প্রকাশ : ০৪ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
বিদআত কী?
বিদআত হচ্ছে একটি উদ্ভাবন যা ইংরেজিতে বলে innovation. বিজ্ঞ আলেমদের মতে এটি দুইভাগে বিভক্ত : (১) ভালো উদ্ভাবন এবং (২) খারাপ উদ্ভাবন। শুক্রবারের দ্বিতীয় আযান বিদাত। হযরত ওসমান (রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু) এই মহান বিদাত উদ্ভাবন করেছে। এটি উত্তম (ভালো) বিদাত। মসজিদে মিনার বিদাত। মহান খলিফা ওমর বিন আব্দুল আজিজ (রহঃ) জনগণকে আজান শোনার জন্য মিনারের এই মহান উদ্ভাবনটি উদ্ভাবন করেছিলেন এবং এটি একটি উত্তম বিদাআত।
কোরআনের অক্ষরে বিন্দুগুলো বিদআত। আপনি কি জনেন যে, হযরত ইয়াহিয়া বিন ইয়ামার (রহঃ) মুসলমানদের পবিত্র কোরআন পড়তে সাহায্য করার জন্য এই মহান উদ্ভাবনটি উদ্ভাবন করেছিলেন এবং এমনকি এটি সাহাবাদের মধ্যে ছিলেন না এবং এটি একটি ভাল বিদআত।
জামাতে তাবাবির নামাজ পড়া বিদাআত। হযরত উমর বিন আব্দুল খাত্তাব (রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু) এই মহান বিদাত উদ্ভাবন করেন এবং তিনি বলেন এটি একটি উত্তম বিদআত।
মাওলিদ (মিলাদুন্নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)। এটা পালন করা বিদআতও নয় শিরকও নয়। প্রমাণ-১, আল কোরআনে আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীন বলেন, হে প্রিয় রাসূল! আপনি স্মরণ করুন ওই দিনের ঘটনা, যখন আমি আম্বিয়ায়ে কেরামগণের নিকট থেকে এইভাবে অঙ্গীকার নিয়েছিলাম যে, যখন ‘আমি তোমাদেরকে কিতাব এবং হিকমত’ অর্থাৎ নবুয়ত দান করবো, অতঃপর তোমাদের কাছে এক মহান রাসূলের শুভাগমন হবে- যিনি তোমাদের প্রত্যেকের নবুয়তের সত্যায়ন করবেন, তখন তোমরা সকলে অবশ্যই তাঁর উপর ঈমান আনায়ন করবে এবং সর্বোত্তমভাবে তাঁকে সাহায্য সহযোগিতা করবে। তোমরা কি এ কথার অঙ্গীকার করছো এবং অঙ্গীকারে কি অটল থাকবে? সমস্ত নবীগণ বললেন, হ্যাঁ, আমরা অঙ্গীকার করলাম। আল্লাহ তায়ালা বললেন, তোমরা পরস্পর স্বাক্ষী থেকো এবং আমি ও তোমাদের সাথে স্বাক্ষী রইলাম। (পারা, সূরা আল-ইমরান ৮১-৮২ নং আয়াত)।
এখানে লক্ষ্য করার বিষয় হলো- (১) অন্যান্য নবীগণ (আঃ) থেকে আল্লাহ তায়ালা অঙ্গীকার আদায় করেছিলেন। (২) সমস্ত নবীগণ সেদিন মাহফিলে উপস্থিত ছিলেন। (৩)মূলত ঐ মাহফিলটি নবীজী (সাঃ)র আগমনী বা মিলাদ-এর মাহফিল ছিল (নবীগণ পৃথিবীতে আসার পূর্বেই আলামে আরওয়াহতে এই মাহফিল হয়েছিল)।
নবীজীর আগমন সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা নবীগণকে উপস্থিত রেখে আলোচনা করেছেন। দয়াল নবীজীর ﷺ শুভাগমনকে আরবীতে মাজিউন্নাবী বলা হয়।
প্রমান-২ আবূ ক্বাতাদাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত- রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর কাছে সোমবারের রোজা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ঐদিন আমি জন্মলাভ করেছি এবং ঐদিন আমার উপর (কোরআন) নাযিল হয়েছে। (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ২৬৪০হাদিসের মান: সহিহ হাদিস)
নবী (সাঃ) নিজের জন্মদিনে আল্লাহ তায়ালার শুকরিয়া আদায়ার্থে রোজা রাখতেন।
এ হাদীস দ্বারা স্পষ্ট বোঝা গেল নবীজির জন্মদিন পালন করা নিঃসন্দেহে জায়েজ। কারণ তিনি নিজেই পালন করেছেন।
দয়াল নবী (সাঃ) সমগ্র বিশ্বের জন্য রহমত স্বরূপ, আমাদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে সব থেকে বড় নেয়ামত/ উপহার বা এহসান।
কোথা থেকে এলো ঈদে মিলাদুন্নবী (সাঃ) বা ঈদে মাজিউন্নাবী (সাঃ) উদযাপন?
