প্রকাশ : ১২ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
এর পর যখন এ সর্বপ্রতিক্ষীত জন্ম ঘটনা সংঘটিত হল, তখন সমগ্র জগত নূরের জ্যোতিতে জ্যোতির্ময় হয়ে গেল। ফেরেশতাগণ পরস্পরকে ধন্যবাদ জানাতে লাগল। প্রতিটি আসমানে মহামূল্যবান চুনি - পান্নার স্তম্ভ নির্মাণ করা হল। যার ফলে আসমানসমূহ আলোময় রূপ ধারণ করল। নবী করীম (সাঃ) যখন মে’রাজ সফর করেছিলেন তখন আসমানে ঐ স্তম্ভসমূহ দেখলে তাকে বলা হয়েছিল, এগুলো আপনার জন্মের সুসংবাদ শুনে নির্মাণ করা যে রাতে নবী করীম (সাঃ) জন্মগ্রহণ করলেন, সে রাতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন হাওজে কাওছারের কূলে সত্তর হাজার মেশক আম্বর বৃক্ষ রোপণ করে সেগুলোকে সেরা সুঘ্রাণযুক্ত বৃক্ষে পরিণত করলেন। ঐ রাতে সকল আসমানের অধিবাসীরা আল্লাহর দরবারে তাদের নিরাপত্তার জন্য দোয়া করলেন দুনিয়ার মূর্তি ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল। লাত এবং ওযযার অবস্থানস্থল থেকে স্বর্ণভান্ডার বের হয়ে পড়ল। সর্বত্র এরূপ আওয়াজ উঠল, কুরাইশদের মধ্য থেকে আল আমীনের অভ্যুদয় ঘটেছে। ছিদ্দীক তাশরীফ এনেছেন, অথচ কুরাইশরা কিছুই জানল না যে কি ঘটনা ঘটেছে। খানায়ে কা’বা থেকে কয়েক দিন পর্যন্ত এরূপ আওয়াজ বাতাসে ভেসে বেড়াল, পূর্ণিমার চাঁদ বিকশিত হয়েছে। এখন থেকে আমার প্রিয় জিয়ারাতকারীদের আমার কাছে আনাগুনা শুরু হবে। এখন আমি বর্বরতার আবর্জনা মুক্ত হতে পারব। হে ওযযা তোর ধ্বংস সমাগত। খানায়ে কা’বা যে অপবিত্রতাজনিত কারণে কখনো কখনো কেঁপে উঠত, তার সে কম্পন থেমে গেল। এটা ছিল নবী করীম (সাঃ)-এর ধরায় আগমনের প্রথম নিদর্শন যা কুরাইশরাও লক্ষ্য করেছিল। আবু নাঈম বর্ণনা করেছেন, হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, আমেনার গর্ভ ধারণের নিদর্শনসমূহের মধ্যে একটি হল, সে রাতে কুরাইশদের পালিত জীবজন্তুগুলো বলল, খানায়ে কাবার প্রতিপালকের কসম! সে সত্তা গর্ভে তাশরীফ নিয়েছেন, তিনিই জগতের শান্তি এবং জগদ্বাসীদের জন্য আলো। ঐ রাতে আরবের বিভিন্ন আধ্যাত্মবাদিনী যে সকল মহিলার সঙ্গীনীরূপে জ্বিনেরা তাদের সাথে থাকত, তারা সকলেই গা ঢাকা দিল। জ্যোতির্বিদ্যা বিলুপ্ত হয়ে গেল। দুনিয়ার পরাক্রান্ত রাজা বাদশাহদের আসনসমূহ টলটলায়মান হল। রাজা-বাদশাহরা নির্বাক হয়ে গেল। পূর্বাঞ্চলের জীব-জন্তুরা পশ্চিমাঞ্চলের জীব-জন্তুদেরকে মহামানবের সংবাদ জানিয়ে দিল। একইভাবে সমুদ্রের প্রাণীরা একে অপরকে খোশ-খবর শুনাতে লাগল। হযরত আমেনার গর্ভের প্রতিটি মাস অতিবাহিত হওয়ার