প্রকাশ : ০৬ জুন ২০২২, ০০:০০
রবীন্দ্রোত্তর বা ত্রিশোত্তর (১৩৩০ বঙ্গাব্দ) বাংলা কবিতা ভিন্নরূপ নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে। প্রখ্যাত প্রাবন্ধিক আবু সায়ীদ আয়ূবের মতে, ‘কালের দিক থেকে মহাযুদ্ধ পরবর্তী এবং ভাবের দিক থেকে রবীন্দ্র প্রভাব মুক্ত, অন্ততঃ মুক্তিপ্রয়াসী’ কাব্যই আধুনিক কাব্য। ত্রিশোত্তর এ আধুনিক কাব্যে ভাব, দর্শন, কাব্যশৈলী ও প্রকরণগত দিক দিয়ে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন দেখা দেয়। রবীন্দ্র নাথের ভাব, দর্শন, কাব্যশৈলী ও আঙ্গিকের পরিবর্তন করে রবীন্দ্রোত্তর কবিগণ নবধারা তথা বাংলা সাহিত্যে একটি বিশেষ যুগের সৃষ্টি করেন। এ ধারার সম্মানিত কবিবৃন্দের মধ্যে কবি জীবনানন্দ দাশ অন্যতম।
রবীন্দ্র-সাহিত্যের শান্ত সমাহিত কল্যাণকামী আদর্শকে অস্বীকার করে এ ধারার কবিবৃন্দ অগ্রসর হতে চেয়েছিলেন সৃষ্টির নূতন পথে। ‘শিল্প শিল্পের জন্যেই’ এ তত্ত্বই তাঁদেরকে জাগরিত করেছিলো। আর এঁরা বিশেষভাবে সচেষ্ট ও সক্রিয় ছিলেন জীবনের অবসাদ, হতাশা, যৌনতা, নিঃসঙ্গতা, অবক্ষয়, দারিদ্র্য, পরাজয়, বিকৃতি, ক্লেদ, গ্লানি ও অস্বাভাবিকতাকে সাহিত্যের মধ্য দিয়ে শিল্পায়িত করে প্রকাশ করতে। ভাবগত দিক থেকে এঁদের মানসলোকে এবং কাব্যে ফ্রয়েডীয় প্রভাব, মার্ক্সীয় চিন্তাধারা ও আইনস্টাইন প্রমুখ আধুনিক বিজ্ঞানীদের প্রভাব, প্রথাগত নীতি ধর্মে অবিশ্বাস এবং রবীন্দ্র ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে সচেতন বিদ্রোহ পরিলক্ষিত হয়।
কবিরও আছে দেশকালের সীমাবদ্ধতা। তাঁর প্রোথিত মূল সমকালে তবুও তারই মধ্যে তিনি সমাপ্ত নন। বর্তমানে দাঁড়িয়ে তিনি রচনা করেন অতীত ও ভবিষ্যতের সেতুবন্ধ। তিনি প্রগতির সপক্ষে, মানুষের সপক্ষে। তিনি মূলত স্বাদেশিক ফলত বিশ্ব নাগরিক। কবি জীবনানন্দ দাশের জন্ম ও মৃত্যু শহরে হলেও তিনি যেনো ‘রূপসী বাংলার’ আঁচল ধরেই বড় হয়ে ওঠেন। নারিকেল ও সুপারী গাছের কুঞ্জ দিয়ে ঘেরা ভিটায়, মাছের চোখের মতো ঝকঝকে স্বচ্ছ জলের ছোট্ট পুকুর আর পরিচ্ছন্ন আঙ্গিনাকে নিয়ে আধা শহুরে আধা গ্রামীণ পরিবেশে ছোট্ট গোলপাতায় ছাওয়া ঘরে তাঁর জীবনের বেশির ভাগ সময় অতিবাহিত হয়েছিলো। কলিকাতা মহানগরী কিংবা দিল্লী অথবা শিলং পাহাড়ে ছাত্রাবস্থায়, সাময়িকী সম্পাদক হিসেবে কিংবা অধ্যাপনার ব্যাপদেশে কিংবা নিছক হাওয়া বদলের সময় তাঁর ‘কবিরচোখ’ গভীর কৌতূহল আর বোধ নিয়ে পারিপার্শ্বিক সব কিছু অবলোকন করে মনোপুকুরে অনেক নৈসর্গিক ছবি জমা করেছিলো, তাঁর হৃদয়বীণায় ঝংকৃত হয়েছিলো অজস্র সুর। কিন্তু বরিশালের নিভৃত নিকেতনকে ঘিরে ছন্দিত ছিলো যে ‘রূপসী বাংলা’র সুভাসিত ছবি আর সুর, তাতেই বাঁধা ছিলো দুটি বড় বড় চোখ, বাঁধা ছিলো তার বিনম্র হৃদয় এবং কবি মানস।
