মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৪  |   ১৭ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার
  •   দৈনিক ইনকিলাবের প্রশাসনিক কর্মকর্তা শহীদুল্লাহ্ মিজির দাফন সম্পন্ন
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা

প্রকাশ : ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০০:০০

আদম সুরত
অনলাইন ডেস্ক

আমগো লুকমানের চোখগুলি আছিল কেমুন কালা ডাঙ্গর। আর শইল্যের রঙডা আছিল ঠিক বগার মতোন সাদা। মাডি দিয়া খেললেও কুনোদিন কালি লাগত না শইল্যের মইধ্যে। তুই হেই রং পাইছসরে মাইয়া। ঠিক আমগো লুকমানের মতোন।

কী যে কও দাদী, যেই মানুষডার চেহারা ঠিকমতোন মনে নাই, কুনোদিন দেখিও নাই তার রং বগার মতোন না কালা কাউয়া এইসব মিলাই ক্যামনে? এইসব আন্দাজি কথা বাদ দেওসে এইবার।

নবীতুননেসার কথায় দৌলতির কণ্ঠে আনন্দভরা অবিশ্বাসের সুর। তবু আরও কিছু শোনার বাহানা করে উসকে দেয় দাদীকে। বুড়ির গল্পও যেন ফুরাতে চায় না।

বাপরে দেখছনি। এদ্দুরা মাইয়া কেমুন ফাল পারে। আন্দাজি কথা না রে মাইয়া। খালি শইলডা না, লুকমানের মনের মইধ্যেও ছিল খালি মায়া আর মায়া। ভাত খাওনের সময় জরা বানায়া ভাত খাইত। এক জরা খাইত, আর এক জরা ছড়াইয়া দিতো কাউয়ারে। আদর কইরা যখন ডাক দিতো পশু-পাখিরে, কড়কড়াইয়া মুরগা আইয়া বইতো অর পায়ের কাছে। আমার সহজ সরল পুলা লুকমান ঠিক য্যান আমগো সুলেমান নবী।

দাদী তুমার কতার কুনো আগামাথা নাই। এইসব আজব কতা কিছুই বুঝি না।

থাক, তোর বুঝন লাগতনা। চুপ কইরা খালি আসমান দ্যাখ। বেশুমার তারা ছিডাইয়া রইছে তার সুরত দ্যাখ। ওইখানে মাইনষের যে সুরত আছে হেইডা একবার দ্যাখ। কিন্তু কী থেইকা যে কী হইয়া গেল, আমার পুলাডা নাই হইয়া গেল একদিন।

দরদমাখা ঘোরলাগা কণ্ঠ মুহূর্তে থমকে যায় নবীতুননেসার। বাতাসের ফিসফিসানির মধ্যে যাঁতায় পেষা চাপা একটা আবেগরুদ্ধ ঘর্ঘরানি ওঠে কোথাও। উঠোনের পাটিতে চিত হয়ে শুয়ে চোখজোড়া আশ্বিনের আসমানে ঠেলে দিয়ে বিড়বিড় করে আরও কী সব যেন বলে ওঠে নবীতুননেসা!

আশ্বিনের জোছনাধোয়া রাত। ঘরের পেছনের চালতা গাছের ওপর দিয়ে চাঁদের মুখটা দেখা যায় কোনোমতে। কী ঝকঝকে আলো! বিশ্ব চরাচরের সব কালি ধুয়ে দিয়ে সে আলো হেসে উঠল নবীতুননেসার জনশূন্য ঘরউঠোনে। এ আলো এতোটাই পরিষ্কার যে এক লহমায় পরিশুদ্ধ করে দিতে পারে মানুষের অন্তরের ভেতরটা। তাই তো দৌলতি ঠিক বুঝতে পারে নবীতুননেসার উতলা মনের আবোলতাবোল এসব গল্প। চুপ হয়ে তাকিয়ে থাকে আকাশের দিকে। যেদিকে আঙুল উঁচিয়ে ইঙ্গিত করে কী যেন দেখায় নবীতুননেসা। কী ওটা? কী আছে ওখানে? অসীম আসমানে তারার সাত সমুদ্র আর তেরো নদী ছাড়া আর কীইবা থাকতে পারে!