হাদিসের ৬ খানা বিশুদ্ধ ও প্রসিদ্ধ কিতাবের অন্যতম সুনানুত তিরমিজি শরিফে একখানা আলাদা চ্যাপ্টার আছে ‘বাবু মা জায়া ফি মিলাদিন্নাবি’ অর্থ্যাৎ ‘প্রিয়নবীর দুনিয়াতে আগমন সম্পর্কে যা এসেছে’ নামে। ওই অধ্যায়ের হাদিসও দিলাম একদম নিচে দেখুন। দেখুন সাহাবায়ে কেরাম হুজুর রাসূলুল্লাহ’র জন্মবৃত্তান্ত অর্থ্যাৎ মিলাদুন্নবী নিয়ে আলোচনা করতেন কীনা! এরকম অসংখ্য হাদিস এসেছে হাদিস, সিরত, দালায়েলু ন্নুবুয়্যাহ, শামাইল এবং তাবাকাত-এর কিতাবে সনদসহ। এসবের প্রাতিষ্ঠানিক রুপ হচ্ছে ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপন, এখন আমরা যা করছি।
সাহাবায়ে কেরাম সুন্নাহ শুনেছেন, দেখেছেন কিন্তু সুন্নাহ স্টাডির প্রাতিষ্ঠানিক রূপ তখন ছিলো না। পরবর্তীতে মাদ্রাসা সিস্টেমে সেটা হয়েছে ‘উলুমুল হাদিস’ নামে। তাফসির শুনেছেন কিন্তু তা প্রাতিষ্ঠানিক রুপ পায়নি, পরে এটা প্রাতিষ্ঠানিক রুপ পায় ‘ইলমুত তাফসির’ নামে। সাহাবায়ে কেরামের যুগে ইলমুত তাফসির নামে আলাদা কোন সাব্জেক্ট ছিল না। শ্রেষ্ঠ মুফাসসির হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এঁর জন্য নবি করিম এই বলে দোয়া করেছেন, ‘আল্লাহুম্মা আল্লিমহুত তা’ভিল, ওয়া ফাককিহহু ফিদ্দিন’। কোরআন মাজিদের তাভিল শিক্ষা দেয়ার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করেছেন, দ্বীনের বুঝ দেয়ার জন্য দোয়া করেছেন। এই তাভিলই পরে হয় তাফসির শাস্ত্র। অর্থ কোরআন মাজিদের ব্যাখ্যা।
প্রিয়নবী (সাঃ) ও সাহাবায়ে কেরামের যুগে অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে আত্মশুদ্ধি চর্চার শাস্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক নাম হয় অনেক পরে ইলমুত তাসাউউফ। এভাবে শত বিষয় বলতে পারব যা অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে হুজুর রাসূলুল্লাহ এবং সাহাবায়ে কেরামের যুগে প্রচলিত ছিলো, যা পরবর্তীতে প্রাতিষ্ঠানিক নাম ও রুপ পায়। নামে কী আসে যায়? সেক্সপিয়ার বলেছিলেন। আর আরবে বলে, লা মুশাহহাতা ফিল ইসতিলাহ। কোন নামে কী হচ্ছে তাতে কী আসে যায়! যে নামেই হোক কাজ কী করা হচ্ছে সেই নামের আড়ালে, সেটাই মূল বিষয়। হারাম কাজকর্ম দ্বারা যদি কেউ ঈদে মিলাদুন্নবী মাহফিল করে তবে তা সর্বোতভাবে হারাম। নারী-পুরুষ একত্রিত হয়ে খেমটা নাচ ও গান বাজনা উদাহরণস্বরূপ। অথবা ডিজে পার্টি, হিন্দি গান যদি বাজে। মায়াজাল্লাহ।
এটা তো কমনসেন্স। কে এগুলোকে জায়েজ বলবে?