বুদ্ধদেব বসুরা (প্রগতি গ্রুপ) দাবি করেছিলেন যে, জীবনানন্দ দাশের অবস্থান রবীন্দ্রনাথের সূর্যমণ্ডলের বাইরে। বিতর্কের পাত্র হওয়া আর জনপ্রিয় হওয়ার মধ্যে যে দুস্তর ব্যবধান রয়েছে, সে বিষয়ে তিনি ছিলেন সদা জাগরুক। তবে অপ্রিয় হলেও সত্য যে, বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে জীবনানন্দ দাশ এসেছেন পূর্বসূরি কবিদের হাত ধরে। তাঁর কবি-জীবনের প্রথম পর্যায়ে ‘ঝরা পালক’ (১৩৩৪)-এ সত্যেন্দ্রনাথ ও মোহিতলাল যদিও আছেন মূলত তা ছন্দ প্রতিধ্বনিতে, তবুও প্রধানত ঐ কালে তাঁর বক্তব্যে যে আশাবাদ এবং শব্দ ব্যবহারে যে মিশ্র সংস্কৃতির বাস্তবতার স্বীকৃতি, যেখানে বিশেষভাবে উপস্থিত প্রেমিক ও মানবতাবাদী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। নানা সুরের সাধনাই একজন কবির প্রস্তুতি পর্বের নীরব কাজ। এই নীরব কাজের পর্যায় পরিচিহ্নিত জীবনানন্দ দাশ-এর ‘ঝরা পালক’। কী ছন্দে, কী শব্দ ব্যবহারে! যেমন : ‘আমি কবি,-সেই কবি-সেই কবি/আকাশে কাতর আঁখি-তুলি হেরি ঝরা পালকের ছবি/.../স্বপন সুরার ঘোরে/সারাটি জীবন খেয়ালের খোশে পেয়ালা রেখেছি ভরে’।
‘ঝরা পালক’ কাব্যের ‘মরীচিকার পিছে’, ‘জীবন মরণ দুয়ারে আমার’, ‘ছায়া প্রিয়া’ প্রভৃতি কবিতায় তার বিষয়-বৈচিত্র্যে নির্বিশেষে আরবি-ফরাসি শব্দ ব্যবহার ও ছন্দ প্রয়োগ রীতিতে পূর্বসূরি কবিদের ঋণ অকপট জড়িয়ে আছে স্তবকগুচ্ছে ও চরণে চরণে। এ গ্রন্থের ‘হিন্দু মুসলমান’, ‘নিখিল আমার ভাই’ ও ‘বিবেকানন্দ’ কবিতায় যুগেরবাণী পূর্বসূরিদের ভঙ্গিতেই উপস্থাপিত।
ক) সন্ন্যাসী আর পীর/মিলে গেছে হেথা- মিশে গেছে হেথা মসজিদ, মন্দির! খ) নিখিল আমার ভাই/- কীটের বুকেতে যে ব্যথা জাগে আমিও সে বেদনা পাই।
তবে ‘ঝরা পালক’ পর্যায়ে আমরা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উচ্চারণ লক্ষ্য করি নজরুল অনুসারী ‘নব জীবনের লাগি’ কবিতায়।
- নব জীবনের লাগি’/প্রদীপ ধরিয়া আঁধারের বুকে আমরা রয়েছি জাগি/---/আমরা তাদের শস্ত্র, শাসন, আসন করিব ক্ষয়!/- জয় মানবের জয়।
মানবের জয়গানের এ উচ্চারণ নজরুল-অনুসারী হলেও তা তাঁর প্রস্তুতি পর্বের কবিতার উপসংহার। বিশ্বাসের এই উচ্চারণ তাঁর পরিণত কবিমানসের চূড়ান্ত পর্যায়কে উপলব্ধির জন্যে গুরুত্ববহন করে। ‘ঝরা পালকে’ই কবি জীবনানন্দ দাশ খুঁজে পাচ্ছেন তাঁর স্বতন্ত্র পথচিহ্ন। নজরুলকে ছুঁয়েই অলক্ষ্য বন্দর পানে ছুটে যাচ্ছেন কবি জীবনানন্দ দাশ। তিনি ‘জলবেদিয়া’ ‘সিন্ধু বেদুঈন’ এবং ‘অস্তচাঁদে’ কবিতায় বহু প্রাচীন সভ্যতা পরিক্রমা করেছেন। নিয়েছেন ‘অসীরীয় সম্রাটের বেশ’। বহু সভ্যতা, সংস্কৃতি ও কাল পরিক্রমার উপসংহারে কবির মনে পড়েছে-‘বাংলার মাঠেঘাটে ফিরেছিনু বেণু হাতে একা/গঙ্গার তীরে কবে কার সাথে হয়েছিল দেখা’।