দৌলতি জানে, মানুষ মরে গেলে বা হারিয়ে গেলে বাসিন্দা হয় সাত আসমানের। সাদা ঘোড়ার পিঠে চড়ে সওয়ার হয় মেঘের চরাচরে। এমন কত গল্প শুনেছে! আর এতোদিন এ বুঝটাই তো দিয়ে আসছিল নবীতুননেসা। কিন্তু আজকাল যে আজব কথাগুলো শুনছে তার মানেটাইবা কী? আর মনে মনে এটাও ভাবছে, একদিন ঠিক ঠিক পথঘাট চিনে ওই রথখোলা মাঠের ধূধূ চরাচরে নামতে পারবে তো সেই সাদা ঘোড়া?

নবীতুননেসা চমকে দেয়, বুঝলি রে মাইয়া, আশ্বিনের ধলপহরে আসমানের গাঙে যখন চান্দের আলো চিকচিক করে, তার মইধ্যে তারার বুটি যখন ঝকমকাইয়া হাসে তখন আসমান থেইক্যা নাইম্যা আসে মস্ত সেই তেজী ঘোড়া। তার কালা চোখ দুইডায় বেজায় মায়া, মাথার দুধসাদা ঝালর গর্দান পর্যন্ত নামানো। ওই যে রথখোলার মাঠডা আছে না, হেইখানে দপদপাইয়া নাইম্যা আমগো গেরাম থেইকা চইলা যায় দূরদেশের কোনো গেরামে। খলবলাইন্যা জুছনার মইধ্যে আমি সব দেখতে পাইরে দৌলতি।

দৌলতির মনে আচমকা ধাক্কা লাগে। তার দাদী কি সত্যি সত্যি পাগল হয়ে গেল? নবীতুননেসা যখন ঘোরের মধ্যে আসমান থেকে নেমে আসা ঘোড়ার সাথে দূর বহুদূর চলে যায় আর তার বুকের মধ্যে ঘোড়ার খুরের শব্দ ঠকঠক করে বাজে তখনই দৌলতি খুব করে ভাবতে চেষ্টা করে তার বাপ লোকমানের চেহারা। যে চেহারা কখনও মনের মধ্যে খোদাই করা ছিল না তা কল্পনা করতে গিয়ে অসহায়ত্বে কেমন ক্লান্ত হয়ে পড়ে দৌলতি। একটা ভাঙা ভাঙা নামের ডাক উঠোন পেরিয়ে ছুটে যায় সেই দূরের অন্য কোনোখানে। রথখোলার মাঠ পেরিয়ে আরও দূরের কোনো মঠের কাছে, মাঠের দিকে। তারপর আবেশ কাটিয়ে আরও ঘন হয়ে লেপ্টে থাকে দাদীর বুকের কাছে। নবীতুননেসার অস্থিরতা তার কাছেও এসেছে।

আর কী দেখো দাদী? সেই ঘোড়া কি আমগো ডাক দিয়া গেছে? আমগোরে নিয়া কি একবার সাত আসমানে যাইতে পারে না? খালি রথখোলার মাঠেই দাপাইয়া বেড়ায়? চুপ কইরা রইছ ক্যান? আমারে তাড়াতাড়ি কও।

দৌলতি বোঝে, এরপর নবীতুননেসার গল্প শেষ হয়ে যাবে। ওদের উঠোনের পাশ দিয়ে বেদকাশির খাল ডিঙিয়ে থেমে যাবে খুরের শব্দ। মাইজপাড়ার মঠের কাছে থেমে যাবে সে গন্তব্য। গল্পের এ পর্যায়ে নবীতুননেসার করুণ মুখ আবারও প্রসন্ন হয়ে উঠবে।

দৌলতি সেটা দেখার অপেক্ষায় আশ্বিনের হিমজড়ানো রাতে নবীতুননেসার গলা জড়িয়ে বুকের ওম ভাগ করে। অস্থিরতা নামিয়ে নরম গলায় বলে, তারপরে কী ঘটল হেইডা তাড়াতাড়ি কও দাদী।