পর জমিনে ও আসমানে ঘোষণা করা হত, খোশ আমদেদ! এখন আবুল কাসেম (সাঃ) সার্বিক কল্যাণ এবং বরকতসহ দুনিয়ায় শুভাগমন করেছেন। নবী করীম (সাঃ) তার মাতার উদরে পূর্ণ নয় মাস অবস্থান করলেন ; কিন্তু তিনি তার উদরে কোনরূপ ব্যথা-বেদনা অথবা অস্বস্তি, অস্থিরতা অনুভব করলেন না। এমন কি গর্ভবতী নারীদের মধ্যে যে সকল স্বাভাবিক অবস্থা ও নিদর্শনাদি দেখা যায় হযরত আমেনার মধ্যে তাও দেখা গেল না। নবী করীম (সাঃ)-এর মাতৃগর্ভে থাকা অবস্থায়ই পিতা আব্দুল্লাহ ইন্তেকাল করলেন। তাতে ফেরেশতাগণ বলে উঠল, হে আমাদের পালনকর্তা! আপনার নবী যে এতিম হয়ে পড়লেন? তখন পালনকর্তা জবাব দিলেন, তাতে কি? স্বয়ং আমিই তার অভিভাবক এবং সাহায্যকারী। তোমরা তার জন্ম থেকে বরকত অর্জন কর। তার জন্ম সকলের জন্যই বরকতময় এবং কল্যাণকর। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তার জন্মের সময় আসমান এবং বেহেশতের দরজাসমূহ খুলে দিলেন। হযরত আমেনা তার সম্পর্কে এরূপ বলতেন, আমার গর্ভধারণের ছয় মাস অতিবাহিত হওয়ার পর আমার কাছে জনৈক আগন্তুক এসে নিদ্রার মধ্যে আমার পদযুগলে টোকা দিয়ে বলল, হে আমেনা! তুমি সমগ্র জগতের মনোনীত ব্যক্তিকে গর্ভে ধারণ করেছে। সে ভূমিষ্ঠ হলে তার নাম মুহাম্মদ রেখো। হযরত আমেনা তার নেফাস সম্পর্কে বলেছেন, অন্যান্য নারীদের যা হয়ে থাকে আমার ক্ষেত্রেও তা দেখা গিয়েছে; কিন্তু কোন লোকই তা জানতে পারেনি। এক সময় আমি একটি ভীতিকর গড়গড় আওয়াজ শুনতে পেয়ে খুবই ভীত হয়ে পড়লাম। তারপর হঠাৎ দেখলাম, যেন একটি সাদা পাখীর ডানা আমাকে স্পর্শ করেছে। তাতে আমার সে ভীতি দূর হয়ে গেল। পরক্ষণেই দেখলাম, একটি দুগ্ধপূর্ণ পেয়ালা আমার পার্শ্বে রাখা হয়েছে। আমি তখন দারুণ তৃষ্ণার্ত ছিলাম বলে ঐ দুগ্ধ তুলে পান করলাম। অতঃপর আমার দেহ থেকে একটি নূর উদিত হল। তাতে আমি কয়েকজন মহিলাকে দেখতে পেলাম। তারা প্রত্যেকেই খর্জুর বৃক্ষ সদৃশ দীর্ঘদেহী ছিলেন। তাদেরকে আবদে মানাফ পরিবারের কন্যা বলে মনে হল। তারা আমাকে গভীর দৃষ্টিতে দেখতে লাগলেন। আমি নির্বাকভাবে তা অনুভব করছিলাম। ঠিক এমন সময় একটি জরিদার রেশমী বস্ত্র আসমান ও জমিনের মধ্যস্থলে ছড়িয়ে পড়ল। তাদের কেউ কেউ বলল, একে মানুষের দৃষ্টির আড়ালে নিয়ে যাও। এর পর আমি দেখতে পেলাম, কতিপয় ব্যক্তি শূন্যে রৌপ্যের লোটা হাতে নিয়ে দাড়িয়ে আছে। এর পর একঝাক পাখী এসে আমাকে যেন আবৃত করে ফেলল। পাখীগুলোর ঠোট পান্না নির্মিত এবং পাখা চুনির তৈরী ছিল। অতঃপর আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমার সামনে পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চল খুলে দিলেন। তখন আমি শূন্যে তিনটি ঝাণ্ডা উড়তে দেখলাম। একটি পূর্বে, একটি পশ্চিমে এবং একটি খানায়ে কা’বার ছাদে। এর পর আমার প্রসব বেদনা আরম্ভ হল এবং নবী করীম (সাঃ) ভূমিষ্ঠ হলেন। ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরই আমি তাকে সিজদায় পতিত দেখতে পেলাম। তিনি তখন যেন অনুনয়-বিনয়রত অবস্থায় তার অঙ্গুলী উপরে তুলে রেখেছিলেন। এরপর আসমানে একটি সাদা মেঘ এসে সমগ্র আকাশ ঢেকে ফেলল। তারপর আবার তা অদৃশ্য হয়ে গেল। এ সময় কেউ বলে উঠল, মুহাম্মদকে পূর্বাঞ্চলে ও পশ্চিমাঞ্চলে নিয়ে যাও এবং তাকে সমুদ্রেও বিচরণ করাও, যেন মানুষ তার নাম, আকৃতি এবং গুণাবলি সম্পর্কে জেনে নিতে পারে এবং তারা এটাও জানতে পারে, তার এক নাম মাহী। তার আগমনে শিরক ও কুফরী নির্মূল হয়ে যাবে এর পরক্ষণেই আমি তাকে একটি শ্বেতবর্ণের পশমী কাপড়ে জড়ানো অবস্থায় দেখলাম এবং তার দেহের নীচে ছিল সবুজ রেশম। তার হাতের মুঠায় ছিল মূল্যবান ধাতু নির্মিত তিনটি চাবি। এ সময় অদৃশ্য আওয়াজ এল, মুহাম্মদ নবুয়তের চাবি গ্রহণ করেছেন। এর পরই একটি মেঘখণ্ডের আবির্ভাব ঘটল। আর তার মধ্য থেকে অশ্বের আওয়াজ এবং পাখীর পাখা নাড়ানোর শব্দ শোনা যেতে লাগল। শেষ পর্যন্ত মেঘ অদৃশ্য হয়ে গেল এবং উক্তরূপ আওয়াজও থেমে গেল। এরপর কেউ যেন বলে উঠল, মুহাম্মদকে পূর্ব এবং পশ্চিমে নিয়ে যাও। পয়গম্বরদের জন্মভূমিসমূহে ঘুরিয়ে আন। জ্বিন, মানব, পশু-পাখী এবং হিংস্র প্রাণীদের কাছে নিয়ে যাও। তাকে হযরত আদম (আঃ)-এর পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা, নূহ (আঃ)-এর বিনয়, ইব্রাহীম (আঃ)-এর বন্ধুত্ব, ইসমাইল (আঃ)-এর বাক্য, ইয়াকুব (আঃ)-এর চেহারা, ইউসুফ (আঃ)-এর সৌন্দর্য, দাউদ (আঃ)-এর কণ্ঠস্বর, আইয়ুব (আঃ)-এর ধৈর্য, ইয়াহইয়া (আঃ)-এর ত্যাগ এবং ঈসা (আঃ)-এর মমতা প্রদান কর। তাকে সকল পয়গাম্বরের চরিত্রের সমাবেশকারী বানিয়ে দাও। এর পর এই অবস্থাও দূর হয়ে গেল। এর পর আমি আমার সন্তানের হাতে একটি সবুজ রেশমী কাপড় জড়ানো দেখলাম, কে যেন এই সময় বলে উঠল, মুহাম্মদ সারাজগত হস্তগত করেছে। সৃষ্টিজগতের সকল বস্তু তার মুঠায় এসে গেছে। এর পর তিনটি লোকের আগমন ঘটল। তাদের একজনের হাতে রৌপ্যের লোটা, দ্বিতীয়জনের হাতে সবুজ পান্নার ছোট বাসন এবং তৃতীয়জনের হাতে সাদাবর্ণের রেশম। তা খুলে সে একটি অপূর্ব সুন্দর আংটি বের করল। তারপর উক্ত লোটার পানি দিয়ে আংটিটি সাতবার ধৌত করে ওটা দিয়ে নবী করীম (সাঃ) -এর