শুধু অনুসরণই নয়, নিজেরও কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য এ সমস্ত কবিতায় পরিলক্ষিত হয়। তার কবিতায় পূর্বসূরিদের অনুকরণ বা অনুসরণের ছাপ থাকলেও তাতে নিজস্ব স্টাইলে যে চিহ্ন আছে, এটাই তাঁর কৃতিত্ব। নাটকীয়তা বিমুখ ভবিষ্যৎবাদী কবি বোধহয়, তাই তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থের নাম রেখেছিলেন ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’। ধূসর পাণ্ডুলিপির যে বিশ্বমনস্কতা তার পরোক্ষ অনুপ্রেরণায় আছেন বিশ্ববরেণ্য কবি লরেন্স, ইয়েটস্, পাউন্ড, এলিয়ট প্রমুখ। তবে এ কথা ঠিক যে, জীবনানন্দ দাশের জীবনের পরিপ্রেক্ষিত ছিলো একদিকে যেমন সুদূর অতীতে, তেমনি অনাগত ভবিষ্যতের কল্পলোকে নিবদ্ধ। তিনি কোনো জ্বলন্ত বিশ্বাসে রাজি ছিলেন না। হয়তো এ কারণেই তিনি তাঁর কাব্যিক জিজ্ঞাসার চারপাশে একটা অবিশ্বাসী মনোমণ্ডলকে স্থাপন করেছিলেন। বিংশ শতাব্দীর প্রথম মহাযুদ্ধে বিজ্ঞানের বিধ্বংসী রূপ তিনি দেখেছেন। মানুষের সভ্যতা সৃষ্টির প্রয়াস, শুধু বেদনারই জন্ম দিতে পারে। বিপরীত প্রকৃতিতে ইয়েটস্ নয়, রবীন্দ্রনাথ নয়, ভিন্নার্থে জীবনানন্দ দাশ অবিনশ্বরতা দেখছেন তাঁর ‘সেই দিন এই মাঠ’ কবিতায়। সোনার স্বপ্নের সাধ, সুপ্রিয় ভবিষ্যতের আকাক্সক্ষা এ পৃথিবীতে প্রকৃতিতে চিরকালীন। বিশ্বযুদ্ধের ক্ষত-বিক্ষত সময়ের রূঢ় বাস্তবতাকে কবি উপস্থাপন করেছেন হেমন্তের প্রতীকে। তাইতো কবির চোখে-‘ডাইনে আর বাঁয়ে/পোড়া জমি, খড়-নাড়া,মাঠের ফাটল/শিশিরের জল’।
জীবনানন্দ দাশ ত্রিশোত্তর কবিদের মধ্যে সর্বাধিক মাত্রায় প্রকৃতি সংলগ্ন কবি। প্রকৃতি আশ্রয়ী উপমা, রূপক ও চিত্রকল্পের সমন্বয়ে কবিতার বিষয় ভাবনাকে রূপময় করে উপস্থাপনার সঙ্গে সঙ্গে তিনি তাঁর গভীরতর আকাক্সক্ষা (কবিমানস)কে প্রকৃতির বস্তুগত মাত্রায় বিন্যস্ত করার প্রয়াস পেয়েছেন। তাঁর কবিতার বস্তুত প্রাকৃতিক উপাদান তথা প্রকৃতিকে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য করে তোলার প্রয়াস জীবনানন্দের প্রকৃতি চেতনার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। যেমন : ১) রোদের নরম রং শিশুর গালের মত লাল (অবসরের গান), ২) সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন/সন্ধ্যা আসে- (বনলতা সেন), ৩) আমি চলে যাব বলে/চালতা ফুল কি আর ভিজিবে না শিশিরের জলে/---/এশিরিয়া ধূলো আজ-বেবিলন ছাই হয়ে আছে।