আরে, অত অস্থির ক্যারে? খাড়া কইতাছি। পানের খিলি পুইরা লই মুখে। তারপর হুন... হেই ঘোড়ার লাগাম ধইরা পিঠে কে বইসা থাকে জানস, তোর বাপ। আমগো লুকমান। আজ এতডি বছর পরেও ঠিক আগের মতোনই তার চেহারা। একদিন আমারে দেইখা পাশ কাডাইয়া কেমুন উডানের ধার দিয়া চইলা গেল। আর আইলো না।

দৌলতির চোখগুলো তখন আনন্দে চকমক করে। সাথে সাথে অনিশ্চয়তার এক বিষাদের ছায়াও নামে চোখে। জন্মের পর থেকে আজ কতগুলো বছর কেটে গেছে। বাপকে সে যতটুকু দেখেছিল তা এখন অনেকটাই ঝাপসা। সে মুখের আদল কিংবা শরীরের মাপ পুরোটাই বিলীন হয়ে গেছে। এখন যতোটা ভাবছে কিংবা দেখছে সবটাই দাদী নবীতুননেসার চোখ দিয়ে। তাইতো বুড়ি যখন বলে, তুই মাইয়া হইছস ঠিক তোর বাপের মতোন, শুনে দুলির আনন্দ হয় খুব। সেই আনন্দ খানখান হয়ে ভেঙেও যায় হঠাৎ।

দৌলতি জানে ওর বাপ কোনোদিন আসবে না। তবু নবীতুননেসার কথায় কল্পনার আশ্চর্য সেই তেজী ঘোড়ার পেছন পেছন সওয়ার হয়ে ছোটে। ছুটতে ছুটতে আকাশের সবক'টি পথ ঠাওর করে তার চোখগুলো নেমে আসে অন্ধকার উঠোনের কোণায় কোণায়। তারপর সেখান থেকে পালাতে পালাতে উঠোনের গাছগাছালির ফাঁক দিয়ে রথখোলার সীমানার কাছে গিয়ে আটকে যায়। ওখানে পুরানো মঠ। জোড়া শিমুল গাছ, টিয়া পাখির সবুজ ঝাঁক। ট্যা ট্যা করে ডেকে ওঠে জয়ের আনন্দে মঠের মাথার সোনামোড়া বিজয় দণ্ডের ওপর দিয়ে সাত আসমানের ওপর কোথাও চলে যায়।

নবীতুননেসার চোখে যে মানুষের ছায়া, সে ছায়া দৌলতির চোখে আকার পায় ভিন্ন এক মানুষের। কিন্তু কেউ জানে না সে ছায়া একই মানুষের কি না! ঝাপসা আলোয় হয়তো দৌলতির অস্থির চোখ দুটো দেখা যায় না। কিন্তু তার চোখের তারার কল্পনায় ঠিক ধরা দেয় কোনো অদেখা অজানা মানুষের সুঠাম কোনো সুরত। নবীতুননেসার কথায় সে সুরত যখনই আকার ধরতে শুরু করে আবার তা হুস করে উড়েও যায় মুহূর্তে। দৌলতি এর মানে বোঝে না। কল্পনার সে তেজী ঘোড়ার খুরের ঠকঠক শব্দে কী আশ্বাস না অজানা ভয় মেশানো আছে তাও ঠিকমতো অনুমান করতে পারে না দৌলতি।

আশ্বিন শুরু হয়ে চলে গেলো অনেকটা দিন। রাত গভীরে আকাশে কুয়াশার সুড়ঙ্গ হয় যখন পাতায় ডালে ডালে বিন্দু বিন্দু হিম জমে। ধামসোনার উঠোন ঘরজুড়ে ধলপহরের কুয়াশায় কেমন রহস্য জমে ভয়ের। বাড়ির পেছনের ছনগাছের ঝোপে যেখানে কুড়ুয়া পাখি ভয়ের সুর ধরে গমগম করে ডাকে সেখানে কোনো কোনোদিন খসখসে পায়ের শব্দও শুনতে পায় নবীতুননেসা। ওটা কি কোনো পায়ের শব্দ? না কি ঘোড়ার খুরের থেমে যাওয়া আওয়াজ? নেমে এলো বুঝি সাত আসমান থেকে? পিঠের ওপর বসে আছে সে কি নবীতুননেসার কল্পনায় থাকা সেই মানুষ? সুলেমান নবী? না কি ফিরে আসা লোকমান?

