প্রকাশ : ০২ আগস্ট ২০২১, ০০:০০
সদ্য স্বাধীন দেশে সত্যিকারের খাঁটি বিপ্লবী দলের অনুপস্থিতি আন্তর্জাতিক সাম্যবাদী আন্দোলনের নেতৃত্বকে ভাবিয়ে তুললো। বিপ্লবীদের দাবির মুখে কমরেড সলিল চৌধুরীকে পাঠানো হলো দল গড়ে তুলতে।
স্বাধীনতা যুদ্ধে জয়ী হওয়া তরুণদের একটি বড় অংশ মুক্তির সংগ্রামের জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলো।
বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে গড়ে ওঠা দলের পাঠচক্রে সলিল চৌধুরীর অংশগ্রহণে নতুন মাত্রা যুক্ত হলো।
তরুণরা বুঝতে পারলো, শ্লোগান, মিছিল, মিটিং করে জনগণকে সচেতন করা যাবে, কিন্তু বিপ্লব করা যাবে না। বিপ্লব করতে হলে বিপ্লবী দল লাগবে। বাংলাদেশে বিপ্লবী দল নেই। অতএব বিপ্লবী দল গড়ে তোলার সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করতে হবে।
সলিল চৌধুরী অক্লান্ত পরিশ্রম করে বেশ কিছু ছাত্র, যুবককে একত্রিত করতে সক্ষম হলো। তাঁরা জীবনের সর্বক্ষেত্রে মার্কসবাদী সংগ্রামে নিয়োজিত থেকে ব্যক্তি স্বার্থকে নির্মূল করে সঠিক বিপ্লবী দল গড়ে তুলতে সংঘবদ্ধ হলো। অতঃপর রুশ বিপ্লব বার্ষিকীতে দলের আত্মপ্রকাশ করলো। কলেজ বিশ^বিদ্যালয়ের চিন্তা চেতনায় এগিয়ে থাকা ছাত্রণ্ডছাত্রীরা দলে দলে বিপ্লবের পতাকা তলে সমবেত হতে লাগলো। বিপ্লবের অঙ্গীকার নিয়ে গড়ে ওঠা ছাত্র সংগঠন দ্রুত সাধারণ মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হলো।
তরুণণ্ডতরুণীরা প্রেম, ভালোবাসা নিয়ে প্রশ্ন করলো কেন্দ্রীয় কমিটির নেতাদের কাছে। অবিবাহিত কেন্দ্রীয় নেতারা প্রেম ভালোবাসাণ্ডবিবাহকে চূড়ান্ত বিচারে ব্যক্তিগত সম্পত্তিজাত মানসিকতা বলে মন্তব্য করলো। নেতারা আরো বললেন, জীবণ্ডজন্তুর মধ্যেও যৌনতা আছে। শুধু বিপ্লবীরা সর্বহারা শ্রেণির রুচি সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে প্রেমণ্ডভালোবাসাকে উন্নততর স্তরে উন্নীত করতে পারে। অধঃপতিত বুর্জোয়া রুচি, সংস্কৃতির চর্চা ব্যক্তিগত জীবনে আটকে পড়ার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়।
আশাহত তরুণণ্ডতরুণীরা গোপনে প্রেম করতে লাগলো। সাহসী বোকারা ধরা পড়ে দল ছেড়ে ব্যক্তিগত জীবনে প্রবেশ করলো।
কর্মীরা সলিল চৌধুরীর কাছে প্রেমের ব্যাখ্যা চাইলে তিনি বললেন, প্রেম মানে দলের সাথে আরো বেশি একাত্ম হওয়া। কাউকে ভালোলাগা মানে তাকে সাথে নিয়ে বিপ্লবের জন্যে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করা।
মানুষের মুক্তির সংগ্রাম জোরদার করতে না পারলে প্রেমণ্ডভালোবাসা ব্যক্তিগত জীবনেবোধের এক সংকীর্ণ রূপ। এখন তোমাদের ‘দলই জীবন বিপ্লবই জীবন’ এই চেতনায় দল গড়তে হবে। প্রেমণ্ডভালোবাসার নামে দু’জন নরণ্ডনারীর একান্তে আলাপচারিতা, সময় কাটানো চূড়ান্ত বিচারে বিপ্লবের সাথে বিশ^াসঘাতকতার সামিল। এই মুহূর্তে দলে একদল পেশাদার বিপ্লবী দরকার। যারা বিপ্লবের জন্যে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত থাকবে। তোমাদের মধ্য থেকে আমরা পেশাদার বিপ্লবী গড়ে তুলতে চাই। সেজন্য তোমাদেরকেই সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করতে হবে।
