প্রকাশ : ২৪ অক্টোবর ২০২২, ০০:০০
আমার হাতটি যেন রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর। তাই হাত বাড়ালেই আমার মুঠো ভরে যায় প্রেমে। আমার শস্যের মাঠ ভরা থাকে এবং আলোয় আলোয় সাজাতে পারি রাতের বসুন্ধরা। আর প্রতিদিন ঘুম থেকে জেগে ওঠলেই চোখের সামনে ভাসে চিরচঞ্চল শহর। ঘরে-বাইরে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু; অসংখ্য পরিচিত মুখ। তাদের সঙ্গে কত গল্প, আনন্দণ্ডকথন, দুঃসময় ভাগাভাগি। এই তো আমি নিজ বাসভূমে সুখে-দুঃখে, স্বজন-বন্ধুত্বে পথ হাঁটি অবিরাম। কিন্তু প্রবাসে? প্রবাসীরা কি চোখ খুললেই দেখতে পারেন মায়ের মুখখানি? বহু পরিচিত কোনো স্বজন কি তাদের নাম ধরে ডাকে? আর প্রতিদিনের অভ্যেস মতো জেগে থাকে প্রিয় আবাসভূমি? প্রবাসীদের মা-মাটির এই শেকড়-সম্বলিত আনন্দণ্ডযাপন নেই। এখানে অর্থের সাথে জীবনের সম্পর্ক যতটা গভীর, জীবনের সঙ্গে হৃদয়ের সম্পর্ক ততটা নিকট নয়। তাই প্রবাসীর মন-আকাশে প্রতিনিয়ত ভেসে থাকে মেঘ-জ্যোৎস্না, আনন্দণ্ডবেদনা। এমন ভাবনা থেকেই বোধকরি লেখক জমির হোসেন তাঁর দীর্ঘ প্রবাস-যাপনের অভিজ্ঞতা থেকে লিখেছেন ‘প্রবাসের মেঘ-জ্যোৎস্না’ বইটি। এটি বইমেলা-২০২০-এ প্রকাশ করেছে চৈতন্য প্রকাশন।
মুসলিমদের জন্যে প্রতিবছর ঈদ অপার আনন্দ নিয়ে আসে। যারা কর্মের প্রয়োজনে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকেন, ঈদ উপলক্ষে তারা ফিরে আসেন জন্মস্থানে, গ্রামে-গঞ্জে। নাড়ির টান কে অস্বীকার করতে পারে? যত কষ্টই হোক, জন্মভিটায় ঈদ করার আনন্দ থেকে কেউ বঞ্চিত হতে চায় না। ফলে ঈদ এলেই দেখি বাসে-লঞ্চে-ট্রেনে নীড়ে ফেরা মানুষের উপচেপড়া ভিড়। কিন্তু প্রবাসীরা? জমির হোসেন তাঁর ‘প্রবাসে ঈদ আনন্দ’ রচনায় লিখেছেন, ‘বছর ঘুরে এই উৎসব এলেই মনের মাঝে নানা রকমের স্মৃতি উঁকি দেয়। ওই সময় খুব বেশি মনে পড়ে দেশ এবং পরিবার, স্বজনদের কথা। হৃদয়টা তখন বোবা কান্না করে নিভৃতে। কিন্তু অসহায় জীবনের কী আর করার আছে। কিছুই ভালো লাগে না।’ লেখকের এই অনুভব কেবল একজন ব্যক্তির নয়। আমাদের মনে হয়, এ অনুভব প্রত্যেক প্রবাসীরই। আর এভাবেই বছরের পর বছর পরভূমে ঈদণ্ডযাপন করেন তারা।
এই যে প্রবাসে নানারকম বেদনার মিছিল, তবু কেন প্রবাসে যাওয়া? জমির হোসেনের মতে, সচ্ছল জীবনের আশায় মানুষ পরদেশে পাড়ি জমায়। উদ্দেশ্য আয়-রোজগার করা। সে অর্থ দেশে পাঠালে পরিবার-পরিজন সুখে থাকবে। তাদের মুখের দিকে তাকিয়েই প্রবাসের দুঃখণ্ডকষ্ট সইতে শেখে প্রবাসীরা। আজকাল প্রবাসীদের ডাকা হয় রেমিটেন্স যোদ্ধা। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বক্তৃতায় বারবার বলা হয়, তারা দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি। কিন্তু বাস্তবে যোদ্ধাদের সম্মান দেয়া হয় না। তাদের মৃতদেহও অনেক ক্ষেত্রে মর্মান্তিকতার শিকার হয়। ‘রেমিটেন্স দেশের চালিকাশক্তি’ প্রবন্ধে জমির হোসেন লিখেছেন, ‘প্রবাসে মরে গিয়েও শান্তি নেই। লাশ নিয়ে চলে টানাহেঁচড়া। সঠিক পৃষ্ঠপোষকতা না থাকলে হিমাগারে লাশ পড়ে থাকে অনেক দিন। আর যদি আত্মীয়-স্বজন না থাকে তবে তো মরার পরেও দুর্ভোগের শেষ নেই।’ এই হলো রেমিটেন্স যোদ্ধাদের পরিণতি। প্রবাসীরা যেন হয়রানি ব্যতীত নির্বিঘেœ দেশে ফিরতে পারেন, কেউ প্রবাসে মৃত্যুবরণ করলে দেশে দ্রুত মরদেহ আনার ব্যবস্থা করা এবং প্রবাসীদের সমস্যাগুলোকে গুরুত্বসহকারে রাষ্ট্র দেখবে--লেখকের সঙ্গে সঙ্গে আমরাও এই প্রত্যাশা করি। প্রবাসীদের যথার্থ সম্মান না দেখালে দিনশেষে আমরাই অকৃতজ্ঞতার পরিচয় দেবো।
জমির হোসেন সাধারণ প্রবাসীর মতো নন। তিনি লেখক। তাই তাঁর রয়েছে আলাদা দৃষ্টিভঙ্গি। দীর্ঘদিন ইতালিতে থাকার কারণে তিনি দেখেছেন ইতালীয় সভ্যতা, সংস্কৃতি-চর্চা, আইন, রাজনীতিসহ নানা বিষয়-আশয়। ‘প্রবাসে মেঘ-জ্যোৎস্না’ গ্রন্থের একটি বিশেষ প্রবন্ধ ‘রাতের আঁধারে যে দেশে নারীরা নিরাপদ’। লেখক এ প্রবন্ধে লিখেছেন, ইতালিতে নারীরা দিনে ও রাতে সমান নিরাপদ। ধর্ষণের মতো ঘটনা এখানে নেই। নারীদের সঙ্গে অভদ্রতাও সাধারণত কেউ করতে সাহস পায় না। এর কারণ হলো মূল্যবোধ ও সুশাসন নিশ্চিতকরণ। ইতালিতে প্রকৃতঅর্থেই অপরাধীর পরিচয় কেবল ‘অপরাধী’। তার অন্য কোনো দল, মত, প্রভাবশালী চাচা-মামা হয় না। কোনো পরিচয়েই অপরাধী রক্ষা পায় না। ফলে অপরাধ সংঘটিত হয় খুব কম। আর হলেও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় দ্রুতই ধরা পড়ে। লেখক তাই মনে করেন, ইতালির কাঠামো অনুসরণ করে বাংলাদেশও নারীদের জন্যে নিরাপদ হয়ে উঠতে পারে।
ইতালির ভালোমন্দ দুটিই দেখেছেন জমির হোসেন। তাই তাঁর চোখে পড়েছে ইতালিতে মা-বাবার আদর বঞ্চিত হয়ে শিশুরা বেড়ে উঠছে। তারা বড় হচ্ছে অন্য মানুষের আদর-স্নেহে। এর কারণ হলো নাগরিক সভ্যতার ব্যস্ততা। আলোচ্যগ্রন্থে চারটি ভ্রমণ বিষয়ক লেখা আছে। লেখক লন্ডন, ভেনিস, ইস্কিয়া ও টেনেরিফ দ্বীপ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা সংক্ষিপ্ত পরিসরে লিখেছেন। উপস্থাপন- সৌন্দর্যের কারণে লেখাগুলো বইটিকে সমৃদ্ধ করেছে। এছাড়াও নারী ধর্ষণ, খাদ্যে ভেজাল, ঋতুবৈচিত্র্যসহ বিভিন্ন বিষয়ে একগুচ্ছ নিবন্ধ গ্রন্থভুক্ত হয়েছে। এসব নিবন্ধে আবেগ-উচ্ছ্বাসের পাশাপাশি সচেতন দৃষ্টিভঙ্গি গভীরভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। ফলে ‘প্রবাসে মেঘ-জ্যোৎস্না’ হয়ে উঠেছে অর্থবহ একটি প্রকাশনা। গ্রন্থটির প্রচ্ছদ করেছেন রাজিব দত্ত। ৯৬ পৃষ্ঠার মূল্য রাখা হয়েছে ২০০ টাকা।