আশ্বিনের রাতদুপুরে তাই নবীতুননেসার কী জানি হয়! হিমবাতাসেও বুকটা হুহু করে, চোখ দুটোতেও জ্বালা ধরে ভয়ানক। তাই উঠোনের পাটিতে ধড়মড়িয়ে জেগে ওঠে দৌলতিকে বুকের কাছে আরও লেপটে ধরে যেন কেউ কেড়ে নিতে না পারে! না, কারও কাছে যেতেও দেবে না। এ যে শুধু তার নিজের সন্তান লোকমানের আদরের ধন দৌলতি।

দুই

নবীতুননেসার জীবনে আর কোনো গল্প নেই। বহু বছর আগে যে গল্পটা অন্যভাবে শুরু হতে পারতো তা আজ বহু বিবর্ণ মলিন এক রূপকথা। সেসব দিনের কথা আজও মনে পড়লে হা হুতাশ বাড়ে।

একদিন রাতে লোকমান নবীতুননেসার কাছে গিয়ে বলে, আম্মা আমি বিদেশ যামু। এই দেশের কাম আর ভালো লাগে না।

নবীতুননেসার চোখ কপালে ওঠে। ওমা, তুই এডি কী কস্ লুকমান? বাড়িতে আছে কেডা তুই আর আমি ছাড়া? আর এত্তগুলি টেকা কেডা দিব তোরে?

তোমার চিন্তা আমি কইরা রাখছি। কোহিনূররে বাড়িত নিয়া আসমু।

মাইজপাড়ায় যাতায়াতের সুবাদে কোহিনূরের সাথে আলাপ পরিচয়, একটু ভাব ভালোবাসা হয়েছিল লোকমানের। এ কথা সেভাবে জানতো না নবীতুননেসা।

তোর ব্যাপারডি কী একবার খোলাসা কইরা ক দেহি আমারে? তোরে এত টাকা দিব কেডা? আমার তো শুইন্যা কিছুই ভালো লাগতাছে না।

সব ব্যবস্থ্যা করব ইব্রাহিম। কোহিনূরের মামাতো ভাই। আমি খালি খালপাড়ের জমিডি বেচমু। মেলা টেকার দরকার। লোকমানের চটজলদি উত্তর। বিদেশ যাবার কথা সেই শুরু, সেই শেষ। পরের ছয় মাসের মধ্যে সবকিছুর পাকা বন্দোবস্ত করে রথখোলার মাঠের পাঁচ গ-া ধানী জমি বিক্রি করে খেজুরবাগানে কাজের ভিসা নিয়ে ওমানে পাড়ি দিয়েছিল লোকমান।

নবীতুননেসার প্রথমে ইচ্ছে ছিল না। একা বাড়ি। আশপাশে আর কোনো ভিটা বা বাড়ি নেই। জনশূন্য ধূধূ মাঠের মধ্যে একা মরে পড়ে থাকলেও দেখবার কেউ নেই। কিন্তু লোকমানের চোখে তখন কত স্বপ্ন, আশা আর বিত্ত বৈভবের আকাঙ্ক্ষা! সবকিছুর মধ্যে জ্বলজ্বল করছিল উজ্জ্বল এক হীরকখণ্ডের মতো একা কোহিনূর। তাই নবীতুননেসার ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে মাইজপাড়ার ইব্রাহিমের শলা পরামর্শেই ঘরে এনে তুলেছিল কোহিনূরকে। তার অল্প ক'দিন বাদেই সওয়ার হয়েছিল ওই মরুর দেশে।

প্রথম প্রথম রুজি রোজগার একেবারে মন্দ ছিল না। নবীতুননেসার জন্যে ভালোই টাকাপয়সা পাঠাতো লোকমান। সব এনে কোহিনূরের হাতে দিয়ে যেতো ইব্রাহিম। আরও কত খবর নিয়ে আসতো লোকমানের। নবীতুননেসা শুনতো আর চোখ দিয়ে পানি পড়তো তার। ইব্রাহিমের মুখ থেকে তবু লোকমান আর মরুর গল্প শুনতে ভালো লাগতো।

