প্রকাশ : ১০ মে ২০২২, ০০:০০
স্রষ্টা তার সৃষ্টিকে আদিকাল থেকেই সৌন্দর্যমণ্ডিত করে রেখেছেন। যেমন একটি নবজাতক জন্মলগ্ন থেকেই বাহারি কেশপাশমণ্ডিত হয়েই ভূমিষ্ঠ হয়। এতে চারপাশের সবাই নবজাতকের এই সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে যায়।
সিনেমা অভিনেতাণ্ডঅভিনেত্রীদের চুলের সৌন্দর্য বর্ধন করে দর্শকদেরকে আকৃষ্ট করার রীতি অতীতে ছিলো, বর্তমানে আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। রমণীদের সৌন্দর্যের প্রধান আকর্ষণ হলো চিকুন বাঁধা-বেণী। নারী সৌন্দর্যকে মর্মস্পর্শী এবং মহিমান্বিত করার জন্যে লিউনার্দো দ্যা ভিনচির মানসকন্যা মোনালিসার কুন্তল ভাস্কর্যের বেণী আজও রহস্যাবৃত আছে।
অনুপম সৌন্দর্যমণ্ডিত বাংলার অন্যতম প্রকৃতিপ্রেমী কবি জীবনানন্দ দাশের সুন্দরী মানসকন্যা বনলতা সেন। কবির ভাষায় বনলতা সেনের চুলের যে মনোজ্ঞ বর্ণনা সাহিত্যে অমরত্ব লাভ করেছে তা হলো “বাংলার নীল সন্ধ্যায় কেশবতী কন্যা যেন এসেছে আকাশে” এবং “ভোরের সূর্যের আলো পৃথিবীর গুহায় যেমন মেঘের মতন চুল”।
চুলের শোভায় যে ভঙ্গিমায় বিশ্বকবি মেতেছিলেন তা হলো, “গ্রথিত মালতিমালা কুঞ্চিত কুন্তলে/ সোপানে সোপানে তীরে উঠিলা রূপসী/¯্রস্ত-কেশভার পৃষ্ঠে পড়ি গেল খসি”।
যে সমস্ত কেশবতী রমণীর চুলের সৌন্দর্যে পুরুষরা উন্মাদনায় বিগলিত হয়ে যায়, তা হলো কোকরানো চুল/মাজা পর্যন্ত প্রলম্বিত চুল/ললাটের অর্ধাংশ বিস্তৃত শিরোজ আর বড় খোঁপা। এ যেন অন্যের আকৃষ্ট হওয়ার প্রতীক।
নারীর বেণী বাঁধা ‘কচে’র অলৌকিক সৌন্দর্য কার মন কেড়ে নেয়নি তাকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। পূর্ণ দাশ বাউলের একটি গানে বর্ণিত আছে “আমার যেমন বেণী তেমনি রবে ভিজাবো না।”
পশ্চিমা লোক কাহিনীতেও সুকেশীদেরকে বীরের প্রতীক হিসেবে দেখানো হতো এবং লম্বা লম্বা চুল ওয়ালাদেরকে দিয়ে মল্ল-যুদ্ধ করে সমস্যার সমাধান করা হতো। এ ধরণীতে প্রবর্তিত এবং প্রচলিত সকল ধর্ম যাজকেরই লম্বা লম্বা চুল এবং সুদর্শন শ্মশ্রুমণ্ডিত ছিল। এতে প্রতীয়মান হয় যে, চুল-দাড়ি অবশ্যই স্রষ্টার আশীর্বাদ।
মানব কুন্তল যে যৌবনের প্রতীক, সৌন্দর্যের প্রতীক এবং বীরত্বের প্রতীক এতে সন্দেহের বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই। আবার লম্বা চুলওয়ালা শ্মশ্রুমণ্ডিত চেহারার লোক গুরু গম্ভীর ভাবমূর্তির বাহন।
আমাদের বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা ৮-৯ মাস সেলুন চোখে দেখেনি। দেখেছে এবং শুনেছে শুধু যুদ্ধের দামামা। ফলে বীর মুক্তিযোদ্ধারা অনেকেই ছিল লম্বা কুন্তলী এবং বদনভরা শ্মশ্রুমণ্ডিত।
আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের বাবরী চুলের বাহার আর বিশ্বকবির দীর্ঘ শ্মশ্রু আবৃত মুখের অনাবিল সৌন্দর্য কাকে মোহিত না করে! কারণ দীর্ঘ শ্মশ্রু এবং বাবরী চুল স্বাতন্ত্র্য এবং আভিজাত্যের দ্যোতক। (সূত্র : বাংলাদেশ প্রতিদিন ১৪-০৬-২১)
চুলপূর্ণ মাথা যদি চুলশূন্য মাথা হয়, তাণ্ডই টাকো মাথা। কারণ যা-ই হোক, টাকো মাথার দিকে অন্যরা একটু আড় চোখেই তাকায়। তাই সচেতন টাকোরা পরচুল ব্যবহার করে দুধের স্বাদ ঘোলাজলে মিটায়।
রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজারও ছিলেন টাকো মাথা। তিনি পরচুলার ওপর মুকুট পরতেন। জুলিয়াস সিজার যে সব দেশ আক্রমণ করে পরাজিত করতেন সেসব দেশের সুন্দরী নারীদের চুল নিজ দেশে নিয়ে এসে পরচুলার চাহিদা পূরণ করতেন।
এবার আসতে হয় চুলাচুলিতে। প্রাচীন বাংলার অটুট ভ্রাতৃত্ব বোধ, সহমর্মিত্ব বোধ এবং আন্তরিক আতিথেয়তার প্রবণতা ক্রমশ বিলুপ্ত হয়ে চুলাচুলির মধ্যে ঢুকে গেল। একান্নবর্তী পরিবার এবং পারস্পরিক সহমর্মিতার ঐতিহ্য বিলুপ্ত হয়ে চুলাচুলি একদা ঢুকে গিয়েছিল রাজনীতিতে। যা ‘ওয়ান ইলেভেন’ নামে খ্যাত। যে চুলাচুলিজাত দুর্নীতির উকুন জাতিকে অস্থির করে ফেলেছে। চুলাচুলির কারণে একান্নবর্তী পরিবারকেন্দ্রিক বন্ডেজ ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে। ফলস্বরূপ বৃদ্ধ-অসমর্থ পিতামাতার স্থান হয়তো বৃদ্ধাশ্রমে নিরূপিত হবে।
এরপর এসে যায় চুলচেরা হিসাবের কাহিনী। এক সময় এদেশে বিচারকদেরকে পরচুলা সম্বলিত একটা বিশেষ পোশাক ব্যবহার করানো হতো, যাতে পেশার স্বাতন্ত্র্য এবং আভিজাত্য ফুটিয়ে তোলা হতো। ফলে অপরাধীদের মনে একটা বিশেষ আতঙ্ক ঢুকে যেতো। এতেই চুলচেরা বিচার পাওয়া যেতো। আবার পরস্পর বিরোধীয় সম্পত্তির মধ্যে এক পক্ষ অপর পক্ষকে হুমকির ভাষা হলো, ‘এক চুল সম্পত্তিও ছাড়া বা রাখা যাবে না’। কাজেই চুল উপাখ্যান কত যে জটিল তা সহজেই অনুমেয়।