প্রকাশ : ২৪ জুন ২০২২, ০০:০০
মাওঃ মোঃ জিয়াউদ্দিন খন্দকার একজন গুণী শিক্ষক। ইসলামের প্রচার ও প্রসারে বিভিন্নভাবে তিনি খেদমতে নিয়োজিত। মসজিদে খতিবের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন অরাজনৈতিক সংগঠনের সক্রিয় সদস্য।
চাঁদপুর শহরের দক্ষিণ গুণরাজদীস্থ আনোয়ারা ইসলাম দাখিল মাদ্রাসার সুপার মাওঃ মোঃ জিয়াউদ্দিন খন্দকার সম্প্রতি দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠের ‘ইসলামীকণ্ঠ’-এর মুখোমুখি হন। এ সময় তিনি ভারতে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)কে নিয়ে কটুক্তি, নবীপ্রেম, নিজেদের জীবনে নবীর আদর্শ বাস্তবায়ন, যুবকদের সঠিক আদর্শ গঠনের উপায় ও আল্লাহওয়ালা হওয়া প্রসঙ্গে কথা বলেছেন।
সাক্ষাৎকার নেন মুহাঃ আবু বকর বিন ফারুক।
চাঁদপুর কণ্ঠ : আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছেন?
মাওঃ মোঃ জিয়াউদ্দিন খন্দকার : ওয়ালাইকুমুস সালাম অ রহমাতুল্লাহি অ বারকাতুহ। আলহামদুলিল্লাহ, মহান আল্লাহ তা’য়ালার অশেষ রহমতে ভালো আছি।
চাঁদপুর কণ্ঠ : ভারতে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)কে নিয়ে কটুক্তির প্রতিবাদে মুসলিম বিশ্বসহ সারাদেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। সর্বস্তরের মুসলমান স্লোগান দিচ্ছেন, নবীপ্রেমের কথা বলছেন। নবীপ্রেম বিষয়ে জানতে চাই।
মাওঃ মোঃ জিয়াউদ্দিন খন্দকার : নবীপ্রেম শব্দের অর্থ হচ্ছে নবীর প্রতি ভালোবাসা। যে ভালোবাসার কারণে আজকে ভারতের বিজেপি মুখপাত্র দুই ব্যক্তির কুরুচিপূর্ণ বক্তবের প্রতিবাদে সারা পৃথিবীতে দল-মত নির্বিশেষে মিছিল-মিটিং হচ্ছে। মহান আল্লাহ তা’য়ালা নিজে নবী করীম (সাঃ)কে ভালোবাসেন এবং কুল মাখলুককে ভালোবাসার জন্যে নির্দেশ দিয়েছেন। সূরা আহযাবের মধ্য আল্লাহ তা’য়ালা বলেন, মুমিনের নিকটে তার জীবনের চাইতে প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সাঃ)। অপর দিকে নবীজি (সাঃ) বলেছেন, তোমরা কেউ পরিপূর্ণ ঈমানদার হতে পারবে না ততক্ষণ পর্যন্ত যতক্ষণ না তোমাদের পিতাণ্ডমাতাণ্ডসন্তানাদী ও সকল মানুষের চাইতে আমি নবীকে বেশি ভালো না বাসবে। (মুসলিম শরীফ)।
হযরত ওমর (রাঃ) নবী করীম (সাঃ)কে বললেন, হে নবী আমি তো আপনাকে আমার জীবনের চাইতে বেশি ভালোবাসতে পারি নাই। নবীজি বললেন, হে ওমর তোমার জীবনের চাইতে বেশি ভালো না বাসলে তুমি পরিপূর্ণ মোমেন হতে পারবে না। (বুখারী শরীফ)।
উপরোক্ত কুরআন ও হাদীসের আলোকে আমরা বুঝতে পারলাম নবীজির ভালোবাসার নামই হচ্ছে ঈমান। আর এ ভালোবাসা অর্জন করার জন্যে নবী (সাঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি আমার সুন্নাতকে ভালোবাসলো সে যেনো আমাকে ভালোবাসলো। যে আমাকে ভালোবাসলো সে আমার সঙ্গে জান্নাতে থাকবে।
চাঁদপুর কণ্ঠ : ধর্মীয় ইস্যুতে আঘাত হানলে এর শাস্তি কী হওয়া দরকার?