বলাবাহুল্য, রূপসী বাংলার চিত্রাবলি কবির সমকালের নয়, এ তাঁর স্বপ্ন ও স্মৃতির নিসর্গ। ‘রূপসী বাংলা’ তাই কবির মানসলোকের শ্রুতি, স্মৃতি ও স্বপ্নোত্থিত। জীবনানন্দ দাশের কাছে প্রকৃতিই সর্বশক্তির আধার। প্রকৃতি বিনাশী সম্ভাবনাহীন সভ্যতার বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে কবি তাঁর মানসলোকে স্বপ্ন ও স্মৃতির প্রকৃতিতে খুঁজেছেন জীবনের প্রার্থিত আশ্রয়। এ গভীর আকাক্সক্ষার সূত্ররূপ তাঁর ‘রূপসী বাংলা’ কাব্য। ‘আবার আসিব ফিরে, ধান সিঁড়িটির তীরে এই বাংলায়/হয়তো মানুষ নয়, হয়তো বা শঙ্খচিল শালিকের বেশে/দেখিব ধবল বক, আমারেই পাবে তুমি ইহাদের ভিড়ে’- (আবার আসিব ফিরে)।
পুনর্জন্মে বিশ্বাসী কবি বাংলাতে আবার ফিরে আসতে চান তবে মানুষ হিসেবে নয়- শঙ্খচিল, কাক, হাঁস, পেঁচা ধবল বক বা প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদান হয়ে। বিখ্যাত ধানসিঁড়ি নদী, কার্তিকের নবান্ন, জামরুল হিজলের বন প্রভৃতি প্রাকৃতিক অনুষঙ্গের বিশিষ্ট ব্যবহারে ‘রূপসী বাংলার কবি’ জীবনানন্দ দাশ তাঁর হৃদয়ের অকৃত্রিম স্বপ্ন ও স্মৃতির নিসর্গকে মূর্ত করে তুলে সেই নিসর্গ সংলগ্ন জীবনের প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন। আর এ কারণেই কবির মহাকালস্পর্শী ও বিশ্ব ঐতিহ্য সচেতন জীবন চেতন পরিণামে প্রকৃতিনির্ভর।
আধুনিক কাব্যের মূলসুর ক্লান্তি ও মৃত্যু চেতনা। কবি জীবনানন্দ দাশের মানসলোকেও এর রেখাপাত পড়েছে। মৃত্যু চেতনা তাঁর কাব্যে প্রধানত দেহকে অবলম্বন করে প্রকাশ পেয়েছে। ‘বিভিন্ন কোরাসে’-আমরা মধ্যম পথে বিকেলের ছায়ায় রয়েছি/...সকালের আকাশের মতন বয়স’।
কবি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পেরেছেন তাঁর পরিচিত জগৎ নষ্ট হয়ে গেছে। কবি তাঁর কাব্যের ‘ক্যাম্পে’, ‘শিকার’, ‘আমি যদি হতাম’ প্রভৃতি কবিতায় বর্তমান যুগের মুনষ্যত্বহীন যান্ত্রিক রূপটির কথা বলেছেন। ব্যাঘ্র যুগে প্রেম, স্বপ্ন, সৌন্দর্য, সংগতি কোনো কিছুরই মূল্য নেই। এ রুচিহীন, সৌন্দর্যহীন, হৃদয়হীন যুগ জীবনানন্দ দাশের কবি মানসে বারংবার আঘাত দিয়েছে। তাই কবি আপন অনুভূতিশীল মনকে মৃত হরিণের সঙ্গে একাত্ম করে দেখেছেন। ‘বসন্তের জ্যোৎস্নায় অই মৃত মৃগদের মত/ আমরা সবাই’। (ক্যাম্পে)
কবি তাঁর মানসলোকে সদা-সর্বদা ইতিহাস-ঐতিহ্যকে লালন করেছেন। প্রথম থেকেই তিনি ছিলেন ইতিহাস সচেতন। ‘ঝরা পালক’-এর বিভিন্ন কবিতায় তা লক্ষ্য করা যায়। ‘দুর উর-ব্যাবিলোন-মিশরের মরুভূ সঙ্কটে/ কোথা পিরামিড তলে,- ঈসিসের বেদিকার মূলে’। ঝরা পালকের যুগে এই ইতিহাস চেতনা ধূসর পাণ্ডুলিপির যুগের মৃত্যু চেতনার মধ্যে লুপ্ত হয়ে যায়। ‘বনলতা সেন’-এ তার পুনরাবির্ভাব দেখে মনে হয়, কবি মৃত্যু চেতনাকে অতিক্রম করার জন্যই পুনরায় ইতিহাস চেতনাকে আশ্রয় করেছেন। কবি বলেছেন, ‘কবির পক্ষে সমাজকে বোঝা দরকার, কবিতার অস্থির মধ্যে থাকবে ইতিহাস চেতনা ও মর্মে থাকবে পরিচ্ছন্ন কালজ্ঞান’। যেমন : ‘চুলতার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,/মুখতার শ্রাবস্তীর কারুকার্য’। - (বনলতা সেন )