দু’কাঁধের মধ্যস্থলে মোহর করে দিল। আবু নাঈম এক দুর্বল সনদে বর্ণনা করেছেন যে, হযরত আব্বাস (রাঃ) বলেন, আমাদের সর্বকনিষ্ঠ ভাই আব্দুল্লাহ জন্মগ্রহণ করলে দেখলাম, তার মুখমণ্ডলে একটি জ্যোতি সূর্যের ন্যায় ঝলমল করত। আমাদের পিতা বললেন, আমার এই সন্তানের অবস্থা অদ্ভূত আমি স্বপ্নে দেখলাম, তার নাকের ছিদ্র থেকে একটি সাদা বর্ণের পাখী বের হয়ে উড়ে গেল। আমি এই ঘটনা বনি মাখযুমের এক আধ্যাত্মবাদিনীর কাছে গিয়ে ব্যক্ত করলে সে বলল, তোমার এই স্বপ্ন সত্য হলে তোমার ঔরস থেকে এক পুত্র জন্মগ্রহণ করবে। পূর্ব ও পশ্চিমের লোকগণ তার অনুসরণ করবে। এর পর আমেনা যখন সন্তান প্রসব করল, আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কি কোনকিছু দেখেছ ? সে বলল, আমার প্রসব বেদনা আরম্ভ হলে আমি একরূপ গড়গড় শব্দ এবং কিছু মানুষের কথা বলার আওয়াজ শুনতে পেলাম। তারপর আমি একটি ইয়াকুতের তৈরি স্তম্ভের সাথে রেশমী কাপড়ের ঝাণ্ডা দেখতে পেলাম। তাছাড়া আমি শিশুর মাথা থেকে একটি নূর উদিত হতে দেখলাম। যা সুউচ্চ আসমান পর্যন্ত বিচ্ছুরিত হল। যার আলোকে আমি সিরিয়ার রাজপ্রাসাদকে যেন প্রজ্বলিত অবস্থায় দেখতে পেলাম। এরপর আমি কাছেই এক ঝাক পাখীকে পাখা বিস্তার করে আমার শিশুকে সিজদাহ করতে দেখলাম। আমি সাঈরা আসাদীদ জি¦নকে বলতে শুনলাম, তোমার এ পুত্রের জন্মের উছিলায় মূর্তি-প্রতিমা ও জ্যোতির্বিদ্যার বিলুপ্তি ঘটেছে। এর পর আমি একজন দীর্ঘকায় সুন্দর যুবককে দেখলাম। সে আমার শিশুকে আমার কোল থেকে নিয়ে গেল এবং তার মুখে নিজ মুখের লালা লাগিয়ে দিল। তার নিকট একটি স্বর্ণের থালা ছিল। সে আমার শিশুর বক্ষ বিদীর্ণ করে হৃদপি- বের করে আনল। তারপর হৃদপি-টি চিরে তার মধ্য হতে একটি ক্ষুদ্রাণুক্ষুদ্র কালবিন্দু বের করে দূরে নিক্ষপ করুল। ঐ থালায় সাদা বর্ণের সুগন্ধি ছিল। তা হৃদপিণ্ডে লাগিয়ে দেয়া হল। এর পর একটি সাদা রেশমী থলে থেকে একটি আংটি বের করে তার দ্বারা নবী করীম (সাঃ) -এর দু’স্কন্ধের মধ্যস্থলে মোহর অংকিত করা হল। তারপর সে তাকে কাপড় দ্বারা ঢেকে দিল।
হাফেজ আবু যাকারিয়া ইয়াহইয়া ইবনে মায়েজ নবী করীম (সাঃ)-এর জন্ম ঘটনা সম্পর্কে হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন, হযরত আমেনা নবী করীম (সাঃ)-এর জন্মদিনের আশ্চর্যজনক ঘটনাসমূহ বলতে গিয়ে বলেন যে, আমি সেদিনকার ঘটনাসমূহে বিস্ময়াভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম। হঠাৎ আমার নিকট তিনব্যক্তি আগমন করল। তাদের চেহারার সৌন্দর্য দেখে মনে হচ্ছিল যে, তাদের