নবীতুননেসার ভিটায় যাতায়াত বেড়ে গেলো ইব্রাহিমের। যে চোখ একদিন ভরসা আর বিশ্বাস নিয়ে তাকিয়েছিল ইব্রাহিমের দিকে সেটাও যেন আস্তে আস্তে বদলে যেতে শুরু করলো। কোহিনূরের কাছে তখন লোকমান হয়ে গেলো দূরের মানুষ। নিজের আপনজন হলো ইব্রাহিম। নবীতুননেসাও আর নতুন করে কোনো খবর পায় না তাদের মুখ থেকে।

নবীতুননেসার বেশি সময় লাগেনি ইব্রাহিমকে চিনতে। দিনে দিনে তার আসল চেহারা বেরিয়ে গেলো সবার সামনে। সেসব কথা বাড়ি বয়ে কানে এলে নবীতুননেসার না শুনে কোনো উপায় থাকে না। খালের ধারের যে জমি বিক্রি করেছিল বশির মণ্ডলের কাছে, সেখানে কাজে লেগেছিল তারই দুই ছেলে দয়াল আর নিজাম। জমির আগাছা সাফ করতে গিয়ে দুজনে কথা বলছিল নবীতুননেসাকে ইঙ্গিত করে।

দয়াল বলে, চাচী এক্কেরে সহজ সরল ভালা মানুষ। লুকমানের সাথে যে মাইজপাড়ার ইব্রাহিম্যার গ-গোল কোহিনূররে নিয়া চাচীর চোখে হেই আলামত মনে হয় এখনও ধরা পড়ে নাই। ইব্রাহিম্যা যে কীসের লাইগা ঘন ঘন আসে চাচী এখনও বুইঝত পারের না। দোকানে বইসলে নানান কতা ঘাঁডাঘাঁডি হয়।

মাটির ডেলা ভাঙতে গিয়ে শুকনো মরা ডাল দিয়ে বিড়বিড়িয়ে গায়ে ওঠা চ্যালা মারে নিজাম। বিরক্তি নিয়ে বলে, হুইনলাম অনেকদিন হইলো লুকমাইন্যার কুনো খবর নাই। চাচী না কি খালি আবোল তাবোল বকে।

ছোট ভাইয়ের কাণ্ড দেখে দয়াল চিল্লিয়ে ওঠে। আরে, ইডি মারস কিত্তি? ইডি কামড়ায় না। যেডি পুটকি উপরের দিক দিয়া হাঁডে হেডির মইধ্যে বিষ। ইব্রাহিম্যারে দেহস না কেমুন কইরা হাঁডে। লুকমাইন্যা যে টেকা পাঠায় সব হুনছি তার পেডেই গেছে। তার দুই দিকেই লাভ। সাপও মরলো আবার লাডিও ভাঙল না।

দূর থেকে ছন ঝোপের গাছে নবীতুননেসাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চুপ হয়ে যায় দুজন।

বেশ কিছুদিন বাদে ইব্রাহিম এসে কোহিনূরের কাছে খবর দেয় লোকমান বাড়ি আসছে। ওমানে কথা হয়েছে তার সাথে। এবার আসলে মাসখানেকের ছুটি নিয়েই আসবে।

নবীতুননেসার অসুখের কথা শুনে শেষমেশ চার বছরের মাথায় বাড়ি এসেছিল লোকমান। দেড় মাসের ছুটি নিয়ে এলেও এই লোকমান আগের মতো নয়। আগের সে দাপিয়ে বেড়ানো তেজী ঘোড়াটি আর নেই। কোনো কিছুতে আর মন টিকে না তার। যে কোহিনূররে এত শখ করে আহ্লাদ দিয়ে বাড়ি এনে তুলেছিল তার সাথেও খিটমিট লাগে প্রতিদিন। ওদিকে ইব্রাহিম চাপ দিচ্ছে টাকা শোধ দেওয়ার। কিন্তু বাড়িতে পাঠানো টাকার কোনো হিসাব দিতে পারে না কোহিনূর।

