডা কী কইল?

বাজার থেকে ফিরে এসে বাবা আমাকে খুঁজে বের করলেন। বুঝলাম, মেজাজ সুবিধার নয়।

তুই বগারে লইয়া স্কুলে যাচ্?

মাঝেমধ্যে ও আমার লগে যায় গা।

তোর লগে ওরে আর নিবি না। ঠিক আছে?

আমি বাধ্যগত ছাত্রের মতো বলি, আচ্ছা। বগারে কমু অনে।

অনেক বুঝিয়েসুজিয়ে বগাকে ম্যানেজ করা গেল। ও আর স্কুলে যাবে না।

কয়েকদিন পরে আখ ভাগাভাগি নয়ে মুড়ার বাড়ির জগুর সঙ্গে আমার মারামারি শুরু হয়ে গেল। আখ ভেঙে জগু আমাকে একটা বারি দিলে আমি ওরে দিই দুইটা। কিন্তু কিছুতেই পেরে উঠছি না আমি। বগা কোথায় থেকে এই দৃশ্য দেখে বাঘের মতো দ্রুত ছুটে আসে এবং জগুকে কামড়িয়ে টেনেহিঁচড়ে পুকুরের পানিতে নামিয়ে ফেলে। এই ঘটনার পর জগু জ্বরে আক্রান্ত হয়। জগুর বড় ভাই আমাদের বাড়িতে এসে অনেক হৈচৈ করে যায়, অনেক গালাগাল দিয়ে যায়। 'জগু যদি মইরা যায়' তা হলে কিসের যেন চৌদ্দ সিকের ভাত খাওয়ানোর দাওয়াত দিয়ে যায়। পরে মাকে আমি চৌদ্দ সিকের ভাতের কথা বলেছিলাম । মাও বুঝি ধন্দে পড়ে গিয়েছিল। চৌদ্দ সিকের ভাত রান্ধে কমনে?

এই ঘটনার সপ্তাহ খানেক পর আমি স্কুল থেকে ফিরে দেখি বগাকে আর চেনা যায় না। ওর সমস্ত শরীর ঝলসে গেছে। মা ওর সারা গায়ে কলাগাছের রস মাখিয়ে দিচ্ছেন। মাকে সরিয়ে দিয়ে বগাকে আমি আমার বুকে জড়িয়ে নিলাম।

তারপর কতগুলো বছর চলে গেছে। বগা এখনো আমার বুকের মধ্যেই আছে।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়