মুখমণ্ডল থেকে সূর্য ঠিকরে বের হচ্ছে। তাদের একজনের হাতে একটি লোটা ছিল, যার মধ্য হতে অপূর্ব সুঘ্রাণ বের হচ্ছিল। দ্বিতীয়জনের হাতে ছিল পান্নার তৈরী একটি চতুষ্কোণ থালা। ওটার প্রত্যেক কোণে একটি সাদা মোতি জড়ানো ছিল। কে যেন বলল, এটা সমগ্র জগত ও তার পূর্ব পশ্চিম এবং জল ও স্থল। হে আল্লাহর বন্ধু! আপনি যেদিক দিয়ে ইচ্ছা এটা ধরুন। তার এরূপ কথা শুনে আমি দেখার জন্য থালাটির দিকে তাকালাম, দেখি তিনি ওটা কোনদিক দিয়ে ধারণ করেন। দেখলাম তিনি ওটার মাঝখান দিয়ে ধরলেন। হঠাৎ আওয়াজ এল, কসম কা’বার! মুহাম্মদ কা’বা ধারণ করেছেন। আল্লাহ্ পাক তার জন্য কা’বাকে কিবলা এবং বাসস্থান নির্ধারণ করেছেন। তারপর আমি তৃতীয়জনের হাতে উত্তমরূপে ভাজ করা একটি সাদা রেশমী বস্তু দেখলাম। সে ওটা খুলে ওটার ভিতর থেকে একটি মনোরম আংটি বের করল। তারপর তার নিকট হতে থালাধারী ব্যক্তি আংটিটি নিয়ে সাতবার উল্লিখিত লোটার পানি দিয়ে ধৌত করল। অতঃপর সেই আংটি দিয়ে নবী করীম (সাঃ) -এর দু’স্কন্ধের মধ্যস্থলে মোহর এটে দিল। তারপর তা রেশমী বস্ত্রে ঢুকিয়ে রেখে তাতে মেশকের সুতা বেঁধে দিল। অতঃপর তা কিছু সময় নিজ মাথায় রেখে দিল। ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, এ ব্যক্তি ছিল বেহেশতের তত্ত্বাবধায়ক ফিরেশতা রেজওয়ান। সে তখন নবী করীম (সাঃ)-এর কানের নিকট মুখ নিয়ে যেন চুপে চুপে কি বলল, যা আমি বুঝতে পারলাম না। তারপর সে স্পষ্টভাবে বলল, হে মুহাম্মদ! আপনাকে সুসংবাদ। প্রত্যেক নবীর জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা আমি আপনাকে দান করেছি। আপনি তাদের মধ্যে সর্বাধিক জ্ঞানী এবং ধীর। আপনার হাতে সাফল্যের চাবি দেয়া হয়েছে। আপনাকে সর্বাধিক ব্যক্তিত্ব দান করা হয়েছে। হে আল্লাহর খলীফা! যে কেউই আপনার নাম শুনবে, আপনাকে না দেখেই তার অন্তর কেঁপে উঠবে। ইবনে ওয়াহেদ তানভীর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, এই হাদীসটি অপরিজ্ঞাত। ইবনে সা'দ হাকেম, বায়হাকী এবং আবু নাঈম হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, জনৈক ইয়াহুদী মক্কায় অবস্থান করে ব্যবসা-বাণিজ্য করত। নবী করীম (সাঃ)-এর জন্মের রাতে সে কুরাইশদের মজলিসে গিয়ে বলল, হে কুরাইশগণ! আজ রাতে তোমাদের মধ্যে কোন শিশু ভূমিষ্ঠ হয়েছে কি? তারা বলল, তাতো বলতে পারি না। সে বলল, জেনে রাখ এই রাতে শেষ যমানার নবী ভূমিষ্ঠ হয়েছেন। তাঁর স্কন্ধের মাঝখানে চিহ্ন অঙ্কিত আছে, যাতে কিছু চুল রয়েছে। এই শিশু দু’দিন দুধ পানে বিরত থাকবে। কোন জিন