একদিন সকালে তুলকালাম কাণ্ড বেঁধে গেলো ইব্রাহিমকে নিয়ে। আত্মীয়তার সুবাদে ওর আসা যাওয়ার কথা বিদেশ বসেই জানতো লোকমান। কিন্তু একমাস বাড়ি থাকার পর যখন জানলো কোহিনূর মা হবে আর এ নিয়ে বাজার থেকে ফিরলো দুই কান ভারী করে সেই রাতেই হাত তুললো কোহিনূরের গায়ে। এমন হুজ্জোত হাঙ্গামার দুদিন পর আবার ফিরে গিয়েছিল ওমানে। বিশ্বাস অবিশ্বাসের মাঝামাঝি নিজেকে ঝুলিয়ে রেখে সকলের সাথে অনেক হিসাব অনিষ্পন্ন রেখে সেই যে লোকমান ফিরে গেল আর বাড়ি আসেনি কোনোদিন।

ওমান ফিরে যাবার সাত মাসের মাথায় দৌলতির যখন জন্ম হলো তখনও খুব একটা খুশি হতে পারেনি লোকমান। নবীতুননেসা ভেবেছিল একদিন মেয়ের মুখ দেখলে নিশ্চয় লোকমানের মন গলে যাবে, সকল রাগ ক্ষোভ পানি হয়ে যাবে। কিন্তু দিন দিন বাড়ির সাথে যোগাযোগ কমিয়ে দিলো লোকমান। ওর মনের পাথর টলাবার কোনো সুযোগই আর কেউ কোনোদিন পায়নি।

পরের বছর চারেক পর্যন্ত যোগাযোগ ছিল বাড়ির সাথে, নবীতুননেসার সাথে। দৌলতির বয়স যখন তিন তখনই দুঃসংবাদ এলো একদিন বাড়িতে। খেজুরবাগানে কাজ করতে গিয়ে গাছ থেকে পড়ে কোমর ভেঙেছে লোকমান। তারপর সপ্তাহখানেক হাসপাতাল থাকার পর কী যে হলো আর কোনো হদিস পায়নি লোকমানের।

তিন

নবীতুননেসার উঠোন ছাড়িয়ে খালের কাছ থেকেই শুরু বিস্তীর্ণ রথখোলা মাঠের। সেই মাঠ এখন আর ধূধূ বিরান নেই। খণ্ড খণ্ড জমিতে ফসলের নাগাল পাওয়া যায়। খালপাড়ের লাগোয়া জমিটায়ও এখন কালো মাষকলাইয়ের ঝোপ। মাঠের যেদিকটায় জোড়া শিমুলগাছ সবসময় আগুন ছড়ায় সেখানেই উঁচু রথখোলা মঠ। নবীতুননেসার উঠোন থেকে দাঁড়িয়ে গাছপালার ফাঁক দিয়ে দূরের মাইজপাড়া মঠের চূড়া দেখা যায় কোনোমতে। আরও দেখা যায় দূরে মিশে যাওয়া উঁচু সড়কের চিহ্ন।

দৌলতি কেন নবীতুননেসাও এককালে গল্প শুনেছিল মঠের মাথায় ছিল স্বর্ণদণ্ড, যা রোদের আলোয় জ্বলজ্বল করতো দূর থেকে। জমিদারের লোকজন ঘোড়া ছুটিয়ে আকাশপাতাল দাপিয়ে বেড়াতো ধামসোনার চরাচর জুড়ে। সে শব্দে শিমুলের ডাল আর মঠের খোড়ল থেকে ট্যা ট্যা করে উড়ে যেত সবুজ টিয়ার ঝাঁক। দৌলতি স্কুলে যাবার পথে এখনও মাঝেমধ্যে অমন করে উড়ে যেতে দেখে সেই টিয়ার ঝাঁককে।