মাওঃ মোঃ জিয়াউদ্দিন খন্দকার : ধর্মীয় বিষয়ে বাড়াবাড়ি করা ইসলাম কখনো সমর্থন করে না। ইসলামের বিধানে যে কোনো প্রতিবেশী তার হাত ও মুখ থেকে নিরাপদ থাকা। ইসলাম একটি সুমহান ধর্ম। যা সম্পর্কে মহান আল্লাহ তা’য়ালা সূরা আল ইমরানে বলেছেন, ‘নিশ্চই আল্লাহর নিকট মনোনীত ধর্ম হচ্ছে একমাত্র ইসলাম’। সূরা মায়েদায় বলেছেন, ‘নিশ্চই আমি তোমাদের জন্য ইসলামকে মনোনীত করে দিয়েছি’। সূরা আল ইমরানের অন্য আয়াতে আল্লাহ তা’য়ালা বলেছেন, ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো জীবনব্যবস্থা আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য হবে না। বরং তারা আখেরাতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
উক্ত আয়াত ও অসংখ্য হাদীস দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, ইসলাম হচ্ছে একমাত্র গ্রহণযোগ্য ধর্ম। অন্য ধর্মের ব্যপারে বাড়াবাড়ি বা জুলুমণ্ডঅত্যাচার ইসলাম অনুমোদন দেয় না। যদি কেউ অন্য কোনো ধর্ম নিয়ে জুলুমণ্ডঅত্যাচার করে অবস্থাভেদে সে শাস্তি পাওয়ার যোগ্য বলে বিবেচিত হবে। কিন্তু ইসলাম যেহেতু আল্লাহ মনোনীত ধর্ম সেক্ষেত্রে কেউ আঘাতহানলে তার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হতে পারে। বিশেষ করে বর্তমানে ভারতের বিজেপি মুখপাত্র দুই ব্যক্তির কুরুচিপূর্ণ বক্তবের কারণে তাদের মৃত্যুদণ্ড হওয়া উচিত।
চাঁদপুর কণ্ঠ : মুসলমানগণ নিজেদের জীবনে নবীর আদর্শ কীভাবে বাস্তবায়ন করবে?
মাওঃ মোঃ জিয়াউদ্দিন খন্দকার : সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ আল্লাহর প্রিয় হাবীব হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর আদর্শই মানব জীবনে শান্তি এনে দিতে পারে। মহান আল্লাহ তা’য়ালা সূরা আহযাবে বলেন, আমি অবশ্যই তোমাদের জন্য রাসূলের মধ্যে উত্তম আদর্শ রেখে দিয়েছি। মহানবী (সাঃ)-এঁর আদর্শ দিয়েই জাহেলিয়াতের অন্ধকার দূর হয়ে পৃথিবীতে শান্তির বাতাস বয়ে এসেছে। সে কারণেই আল্লাহ তা’য়ালা পবিত্র কুরআনে পাকে বার বার বলেছেন, ‘তোমরা রাসূলের আনুগত্য করো এবং তিনি যা নিষেধ করেছেন তা পরিহার করো’। নবীজির এই আদর্শ পালনের মাধ্যমেই আমরা পাবো পৃথিবীতে শান্তি এবং আখেরাতে মুক্তি।
চাঁদপুর কণ্ঠ : আপনি ছারছীনা দরবার শরীফের ভক্ত-মুহিব্বীন, ছারছীনা দরবার শরীফের আদর্শ সম্পর্কে কিছু বলুন।
মাওঃ মোঃ জিয়াউদ্দিন খন্দকার : যুগ যুগ ধরে পৃথিবীতে কিছু কিছু মহান ব্যক্তির দ্বারা সমাজে দ্বীনের আলো বিকশিত হয়েছিলো। তারই ধারাবাহিকতায় ছারছীনা নামক পল্লীগায়ে ১২৭৯ বাংলা মোতাবেক ১৮৭৩ খ্রিঃ জন্মগ্রহণ করেন যুগশ্রেষ্ঠ সমাজসংস্কারক মুজাদ্দেদে জামান কুতবুল আলম হযরত মাওঃ শাহ সূফী নেছার উদ্দিন আহমদ (রঃ)। যাঁর আগমনে বাংলাদেশের টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, রূপসা থেকে পাথুরিয়া হেদায়াতের মশাল প্রজ্জ্বলিত হয়েছিলো। দ্বীনের এই মশালকে চলমান রাখার জন্যে ১৯১৮ সালে ছারছীনা দরবার শরীফে প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশের সর্বপ্রথম টাইটেল মাদ্রাসা। যেখানে তা’লিম দেয়া হতো ইলমে শরীয়ত তথা কুরআন-হাদীসের। অপরদিকে তাযকিয়ায়ে নফস্ তথা আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে মানুষকে তৈরি করা হতো খাঁটি নায়েবে নবী ও আশেকে রাসূল হিসেবে। যার দৃষ্টান্ত সারা বাংলায় বিদ্যমান। ছারছীনা শরীফের আদর্শ হচ্ছে কুরআন-সুন্নার গবেষণার নির্যাস। বর্তমানে আলীয়া মাদ্রাসায় বিভিন্ন সমস্যা পরিলক্ষিত হওয়ায় ছারছীনা দরবার যুগের চাহিদায় নতুন আন্দোলনের সূচনা করেছেন। যার নাম হচ্ছে দ্বীনিয়া মাদ্রাসা। সারাদেশে প্রায় ২,৫০০-এর বেশি দ্বীনিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা হয়েছে। যার দ্বারা বাংলাদেশে সর্বত্র রাসূল (সাঃ)-এর আদর্শ বাস্তবায়িত হচ্ছে। এই দরবারের আদর্শের কাছে একজন সাধারণ মানুষ সংশ্রব গ্রহণ করে সে আল্লাহর নৈকট অর্জন করতে পারে।
চাঁদপুর কণ্ঠ : বর্তমানে যুব সমাজ বিভিন্নভাবে গোমরাহী হচ্ছে, যুবকদের সঠিক আদর্শ গঠনের উপায় কী?