কিন্তু কোরআন মাজিদের তিলাওয়াত, হুজুর রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এঁর শান-মান, প্রশংসা, মুহাব্বাত, সুন্নাহ, আদর্শ, শিক্ষা, বৈশিষ্ট্য, গঠন ইত্যাদি আলোচনা, দরুদ ও সালাম পাঠ, নাতে রাসূল পাঠ, জিকির, মানুষকে খাবার খাওয়ানো এই কাজগুলো যা আমরা ঈদে মিলাদুন্নবী মাহফিলে করে থাকি। এই সবগুলো কাজের পক্ষে আলাদা আলাদাভাবে সহিহ হাদিস ও সাহাবায়ে কেরামের আমল আছে। এখানে কোন কাজটা হারাম? কোনটাই না।
এখন বলবেন, আলোকসজ্জা, গেইট, তোরণ, জশনে জুলুসের র্যালী ইত্যাদি কোথা থেকে এলো? আমাদের বুঝা দরকার এই কাজগুলো কোন ইবাদাত না। এগুলো হচ্ছে সাকাফাত বা সংস্কৃতি। রমাদানে আরবের প্রায় সব দেশে সাজসজ্জা হয়। এগুলো কী ইবাদাত নাকি যে আমরা বেদাতের ফতোয়া দেব? ইবাদাত ও সাকাফাতের পার্থক্যটা আমরা খুব কম মানুষই বুঝি। ইবাদাত ও সওয়াব লাভের আশায় কোন কিছু করা হলে যার কোন অস্তিত্বই ইসলামে নাই, কোরআন সুন্নাহের বিপরীত এমন কাজ বেদাতে সায়্যিয়াহ বা খারাপ পথভ্রষ্ট বেদাত যা পরিত্যাজ্য।
আজ ৯০% মুসলমানের এই দেশে হিন্দু দেবতাদের নামে র্যালী হয়, আলোকসজ্জা, গেইট, তোরণ ইত্যাদি নির্মাণের মাধ্যমে পৌত্তিলিকতাকে প্রমোট করা হচ্ছে। অবশ্যই এটা তাদের ধর্মীয় ও নাগরিক অধিকার। আমরা কোনভাবেই এগুলোতে বাধা দিতে পারি না সেকুলার এই বাংলাদেশে। আমরা অহিংসার পক্ষে ১০০%৷ সকল ধর্মের মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পক্ষে আমরা।
৯০% মুসলমানের দেশে আমরা কেন আমার নবীর নামকে ঊর্ধ্বে তোলে ধরতে পারব না? যিনি সায়্যিদুল মুরসালিন, রাহমাতুল্লিল আলামিন। সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মাধ্যমে আমাদের ইয়াং জেনারেশনকে বিপথগামী করছে অন্য ধর্ম ও মতের মানুষেরা।
আমরা মুবাহ জায়েজ এমন বিকল্প কালচার ও সংস্কৃতি না দেয়ার কারণে এরা এখন স্বরসতী পুজা, দুর্গা পূজা, কালি পূজা ইত্যাদিকে জাতীয় উৎসব মনে করে পালন করছে। পহেলা বৈশাখে হাতি পেঁচা ইত্যাদি নিয়ে মংগল শোভাযাত্রা করে। হুজুর রাসূলুল্লাহ’র পরিবর্তে মায়াজাল্লাহ বলতেও কেমন লাগে, মেসি, রোনালদো নায়ক গায়ককে আইডিওলাইজ করছে আমাদের ইয়াং জেনারেশন। কাকে আইকন হিসেবে দেখার কথা আর কাকে দেখছে তারা! কেন হচ্ছে এসব? চিন্তা করুন।
কাজেই মিলাদুন্নবী, শবে বরাত, শবে মেরাজ, ওরস ফাতেহা ইত্যাদি আরো জৌলুসপূর্ণভাবে করা দরকার আমাদের আবহমান সংস্কৃতির অংশ হিসেবে। এগুলোর সবকিছু সওয়াব ও ইবাদাতের নিয়তে হয় না। সময়ের বিশেষ প্রয়োজনে হয়।