অনেকদিন কেটে গেছে। আজকাল কেমন মুষড়ে পড়েছে নবীতুননেসা। দৌলতিকে নিয়ে চিন্তাটা বড় বেশি উসকে উঠছে দিন দিন। দৌলতির যখন ছয় বছর বয়স হলো মামার বাড়িতেই গলায় দড়ি দিয়েছিল কোহিনূর। তার কিছুদিনের মধ্যে আদম পাচারের মামলা আর জাল জালিয়াতিতে নিজেও ফেঁসে গিয়েছিল ইব্রাহিম। সবাই জানে দশ বছরের জেল হয়েছে তার। সাজা খাটছে জেলার কারাগারে। কিন্তু সেসব কিছু ঘটবার আগে কঠিন সত্যটা নবীতুননেসাকে ঠিকই জানিয়ে দিয়েছিল কোহিনূর। তারপর থেকে যেন আরও বেশি আঁকড়ে ধরতে চাইছে দৌলতিকে।

একটা গল্প কওসে দাদী, আজকাল দৌলতির এমন আবদারে নবীতুননেসা আরও চুপসে যায়। আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে, সাত আসমানে চাইয়া দ্যাখরে মাইয়া। ওই যে আদম সুরত। আমগো পাহারা দিতাছে। তোর কুনো ডর নাই। মানুষ বদলাইয়া যায় ঠিক, আদম সুরত বদলায় না।

দৌলতি এখন অনেক কিছুই বুঝতে পারে। নবীতুননেসা আগে সুলেমান নবীর যে কিসসা শোনাতো কিংবা সেই তেজী ঘোড়ার খুরের আওয়াজ ওঠা গল্প, তা আসলে মাইজপাড়ার মঠের কাছে রথখোলার মাঠে নয়, সে দপদপানি আসলে উঠতো নবীতুননেসার বুকে, বুকের শূন্য পাথারে। নবীতুননেসার কথায় তাই নিজের মতো করেই বুঝে নিয়েছে নিজের জীবনের ভাগ্য ও পরিণতিকে। বাপকে চোখে দেখেনি কোনোদিন, মায়ের ছবিও মনে পড়ে আবছা কুয়াশার মতো। পরম নির্ভরতার জায়গা যে নবীতুননেসার প্রাচীন কোল আর এ বাড়ির ঘর-উঠোন এটা দৌলতি বোঝে।

একদিন স্কুল থেকে ফেরার পর নবীতুননেসাকে চিৎকার করে ডেকে বলে দৌলতি--

হুনছ দাদী। রথখোলার মঠের মইধ্যে পাগল কিসিমের একটা লোক আইয়া বইসা থাকে। বাড়িত ফিরনের সময় খালি চাইয়া থাকে আমার দিকে। কী চায় বেডা?

নবীতুননেসার শঙ্কা বাড়ে। বলে, খবরদার বুইন। পাগল টাগল হইব মনে হয়। স্কুলে যাওয়া নাইলে বন্ধ কর। কোনদিন কোন্ বিপদ ঘইটা যায়।

আরে না দাদী, আমি কই অন্য কতা। তুমি তো আর তোমার পুতেরে দেহো না। হেই ঘোড়া মনে হয় রথখোলার মাডে আইয়া নামছে। ক্যান, তুমি কুনো ঠকঠক আওয়াজ পাও নাই? বলেই দৌলতি খিলখিল করে হাসে।

আমার রক্ত হিম হয় আর তুই মাইয়া হাসছ? কাইল থেইকা আর স্কুলে যাওয়ার দরকার নাই।

হুনো দাদী, রথখোলার মঠের ভিতরে যে বেডা আইছে হেইডা তোমার লুকমান? যাও গিয়া দেইখা আসো।

নারে ছেরি। কী আবোলতাবোল কথা কস? এদ্দিন বাদে লুকমান কোত্থেইকা আইব? না কি অন্য কেউ? তোর মার কথা মনে পড়তাছে। না কি...

চুপ হইয়া গেলা ক্যান দাদী? অন্য কেডা? হেইদিন ইস্কুল থেইকা আসনের সময় আমারে হাত-ইশারা কইরা ডাকছিল। কেমুন আউলা ঝাউলা মানুষ। তার সুরত দেখলে ডর করে।

থাক ভালা হইছে। আর মাঠ পার হইয়া স্কুলে যাওনের কাম নাই।

দৌলতি এবার বলে, হেইদিন মাইনসের পায়ের আওয়াজ পাইয়া মঠের চূড়া থেইকা টিয়া পাখির ঝাঁক য্যান ট্যা ট্যা কইরা ছুটল। আমিও তার লগে লগে একদম বাড়ির দিকে ছুট দিলাম। মানুষটা পাগল হইলেও তার চোখ কেমুন ঠাণ্ডা।