পৃথিবীর, সমাজের মানবতার গতি কোন্দিকে? মুক্তি কিসে হবে? এ প্রশ্ন তিনি বারংবার তুলেছিলেন এবং তাঁর কাব্যের মাধ্যমে উত্তর দেবারও চেষ্টা করেছেন। তিনি যেমন দেখেছেন বর্তমান জীবনের ক্ষয়িষ্ণু অসুস্থ রূপ এবং সীমাহীন অসঙ্গতি তেমনি খুঁজেছেন এক সুসঙ্গতিময় দিব্য জীবনের পথ।
‘এ পৃথিবীর রণ রক্ত সফলতা সত্য;/ তবু শেষ সত্য নয়’। এ কথা কবি প্রথমে আভাসে-ইঙ্গিতে এবং পরবর্তীতে দৃঢ় প্রতীতির সাথে বলেছেন।
ইমপ্রেশনিস্ট বিরোধী দ্বিতীয়ধারা চেয়েছিল চিত্রের মধ্যে একটা স্থাপত্যসুলভ ঘনত্ব প্রকাশ করতে (জগৎ বিখ্যাত চিত্রকর পিকাসো, গিস. ব্রাক প্রমুখ)। তাঁদের এ চিত্র আন্দোলনের প্রেরণা জুগিয়েছিল বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক আইনস্টাইনের ‘আপেক্ষিকতাবাদ’। এ হেন সময়ে ফ্রয়েড ও ইয়ং প্রমুখ মনোবিজ্ঞানীদের নিত্য নূতন আবিষ্কার চিত্রশিল্পীদের সামনে অবচেতন জগতের দ্বার খুলে দিল। ‘সুররিয়ালিজম’ এ ফ্রয়েডীয় মনোবিজ্ঞান থেকেই প্রেরণা লাভ করে। কিউবিস্টগণ জোর দিলেন আকৃতির বিন্যাসের ওপর আর সুররিয়ালিস্টগণ ডুব দিলেন মগ্ন চৈতন্যের গভীরে। ‘রূপসী বাংলার কবি’ জীবনানন্দ দাশ বাংলা কাব্যে ‘পরাবাস্তববাদ’ বা ‘সুররিয়ালিজম’-এর প্রবর্তক। তাঁর ‘নদীরা’, ‘হরিণেরা’, ‘শব’, ‘শ্রাবণ রাত’, ‘স্বপ্ন’ প্রভৃতি কবিতায় (ডিলান টমাসের দেয়া ব্যাখ্যানুসারে) উপমা, রূপক ও চিত্রকল্পের ব্যবহার ‘সুররিয়ালিজম’ আক্রান্ত, কিন্তু তাঁর কবিমানসের উর্বরতায় তাঁর কবিতা ‘সুররিয়ালিজম’ অতিক্রান্ত হয়েছে।
কবি জীবনানন্দ দাশ লৌকিক বাংলা কবিতার সুরে বিংশ শতাব্দীর সাধারণ মানুষের পদাবলি রচনা করেছেন। তাঁর এই বিশেষ রীতি ও সুরে অভিভূত হয়ে কালানুক্রমে এক সময়ে ভক্তবৃন্দ ব্যতিক্রম দাবি তুলেছিলেন। আর ভক্তবৃন্দের ব্যতিক্রম দাবি মেটাতে গিয়ে তাঁর মানসলোকে উদ্ভাসিত হয়েছিল ইচ্ছাকৃত বেসুরো কবিতাবলি। তাঁর বিরহ-বিচ্ছেদ পূর্ণতা দেয় না, বিধ্বস্ত করে দেহমন আত্মা। জীবনানন্দ দাশ সারাটা জীবন ধরে তাঁর হৃদয়লোকে সত্য, সমাজ সচেতনতা, ইন্দ্রিয় ঘনতা ও ইতিহাস চেতনাকে অনুসরণ এবং লালন করেছেন। কবি জীবনানন্দ দাশ-এর ভবিষ্যৎমুখী মানসলোক বহুমুখী হয়ে দিবাকর ও পূর্ণিমা¯œাত জ্যোৎস্নার মতো নিষিক্ত হয়ে রয়েছে তাঁর কাব্যের মধ্যে।
মোঃ নূর ইসলাম খান অসি : পরিচালক, ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি (সিপিপি), দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার; সভাপতি, বঙ্গবন্ধু পরিষদ, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি। মোবাইল ফোন : ০১৭১১-৫৮৫৮৭৫।