মাওঃ মোঃ জিয়াউদ্দিন খন্দকার : যুগ যুগ ধরে পৃথিবীর সার্বিক পরিবর্তন ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে যুবকদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। বর্তমানে এই যুব সমাজ অপসংস্কৃতির করাল গ্রাসে নিমজ্জিত। এই পরিণতি থেকে যুব সমাজকে উত্তরণ করতে হলে মহানবী (সাঃ)-এর আদর্শের বিকল্প নেই। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, ইলমে অহি ও ইলমে নূরের দ্বারাই এই পৃথিবী আলোকিত হয়েছিলো। আর এই ইলম চিনা থেকে চিনায় স্থানান্তর হয়ে এসেছে। কিন্তু বর্তমানে ইউটিউব, অনলাইন, ইন্টারনেট নামে বিভিন্ন প্রযুক্তি-জ্ঞান বিতরণে যুবকদের সহায়ক হওয়ায় সেই যুবকরা নীতি-নৈতিকতা থেকে দূরে সরে পড়েছে। এ যুবক-শ্রেণীকে সম্পদে পরিণত করতে হলে প্রথমে তাদেরকে অপসংস্কৃতি থেকে ফিরাতে হবে এবং সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ী, তাবে তাবেয়ী, ওলামায়ে মোতাকাদ্দেমীন ও ওলামায়ে মুতাআখখেরিনগণের আদলে ও আদর্শে জ্ঞান অর্জনের প্রক্রিয়া উদ্বুদ্ধ করতে হবে। তাহলে এই জাতি মদিনার সমাজ ফিরে পাবে।
চাঁদপুর কণ্ঠ : আল্লাহওয়ালা হওয়ার উপায় কী?
মাওঃ মোঃ জিয়াউদ্দিন খন্দকার : এই কথা অনস্বীকার্য যে, বর্তমানে মানুষ সর্বক্ষেত্রেই পাপে জর্জরিত হয়ে পড়েছে। এই মহাবিপদ থেকে বেঁচে থাকার জন্যে মহান আল্লাহ তা’য়ালা বার বার সতর্ক করেছেন। মহানবী (সাঃ) পৃথিবীর মানুষকে আল্লাহওয়ালা হওয়ার জন্যে যে তালিম দিয়েছেন, তা বর্তমানেও চলমান। নবী (সাঃ) বলেছেন, ‘হক্কানি আলেম যারা তারা নায়েবে নবী বা নবীর ওয়ারিশ’। এ রকম হক্কানি আলেমণ্ডওলামা যারা তাদের নিকট ছোহবত গ্রহণ করে একদিকে আত্মার পরিশুদ্ধি অর্জন করতে হবে। অপরদিকে শরীয়তসম্মত আমল করে নিজের জীবনকে আল্লাহমুখী করে তুলতে হবে। রাসূল (সাঃ) বলেছেন, ‘তোমার অনুকরণ যার সাথে হবে তার মধ্যে তোমাকে গণ্য করা হবে’। সেজন্য যিনি ইলেমে আমলে-আকিদায় রাসূল, সাহাবা ও ছলেহীনগণের পথে পরিচালিত রয়েছে তাদের অনুসণ করলেই আল্লাহওয়ালা হওয়া সহজ হয়। যা আমরা প্রতিনিয়ত সূরা ফাতেহায় পড়ে থাকি। সর্বোপরি কথা হলো, হক্কানী ওলামায়ে কেরামের অনুসরণে আমল করলে আল্লাহওয়ালা হওয়া যায়।
উল্লেখ্য, মাওঃ মোঃ জিয়াউদ্দিন খন্দকার চাঁদপুর শহরের ওয়্যারলেস বাজারস্থ বড় গাজী বাড়ি বায়তুল মামুর জামে মসজিদের খতিব। তিনি বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীন চাঁদপুর জেলা শাখার দপ্তর সম্পাদক ও সদর উপজেলা শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ ইমাম সমিতি চাঁদপুর সদর উপজেলা শাখার সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ জমইয়াতে হিযবুল্লাহ চাঁদপুর জেলা শাখা যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও পৌর শাখার সভাপতি হিসেবে সাংগঠনিক দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়াও তিনি কামরাঙ্গা দারুচ্ছুন্নাত হাফিজিয়া মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও চাঁদপুর দ্বীনিয়া মাদ্রাসার সদস্য।