নবীতুননেসার বয়স সত্তর পেরিয়েছে, হয়তো তারও বেশি। এ বয়সে নিজের জীবনে যে কত কাহিনী, কতরকম কিসসার আবাদ করেছে সব কি আর মুখ ফুটে বলা যায়! ধামসোনা গাঁয়ের এ পোড়ো বাড়িতে নাতনি দৌলতি আর গাছগাছালির ছায়া আর পাখপাখালির বুলি ছাড়া সব কেমন সুনসান। দিনরাত যে আওয়াজ ওঠে সেটাও বাতাসের সাথে গাব-চালতা ও আমগাছের নেচে ওঠা পাতাণ্ডডালের।

পুবের উঠোন ছাড়িয়ে কয়েক কদমের মধ্যে যে নিচু জমা সেখানে দমধরা কালো পানিতে হাঁটুসমান লতিকচুর ঝোপ এখন আরও লম্বা। চৈত্রের গরমে তেতে পুড়ে তার পাতাগুলো সব পোড়াটে হলদে যেন মস্ত কুটুমপাখির ডানা। শুশনি-কলমির দঙ্গলের ফাঁকে ফাঁকে হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো বেগুনি ফুল ফোটে ঠিক, কিন্তু নির্বিষ ঢোঁড়ার চলন দেখেও ভয় পায় নবীতুননেসা।

পানাপচা সেই নিচু জলা পেরিয়ে গেলে বেদকাশির লম্বা খাল। ওখানে একটা বাঁশের মাচা আছে। কে কবে বানিয়েছিল দৌলতি জানে না। একদিন বিকেলে তার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিল পাগলা কিসিমের মানুষটাকে। দূরে গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে নবীতুননেসাকে ডেকে দেখিয়েছিল। নবীতুননেসার চিনতে ভুল হয়নি। অবিকল সেই সুরত।

সেদিন রাতে দৌলতিকে বুকে জড়িয়ে উঠোনে পাটি পেতে শুয়ে ছিল নবীতুননেসা। ফুরফুরে বাতাস বইছে। অনেক দূরের মঠের কাছ থেকে টিয়া পাখির ঝাঁকের ট্যা ট্যা আওয়াজ উঠছে সজোরে। একটা দপদপানি উঠছে বুঝি রথখোলার মাঠের মধ্যে। শোঁ শোঁ বাতাসের মধ্যে ঘরের পেছনের ছনগাছের ঝোপে মচমচে খসখসে আওয়াজ ওঠে অবিরাম। এদিকে চৈত্রের চরাচরজুড়ে ধবল জোছনার দিগি¦দিক ছোটাছুটি। একটা আদমের ছায়া আস্তে আস্তে এগিয়ে এসে কেমন থমকে যায় নবীতুননেসার ঘরের কোণে। শরীর পায় না ছায়াটা, তাই সুরতও বোঝা যায় না ঠিকমতো।

নবীতুননেসা বুঝতে পারে কে এসেছে। কোহিনূর যেমনটি বলেছিল, আম্মা, একদিন হে আইব দৌলতির কাছে। সমস্ত বুঝ আপনার। আমার কিছু কওনের নাই।

ঘরের কোণে কেডা? কেডা খাড়াইয়া রইছস? ছায়া দেখা যায় কিন্তু রাও করস না ক্যারে? চেঁচিয়ে ওঠে নবীতুননেসা।

ধামসোনা আর রথখোলার মাঠ ছাপিয়ে চৈত্রের বাতাসের দপদপানি ছোটে ঘোড়ার খুরের শব্দের মতো। বাতাসের সাথে পাল্লা দিয়ে জোছনার খলবলানি ওঠে অবিরাম। আসমানের আদম সুরত নিচে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু উঠোনের কোণায় কোনো সুরত দেখা যায় না জোছনার আলোয়। কেবল ভাঙা ভাঙা ডাক আসে, চাচী আমি ইব্রাহিম।

রচনাকাল : আগস্ট ২০২২, ঢাকা

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়