তার মুখে অঙ্গুলি রেখেছে। একথা শুনে কুরাইশরা সবিস্ময়ে মজলিস ত্যাগ করল। অতঃপর প্রত্যেকে নিজ নিজ গৃহে পৌঁছে পরিবারের অন্যান্য লোকদেরকেও একথা বলল। তারা বলল, আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুল মুতালিবের আজ একটি পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করেছে। তার নাম রাখা হয়েছে মুহাম্মদ। এই সংবাদ শুনে উক্ত মজলিসে উপস্থিত থাকা কুরাইশ একথা উক্ত ইয়াহুদীর কাছে বলল। ইয়াহুদী বলল, তোমরা আমাকে নিয়ে চল, আমি শিশুটিকে দেখব। তখন কুরাইশরা উক্ত ইয়াহুদীকে নিয়ে হযরত আমেনার নিকট উপস্থিত হল এবং তার শিশুটিকে দেখতে চাইল। হযরত আমেনা তার শিশুকে দেখালেন। ইয়াহুদী শিশুর পিঠ বস্ত্রমুক্ত করে একটি তিলের মত চিহ্ন দেখে বেহুঁশ হয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ পর তার হুঁশ ফিরে এলে কুরাইশরা তাকে জিজ্ঞেস করল, তুমি হঠাৎ ঐরূপ বেহুঁশ হয়ে পড়লে কেন? সে বলল, আমাদের বনী ইস্রাইলদের মধ্য হতে নবুয়তের অবসান ঘটেছে। অবশ্য তোমাদের এতে খুশী হওয়ার কথা। আল্লাহর কসম, এই শিশু সকলের উপর এমন বিজয় লাভ করবে যে, তার পরিচয় মাশরেক-মাগরেব তথা সমগ্র জগতে ছড়িয়ে পড়বে।
বায়হাকী এবং ইবনে আসাকির আবুল হাকাম তানুখী থেকে বর্ণনা করেছেন, কুরাইশদের কোন সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে তাকে একটি হাঁড়ি দিয়ে ঢেকে রাখার জন্য মহিলাদের নিকট সমর্পণ করা হত। তারা তাকে রাতে হাঁড়ির নবী করীম (সাঃ) ভূমিষ্ঠ হলে আরবের ঐ প্রচলন অনুযায়ী আব্দুল মুতালিবও তাকে মহিলাদের নিকট সোপর্দ করলেন। তারা তাকে ঐভাবে রাখার পর প্রত্যুষে গিয়ে দেখল যে, হাঁড়িটি ফেটে গিয়েছে এবং শিশু মুহাম্মদ দু চক্ষু মেলে আসমানের দিকে তাকিয়ে আছেন। তখন মহিলারা আব্দুল মুতালিবের নিকট গিয়ে বলল, আমরা এমন ব্যাপার আর কখনো দেখিনি। শিশুর উপরে যে হাঁড়ি রেখেছিলাম তা দ্বিখণ্ডিত হয়ে গিয়েছে এবং তিনি আসমানের দিকে তাকিয়ে আছেন। একথা শুনে আব্দুল মুতালিব বললেন, তোমরা তার প্রতি তীক্ষ্ম দৃষ্টি রেখ। অবশ্য আমি এ ঘটনাকে সুলক্ষণই মনে করি। শিশুর জন্মের সপ্তম দিনে আবদুল মুত্তালিব কতগুলো পশু জবেহ করে কুরাইশদেরকে আহারের দাওয়াত করলেন। তারা এসে আহারান্তে জিজ্ঞেস করলেন যে, হে আব্দুল মুতালিব। আপনার নাতীর নাম কি রাখলেন? তিনি বললেন, নাম রেখেছি মুহাম্মদ। তারা বলল, পারিবারিক প্রচলিত নাম রাখলেন না কেন? তিনি বললেন, আমার বাসনা যে, ‘আসমানে আল্লাহ এবং দুনিয়ায় মানবকুল তার প্রশংসা করুক। (সে সকলের প্রশংসাভাজন হোক)