সূরা ইউনুসের ৫৮নং আয়াত, সূরা দোহার সর্বশেষ আয়াত, সূরা আম্বিয়ার ১০৭ নং, মায়েদার ১১৪, আলে ইমরানের ১৬৪ ও ৮১নং আয়াতসহ আরো বহু আয়াত দিয়ে আমি দলিল দিতে পারি ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপনের পক্ষে। সেদিকে আমি যাব না। মদিনা শরিফে নবী করিম যখন পৌঁছান তখন সকল মদিনাবাসী “তালায়া’ল বাদরু আ’লাইনা” গেয়ে দফের তালে তালে হুজুর রাসূলুল্লাহকে বরণ করে নিয়েছেন জুলুস বা র্যালি করে যা মুসলিম শরিফেও এসেছে সংক্ষেপে আনাস বিন মালিক (রাঃ) থেকে। সিরতের সবচাইতে নির্ভরযোগ্য কিতাব সিরতে ইবনে ইসহাক ও সিরতে ইবনে হিশামের গ্রহণযোগ্য বর্ণনা, হজরত ওমর ফারুক (রাঃ) ও সায়্যিদুশ শুহাদা আমির হামজা (রাঃ) ইসলাম গ্রহণের পর তাঁদের দুজনকে সামনে রেখে, অর্থ্যাৎ সাহাবায়ে কেরামের দুইভাগের নেতৃত্বে দুজনকে রেখে নবী করিম র্যালি বা মিছিল করে ইসলামের প্রথম অনানুষ্ঠানিক মাদ্রাসা বা খানকা ‘দারুল আরকাম’ থেকে কা’বা শরিফ পর্যন্ত গিয়ে প্রকাশ্যে নামাজ আদায় করেছেন, প্রথমবারের মত সবাইকে নিয়ে জামায়াতের সাথে। এসব দলিল আমি দিচ্ছি না। বরং আমি বলছি এসব আমাদের সংস্কৃতি। এসব প্রয়োজন। কখন কী নামে শুরু হল তা বিষয় না।
কাইস ইবনু মাখরামা (রাঃ) থেকে বর্ণিত : তিনি বলেন, আমি ও রাসূলুল্লাহ হস্তী বছরে (আবরাহার বাহিনী ধ্বংসের বছর) জন্মগ্রহণ করি।
তিনি বলেন, ইয়াসার ইবনু লাইস গোত্রীয় কুবাস ইবনু আশইয়ামকে উসমান ইবনু আফফান (রাঃ) প্রশ্ন করেন, আপনি বড় নাকি রাসূলুল্লাহ? তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ আমার চাইতে অনেক বড়, তবে আমি তাঁর আগে জন্মগ্রহণ করি। রাসূলুল্লাহ হাতীর বছর জন্ম গ্রহণ করেছেন। আমার মা আমাকে এমন জায়গায় নিয়ে গেলেন যেখানে গিয়ে আমি পাখিগুলোর (হাতিগুলোর) মলের রং সবুজে বদল হয়ে যেতে দেখেছি। জামে’ আত-তিরমিজি, হাদিস নং ৩৬১৯ ই সৈয়দ গোলাম কিবরিয়া আজহারী
এরকম অসংখ্য অগনিত প্রমাণ এবিষয়ে রয়েছে যা আশেকে রাসূলগণ (সাঃ) খুঁজে পান।
দ্বীনের বিধি-বিধানের পক্ষে বিদআত গ্রহণ করা হয় একং দ্বীনের বিধানের পরিপন্থী বিদআত প্রত্যাখ্যান হয় ।
‘বাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, কেউ যদি ইসলামে একটি ভালো কাজ উদ্ভাবন করে, সে এর জন্য সাওয়াব পাবে এবং বিচারের দিন পর্যন্ত যারা এটি অনুসরণ করবে তাদের জন্য অনুরূপ পুরস্কার পাবে।’ যাহা সহিহ মুসলিমে রয়েছে এবং আল্লাহ তায়ালাই সবকিছু ভালো জানেন।