প্রকাশ : ০৪ জুলাই ২০২২, ০০:০০
-তোমাকে কল করেই পাই না, ম্যাসেজ বক্স মনে হয় খুলেই দেখো না। বুঝি না তুমি কি ব্যস্ত, নাকি?
-প্লিজ নিখিলেস রাগ করো না, কাজে ব্যস্ত বলেই মোবাইল সাইলেন্ট করে রাখি। যখন একটু সময় পাই ইচ্ছে করে হাত-পা ছেড়ে দিয়ে একটু রেস্ট নিই।
-ঠিক আছে আর কৈফিয়ত দিতে হবে না। বলো কেমন আছো?
-হ্যাঁ ভালো আছি। তুমি কেমন?
-আমায় যেমন রেখেছো ঠিক তেমনি।
-আমি তো ভালোই রাখতে চাই। ভালো কথা, নিখিলেস আমি একটা জরুরি কাজে ব্যস্ত থাকবো। তুমি খুদেবার্তা দিও। আমিও দিব, তবে কথা হবে না।
-তো মহারাণী, আপনার ব্যস্ততা কতদিনের।
-বেশি না, মাত্র তিন মাসের।
-আমাকে কি বলা যায় কী নিয়ে এত ব্যস্ততা। না থাক, জোর করছি না বলতে।
-জোর নয় নিখিলেস, আমি এখন বলতে চাই না। সময় হলেই জানতে পারবে, আর তুমিই জানবে সবার আগে।
-ওকে মহারাণী, তবে আমায় ছেড়ে চলে যেও না। তুমি আছো, এটাই আমার অনেক।
এইভাবে কথা বলে মোবাইল রেখে দেয় নিখিলেস আর রুনা।
পুরো তিন মাস পার হয়ে যায়। এর মাঝে কেউ কারো সাথে কথা বলেনি। মাঝে মাঝে মাঝে খুদেবার্তা দিয়েছে দুজন দুজনকে। আর যাই হোক এইটুকু জানে তারা দুজন ভালো আছে। ঠিক আছে। দুজন দুজনের আগের ঠিকানায় আছে।
‘নিখিলেস আমার কাজটা এই মাত্র শেষ করেছি, সময় করে কল দিও। কতোদিন কথা নেই, তুমি কেমন আছো? আমি আছি সেই আগের মতো’।
খুদেবার্তাটা লিখে নিখিলেসের মোবাইলে সেন্ট করে দিয়ে রুনা ওয়াশ রুমে যায় গোসল করতে। এখন বেলা দুইটা বেজে সতের মিনিট। ওয়াশ রুমের জানালাটা পশ্চিম দিকে। পাশের জায়গাটা খালি বলে পুরো আকাশ দেখা যায়। শুধু আকাশ বললে ভুল হবে, পুরো চাঁদ, চাঁদের জোছনা, পুরো সূর্য আর সূর্যের আলো।
মনটা খুব ফুরফুরে লাগছে, ভাঙ্গা গলায় গান ধরে রুনা-
তুমি আমার ঘুম, তবু তোমায় নিয়ে স্বপ্ন দেখি না-
তুমি আমার সুখ, তবু তোমায় নিয়ে ঘর বাঁধি না-
প্রথমে মডার্ন ঝর্ণাটা ছেড়ে শরীরটা হালকা ভিজিয়ে নেয়। আলতো হাতে পুরো শরীরে সাবান মেখে আবার ঝর্ণা ছাড়ে।
বাহির থেকে আসা রোদের মাঝে ঝর্ণার পানির ছিটা পড়ছে রুনার শরীরে। যেনো মুক্তোর দানা ছিটাচ্ছে কেউ। নিজেকে অন্য রকম মনে হয় রুনার।
ইচ্ছে মতো পানি দিচ্ছে শরীরে। নিখিলেসকে নিয়ে অনেক ভাবনাই আসে। কিন্তু কঠিন এক বাস্তবতার মাঝে নিজের সব স্বপ্নকে গলা টিপে হত্যা করে রুনা। গুন গুন করে গানের মাঝে ভাবে, নিশ্চয়ই ঠিক সময়ে ওর কাছে কল আসবে। ওয়াশ রুমে থেকেও কোথায় যেন হারায়-
গানের মাঝেই মনে পড়ে ওর কাজের কথা। পুরো তিন মাসের পরিশ্রম রুনার। যতটা পেরেছে নিজের শেষটুকু দিয়ে করেছে। রুনা জানে ভালোর কোনো শেষ নেই, তবুও নিজের কাছেই মনে হচ্ছে খুব একটা খারাপ করেনি। মুহূর্তে কোথায় যেনো হারিয়ে যায়।
-হ্যালো মিস রুনা ইয়াসমিন বলছেন ?
-জ্বি, রুনা বলছি,আপনি?
-আমি শওকত জামিল, আপনার পাঠানো কাজটা হাতে পেলাম। আমাদের সবার খুব পছন্দ হয়েছে।
রুনা কিছুটা অপ্রস্তুত ছিলো এই মুহূর্তে কোন কল রিসিভ করার জন্যে। মোবাইলে শুধু জ্বি জ্বি বলে চুপ করে আছে।
-ম্যাডাম, আপনি শুনতে পাচ্ছেন ?
