প্রকাশ : ২১ জুন ২০২২, ০০:০০
রবীন্দ্রনাথ : ধর্ম প্রকৃতি প্রেম ও সাহিত্যের আধুনিকায়ন
সামীম আহমেদ খান
প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী ‘রোমান্টিক’ শব্দটির আবির্ভাব হয়েছে ফরাসী শব্দ ‘রোমাঞ্চ’ থেকে। এর অর্থ হলো লাতিন শব্দের পরিবর্তে গ্রাম্য কথ্যভাষায় রচনা করা। ১৭৪৮ সালে রোমান্টিক শব্দটি একাডেমী কর্তৃক স্বীকৃত হয়। এক অর্থে স্প্যানিশ একটি ছন্দের নাম ‘রোমাঞ্চ’। রোমান্টিক শব্দের মধ্যেই নিহিত রয়েছে তার স্বরূপ। রোমান্টিক ভাষার মধ্যে প্রাণ-প্রাচুর্যের কল-কল্লোল ও কলরব শোনা যায়। অর্থাৎ ভাষা তার অলঙ্করণে সজ্জিত হয়ে আড়ষ্টতা থেকে মুক্তি পায়। প্রচলিত ছন্দের বন্ধন ভেঙ্গে ছন্দের নব নব সৃষ্টি ভাষাকে করে তোলে চঞ্চল, প্রবহমান ও গতিমুখর।
|আরো খবর
বাংলা সাহিত্যের রোমান্টিক গাঁথা কাব্যের অন্যতম প্রবর্তক অক্ষয়চন্দ্র চৌধুরী ছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের বন্ধু ও দ্বিজন সভার মধ্যমণি। রবীন্দ্রনাথ ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি অক্ষয় চৌধুরীর সান্নিধ্যে আসেন। তাঁরই প্রেরণায় রবীন্দ্রনাথ বালক বয়সে সেকালের ইংরেজি কবিতা বাংলায় অনুবাদ করেন। তিনি ছিলেন রবীন্দ্র প্রতিভার একজন সহৃদয় আলোচক ও অন্তরঙ্গ উৎসাহদাতা।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের গীতিময় জীবনের বিশুদ্ধ সৌন্দর্যবাদী অভিজ্ঞান তাঁর চিত্ত-চেতনা ও সংস্কারে যে দূর সঞ্চারী প্রবর্তনা এনেছিলো তা আমাদের বাংলা সাহিত্যে এক গভীরতম প্রাণের উচ্ছ্বাস।
১৯১৩ সালে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন তাঁর সৃজনশীল সাহিত্য কর্মের জন্য নোবেল পুরস্কার পেলেন, তখন তিনি ছিলেন পাশ্চাত্যে প্রায় অপরিচিত। পাশ্চাত্যের সাহিত্যজগত তখনও কবি রবী ঠাকুরের সাহিত্য কর্মের সাথে পরিচিত হয় নি। এমনকি তাঁর নামটি বড় সংবাদপত্রগুলো ঠিক করে লিখতে পারেনি। কোনো কোনো বহুল প্রচারিত সংবাদপত্র ‘রবীন্দ্রনাথ’ নামের পরিবর্তে লিখেছিলো ‘বাবীন্দ্রনাথ’ এমনকি ‘হিন্দু কবি’ ‘অশ্বেতাঙ্গ’ এসব শব্দ ব্যবহার করে চমক সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছিলো। নোবেল পুরস্কার ঘোষণার পর পরই ‘The New York Times’ ১৯১৩ সালের ১৪ নভেম্বর ঠিক এভাবে লেখে : NOBEL PRIZE GIVEN TO A HINDU POET. This years literature award conferred on Babindranath Tagore of Bengal. Created a furore in Europe.