সলিল চৌধুরীর আলোচনা শুনে কর্মীরা বিমোহিত হয়ে পড়ে। অনেকেই প্রেমিকণ্ডপ্রেমিকার সাথে দেখা সাক্ষাৎ বন্ধ করে দেয়। তারা জানিয়ে দেয়, দেখা হবেণ্ডকথা হবে মিছিল, মিটিং আর রাজপথে। পার্কে, সিনেমায়, রেস্টুরেন্ট, ক্যাম্পাসে, বন্ধুদের আড্ডায় সময় দেয়া অধঃপতিত বুর্জোয়া সংস্কৃতির বহিঃপ্রকাশ।
একদিন দলের নারী কর্মী বাবলী সলিল চৌধুরীকে বললো, আমি বাবুলকে ভালোবাসি, ওকে ছাড়া আমি বাঁচবো না। আমরা দু’জন দলই করবো আজীবন। শুধু আমাদের দু’জনকে একত্রে থাকার অনুমতি দিন।
সলিল চৌধুরী শান্ত কণ্ঠে বললো, তোমাদের দু’জনকে দল থেকে অব্যাহতি দেয়া হলো। আজ থেকে কোথাও দলের পরিচয় দিবে না।
বাবলী চোখের পানিতে বুক ভাসিয়ে দলের অফিস ত্যাগ করলো।
দলের সম্ভাবনাময় তরুণণ্ডতরুণীরা একে অপরের প্রেমে পড়ে ব্যক্তি জীবনে ফিরে যেতে শুরু করলো।
এদের কেউ কেউ অভ্যাসবশতঃ দলের সাথে যুক্ত থেকে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেন। উপায়হীন বিপ্লবীরা প্রেমণ্ডভালোবাসা বিসর্জন দিয়ে দলের সাথে গা ভাসিয়ে দিয়েছেন। সামর্থ্যবানরা আর্থিক সহায়তা করে দলের নেতাণ্ডকর্মীদের আস্থাভাজন হয়ে দিন গুজরান করছেন।
শেষ পর্যন্ত সলিল চৌধুরীর সাথে মিলির সম্পর্ক নিয়ে কানাঘুষা শুরু হলো।
সলিল চৌধুরী বললেন, ‘কেন্দ্রীয় কমিটির নেতাদের সংগ্রাম আত্মত্যাগের পরই কমরেড মিলির স্থান। তিনি দলের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছেন। দলের সাথে একাত্ম হবার সংগ্রামে তিনি সবচেয়ে এগিয়ে থাকা একজন বিপ্লবী। তাঁর সাথে আমার সম্পর্ক উন্নত রুচি, সংস্কৃতির সর্বোচ্চ রূপে নেতাণ্ডকর্মীর মতো। সেখানে অন্য কিছু খুঁজতে যাওয়া মানে নি¤œমানের অধঃপতিত রুচি, সংস্কৃতির বহিঃপ্রকাশ।
প্রবাদ আছে, প্রেম, টাকা, আগুন লুকানো যায় না। এই সহজ সত্যটি দেশের সাধারণ মানুষ বুঝতে পারলেও সলিল চৌধুরী বুঝতে পারেন নি। বরং তিনি আদর্শের প্রলেপ মাখিয়ে মিলির সাথে গড়ে ওঠা প্রেম ঢেকে রাখতে সচেষ্ট হলেন। নেতাণ্ডকর্মী, সমর্থক, শুভ্যানুধ্যায়ীদের মনের ভেতর সন্দেহের বীজ অঙ্কুরিত হয়ে ডালণ্ডপালা গজালো। সব সমালোচনাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে মিলিকে কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা বানালেন। কর্মীদের প্রচণ্ড সমালোচনা এবং চাপের মুখে তাঁকে কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে বাদ দিতে হলো।
ইতিমধ্যে সলিল চৌধুরী নব্বই বছরে পা রাখলেন। বাংলাদেশে বিপ্লব না হবার কষ্ট তার বার্ধক্যের চ্যালেঞ্জগুলোকে আরো ধারালো করে তুলেছে। অতিমারী কোভিডণ্ড১৯ তাঁকে ঘরবন্দী জীবনণ্ডযাপনে বাধ্য করলো। পুরো এক বছর পার্টি সেন্টারে মিলার শারীরিক অনুপস্থিতি তাকে দিশেহারা করে তুললো।
অবশেষে সকল দ্বিধাণ্ডদ্বন্দ্ব, ভয়ণ্ডভীতি, আবেদনণ্ডনিবেদন, পদণ্ডপদবী উপেক্ষা করে মিলার ফ্ল্যাটে এসে উঠলেন। মিলা সলিল চৌধুরীর বুকে মাথা রেখে অঝোরে কাঁদছেন।