হ্যালো, হ্যালো-
-জ্বি, শুনতে পাচ্ছি।
-ম্যাডাম আপনি সময় করে একবার অফিসে আসুন, সব বিষয় নিয়ে ফাইনালি কথা বলা দরকার। আপনি সময়টা জানিয়ে দিবেন। সেই সময়ে আমরা সবাই থাকব।
একদিন পর রুনা ভালো দিন দেখে সময় জানিয়ে দেয়, সে ভাবেই আয়োজন করে জামিল সাহেব। রুনা যায়, সবার সাথে ওর পরিচয় হয়। মাত্র ১৪/১৫ দিন পর থেকেই রুনার কাজটা সবার সামনে আসবে। অফিস থেকে পজিটিভ কথা পেয়েছে বলে সব ভালো তা মেনে নিতে রাজি নয় রুনা। সাধারণ মানুষগুলো কীভাবে নিবে, বা গ্রহণ করবে কাজটা তা-ই দেখার বিষয়।
চারপাশে রুনাকে নিয়ে সমালোচনা। এই কাজ রুনাকে সবার কাছে জনপ্রিয় করে তুলছে। শওকত সাহেব নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে রুনার সাথে।
-ম্যাডাম আপনাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হবে না। এখন পুরো সময় আপনার। আপনি শুধু সামনে এগিয়ে যাবেন।
-আপনাদের সহযোগিতা না থাকলে হতো না। আমি চেষ্টা করেছি কাজটা করার।
-সুসংবাদ ম্যাডাম রুনা। এই বছরের সেরা স্থান অর্জন করেছে আপনার কাজ। আপনি হলেন প্রথম স্থান অধিকারিণী। খুব তাড়াতাড়ি আপনার কাছে সব রিপোর্ট যাবে। বিশাল আয়োজন হচ্ছে চীনমৈত্রী সম্মেলনে।
স্টেজে বসে আছে রুনা, তার দুই পাশে দেশের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা। রুনা আগেই বলে দিয়েছে ওর পাশের সিটে থাকবে ওর মা। সেভাবেই স্টেজ সাজানো হয়। একের পর এক রুনাকে নিয়ে অনেক কিছু বলছেন বিশিষ্টজনেরা। ফুলের তোড়া দিয়ে রুনাকে বরণ করে নিচ্ছেন সবাই।
সঞ্চালক ঘোষণা করেন-
-এখন আমাদের সামনে কিছু বলতে আসছেন রুনা ইয়াসমিন। আমরা তার মুখে শুনবো তার নিজের কথাগুলো।
রুনা ধীর পায়ে হেঁটে যায় ডায়াসের দিকে নিজের কথাগুলো বলতে। ওর সামনে বসে আছে শত শত ভক্ত শুভাকাঙ্ক্ষীরা, যারা অপেক্ষায় আছে রুনার মুখে কিছু শোনার জন্যে।
জীবনের অনেক কথাই আজ বলবে রুনা। কবে কী ভাবে সে এই কাজে আসে, কার সহযোগিতায় সে আজ এই মঞ্চে ডায়াসের সামনে। কে সাহস দিয়েছে বন্ধুর মত, কষ্টের সময় কে ছিলো পাশে, রুনার আনন্দে কে হেসেছিল, সব সব আজ বলার সময় এসেছে।
শত শত দর্শকের মাঝে চুপ হয়ে বসে আছে নিখিলেস। নিখিলেস নামটা উচ্চারণ করেই এর দিকে তাকায়, রুনা নিজেই বলে- -আজ আপনাদের সবার সাথে এখানে নিখিলেসও বসে আছে।
ভক্তরা সবাই এদিক ওদিক খোঁজে, কে সেই নিখিলেস, যে কিনা রুনার সাথে এইভাবে অদৃশ্য হয়ে মিশে আছে। নিখিলেস কিছুই বলে না। কেউ চিনতে পারে না নিখিলেসকে, কারণ এই নামে কেউ তাকে চিনে না।
রুনা তার মাকে নিয়ে অনেক কিছু বলেছে। মা সন্তানের জন্যে সব সময় দুহাত তুলে দোয়া করে। সময় গড়িয়ে যায়, অনুষ্ঠান প্রায় শেষ। সবাই যার যার মতো বিদায় নিচ্ছে। অনেকে স্টেইজে এসে রুনার সাথে ছবি তুলছে, রুনা একটু একটু করে নিখিলেসকে খোঁজে।
কোথাও নেই নিখিলেস। নিশ্চয়ই কল করা উচিত, চারপাশে এত লোকজন, কী ভাবে কল করবে ? হঠাৎ রুনার মোবাইলে খুদেবার্তা আসার রিং টা বেজে উঠলো। পার্স থেকে মোবাইল বের করে দেখে নিখিলেস-এর খুদেবার্তাণ্ড
‘প্রিয় রুনা, আমি জানি আজ তুমি খুব খুশি, তবে স্টেইজে আমার কথা না বললেই পারতে, আমি তো আছি, আমি থাকবো তোমার অদৃশ্য এক বন্ধু হয়ে, ভালোবাসার মানুষ হয়ে, ছায়া হয়ে। তুমিই বলো জীবনে সবাই কি দৃশ্যমান হয়ে থাকতে পারে?’
খুদেবার্তাটা পড়ে নিখিলেসকে কল করার জন্যে নাম্বার টা বের করে, ঠিক সেই সময় রুনার মোবাইলে বেজে উঠে-----
‘তুই যদি আমার হইতিরে বন্ধু আমি হইতাম তোর-----’
নাম দেখতে হয় না, এটা নিখিলেস-এর কল, ওর কল আসলেই এই গানটা বেজে উঠে। গানের শব্দে রুনা কল্পনার জগত থেকে বাস্তবে ফিরে আসে। ওয়াশ রুমের দরজা টা ফাঁক করে টাওয়াল মুড়িয়ে মোবাইলটা ধরে।
-হ্যালো নিখিলেস আমি ওয়াশরুমে, বের হয়ে কল দিচ্ছি।
লেখক : সাহিত্যিক, কলামিস্ট ও প্রাবন্ধিক।