এটি বিস্ময়কর হলেও সত্য যে, সমগ্র ইউরোপ ও আমেরিকায় কবি রবীন্দ্রনাথ অপরিচিত থাকলেও সুইডিশ সোসাইটিতে তিনি অপরিচিত ছিলেন না। ১৯১১ সালের শুরু থেকেই সুইডিশ সোসাইটি তাঁর সাহিত্য বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করে। আবার দুঃখজনক হলেও সত্যি, ১৯৬৪ সালের পর থেকে রবীন্দ্রনাথের কোনো সাহিত্যকর্ম আর সুইডিশ ভাষায় প্রকাশিত হয়নি। বিশিষ্ট কোনো সুইডিশ লেখক বা সুইডেনে বসবাসরত বাঙালিরাও এরকম কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেননি। কিন্তু আমাদের বাংলা সাহিত্যে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের সংবেদনশীলতা, কল্পনাবৃত্তির নিগূঢ়তা, উদ্ভাবন ক্ষমতা ও অনুভূতির অন্তর্মুখিতা রোমান্টিক জীবন দৃষ্টিসম্পন্ন।
১৯ শতকের ইংরেজি সাহিত্যের রোমান্টিক সৌরজগতের অন্যতম কবি শেলী। মসৃণ ছিলো না তাঁর জীবনের গতিপথ। দুস্তর প্রস্তরময় সমাজের কঠিন মৃত্তিকার ওপর দিয়ে তিনি জীবনের যাত্রা শুরু করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের আবির্ভাবও ঊনিশ শতকের নবজাগরণের শিল্পগৌরবে দীপ্তালোকে উদ্ভাসিত। যখন ইংরেজি সাহিত্যের রোমান্টিকতার প্লাবন বয়ে যাচ্ছে, ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলার নবজাগরণের কর্মীপুরুষ রামমোহন রায়ের বিশুদ্ধ ব্রাহ্মধর্ম সম্পর্কে শিষ্যত্ব বরণ করেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি হিন্দু ধর্মের বাহ্য আচার-আচরণ আর প্রাণহীন প্রথার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন। হিন্দু ধর্মের নিষ্প্রাণ হৃদয়হীন আচারের নির্দয়-নিষ্ঠুরতাকে উপেক্ষা করে তিনি প্রাচ্যের বিশ্বমানব প্রেম ধর্মকে পাথেয় করেছিলেন। তাই রবী ঠাকুর বলেছেন, ‘আমার পরিবার আমার জন্মের পূর্বেই সমাজের নোঙর তুলে দূরে বাঁধা ঘাটের বাহিরে এসে ভিড়েছিলো। আচার-অনুশাসন, ক্রিয়া-কর্ম সেখানে সমস্তই বিরল।’
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ধ্যান সৃষ্টির জীবন চেতনায় দেবেন্দ্রনাথ ছিলেন অগ্রণী ভূমিকায়। শান্তম, শিবম, সুন্দরম সাধনায় রবীন্দ্রনাথের সিদ্ধিলাভ হয়েছিলো মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের নির্দেশে। তাই রবীন্দ্রনাথের যৌবনধর্মে কোথাও অসংযত ভাবাবেগের প্রকাশ নেই।
কিন্তু শেলী সমাজের অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন। নতুন সৃষ্টির অদম্য নেশায় পুরাতনকে অস্বীকার করেছেন। ধর্মতন্ত্রের সামাজিক বিধি-নিষেদের প্রতি তাঁর ছিলো তীব্র অনীহা এবং এক পর্যায়ে তিনি বিদ্রোহ করেছেন। আঘাত করেছেন ইউরোপীয় সমাজের অচলায়তনকে। অস্বীকার করেছেন ঈশ্বরের স্বীকৃতিকে। কিন্তু ইংরেজ সমাজ শেলীকে ক্ষমা করেনি। ‘নাস্তিক’ আখ্যায় ভূষিত করে শেলীকে ইংল্যান্ডের মাটি থেকে বিতাড়িত করে নির্বাসন দিয়েছিলো তৎকালীন সঙ্কীর্ণ বুদ্ধির পরিচায়ক ইংরেজ সমাজ। কবি রবীন্দ্রনাথ শেলীর মতো চিরায়ত প্রথার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হতে পারেননি। কেননা আধ্যাত্মিক সাধনায় কবিকে দুঃসাহসিকতার পরিবর্তে চিন্তাশীল হতে বাধ্য করেছে। দুর্জয়ের জয়মাল্য কবির জ্ঞানলোকের পরিধিকে যতই পুষ্পার্ঘ্যে পূর্ণ করুক না কেনো তবু রুদ্র সন্ন্যাসী শ্মশানের বৈরাগ্যবিলাসী। তাই রবীন্দ্রনাথ হিন্দুধর্মের তথাকথিত প্রাণহীন আচার অনুষ্ঠানকে আঘাত হেনেছেন, কিন্তু ধর্ম বা ধর্মতন্ত্রের বিরুদ্ধে নয়।
রবীন্দ্রনাথের প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য, সসীম ও অসীম, খণ্ড ও অখণ্ড, বিশেষ ও নির্বিশেষ, স্থায়িত্ব ও অস্থায়িত্ব, অহং ও আত্মা, স্বাতন্ত্র্য ও মিলন, সংসার-অনুরাগ ও সংসার বিরাগ এবং প্রাপ্তি ও ত্যাগ তথা সামাজিক ও আধ্যাত্মিক সকল বিষয়ে যে অন্তরঙ্গ মিল খুঁজে পাওয়া যায় তা রবীন্দ্র বোধের চালিকাশক্তি এবং আমাদের প্রকাশরীতির আলাদা আলাদা ক্ষেত্র।
ঊনবিংশ শতাব্দীর ইংরেজি সাহিত্যের রোমান্টিক যুগের মধ্যাহ্নক্ষণে সে যুগের সর্বকনিষ্ঠ কবি জন কীটস-এর আবির্ভাব। ১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দে ২৯ অক্টোবর এক দরিদ্র পরিবারে কীটসের জন্ম। জন্মের পর থেকেই তার চারদিক ঘিরে দুঃখের জমাট আঁধার। কীটস আত্মশক্তির অন্তর্গত প্রেরণাকে সৌন্দর্য সৃষ্টির মূলমন্ত্র মনে করেন। ফরাসী বিপ্লবের কোনো প্রভাব কীটসের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়নি। তিনি নবজাগরণের বৈপ্লবিক পরিবর্তন সৃষ্টি করেছেন আত্মশক্তির মহিমায়। কিন্তু সমাজ সংস্কারে তাঁর তেমন প্রভাব নেই। তিনি কোনো দর্শনকে কাব্যের মধ্যে প্রচারমুখী করতেন না। অপরদিকে রবীন্দ্রনাথ সামাজিক গতি চেতনায় উদ্যমশীলতা, আত্মবিশ্বাস, নব্য সাংস্কৃতিক রুচিবোধ, বাঙালি মানসের জ্ঞান, কর্ম ও বিশুদ্ধ বুদ্ধিস্রোতে হৃদয়বৃত্তি তথা ভাবসম্পদকে সৌন্দর্য সৃষ্টির মূলমন্ত্র মনে করেন। রবীন্দ্রনাথ একটি শতাব্দীর জীবনের কাল-মহাকাল দেখেছেন। তাই তাঁর চেতনালোকে অভিজ্ঞতার পরিধি অসীম ও ব্যাপক এবং তাঁর সৃষ্টিও গভীর ও সীমাহীন।
কীটসের জীবন রবীন্দ্রনাথের মতো দীর্ঘ নয়। বাংলার ক্ষণজন্মা কবি সুকান্তের মতোই কীটস মাত্র ২৫ বছরের আয়ুষ্কালে জীবনের এক নিখুঁত সত্যকে আবিষ্কার করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ কীটসের মতো প্রেম ও রোমান্টিকতার অন্ধ আবেগে নিজেকে সঁপে দেননি। কবিগুরু বলেছেন, ‘এরা সুখের লাগি চাহে প্রেম, প্রেম মেলে না, শুধু সুখ চলে যায়, এমনি মায়ার ছলনা।’ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের মধ্যে অত্যন্ত প্রগাঢ় যে সত্যটুকু বিরাজমান তা হলো তিনি বর্তমানের কবি এবং তিনি সচেতনতার কবি। বর্তমানকে তিনি মর্যাদা দিয়েছেন। ফলে অস্পষ্ট অতীত তার ক্ষণকালের ছায়া ফেলেছে মাত্র তাঁর অন্তর্লোকের সীমানায়। তিনি পরিপূর্ণ অতীত হতে পারেননি বা হননি। কবি বলেছেন :
‘আপাতত এই আনন্দে গর্বে বেড়াই নেচে কালিদাসতো নামেই আছেন আমি আছি বেঁচে।’
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ মানবপ্রেমের চারণ কবি। প্রকৃতিকে এক অন্তর্নিহিত নির্যাসশক্তি সৃষ্টিকর্তা দান করেন, যা পার্থক্য স্পষ্ট করে জড় বস্তু থেকে। জড় বস্তুর প্রকৃতি আদি-অনাদি একইরূপে প্রকাশিত। প্রকৃতির সৃষ্টিশীল ক্ষমতা নেই। মানুষ তার সৃষ্টিতে অমর। কবি বলেছেন :
‘পাখিরে দিয়েছো গান, গান সেই গান,
তার বেশি করে না সে দান
আমারে দিয়েছো স্বর, আমি তার বেশি
করি দান
আমি গাহি গান।’
বাংলার ঋতু পরিক্রমায় রবীঠাকুরের রোমান্টিকতার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। প্রকৃতির সবকিছু খুঁটে খুঁটে নিবিড় আত্মীয়তা সৃষ্টি করা মানুষের পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠে না, তবুও কবি জন্ম রোমান্টিক। দখিনা বাতাস, ফাগুনের আগুনমম, কোকিলের কুজন, পিয়ালের ছায়ায় পূর্ণিমা তিথি কবির অন্তরের গভীর দুয়ার যে রঙে রাঙিয়ে দিয়েছে তারই লালিমা স্মরণে কবি গাইলেন :
‘তব আমি জন্ম রোমান্টিক
আমি যেই পথের পথিক
যে পথ দেখায়ে চলে দখিনা বাতাসে
পাখির ইশারা যায় যে পথের অলক্ষ্য
আকাশে’।
লেখক : সভাপতি, বঙ্গবন্ধু লেখক পরিষদ, চাঁদপুর জেলা শাখা।