প্রকাশ : ২৩ নভেম্বর ২০২১, ০০:০০
মোঃ শহীদ উল্লাহ। শহীদ উল্লাহ মাস্টার। আমাদের প্রিয় শহীদ স্যার। বাবুরহাটের সূর্যসন্তান। দাসদী গ্রামের সম্ভ্রান্ত ইসমাইল মাল সাহেবের একমাত্র ছেলে। বাবুরহাট প্রাইমারি স্কুল, বাবুরহাট হাইস্কুল শেষ করে গ্র্যাজুয়েট হন চাঁদপুর কলেজ থেকে। বড়ো চাকুরিতে যেতে পারতেন, যাননি। বুঝতে পেরেছিলেন চারদিকে অশিক্ষা, কুশিক্ষার অন্ধকার। রয়ে গেলেন তাই পিছিয়েপড়া মানুষদের সাথে। যে আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে বাবুরহাট হাইস্কুল নামের বাতিঘর তার সাথে একাত্ম হয়ে বাড়িয়ে দিলেন আলোকমালা। হলেন বাবুরহাট হাইস্কুলের শিক্ষক। বাবুরহাট হাইস্কুলের শিক্ষক হওয়া ছিলো গৌরবের। চাঁদপুর জেলায় স্কুলটি ধ্রুবতারা। সারদা মোহন রায়ের সম্পাদনায় ১৮৯৯ সালে জন্মলাভ করে বাবুরহাট হাইস্কুল। ১৮৮৪ সালে দুর্গাচরণ মহাশয়ের হাত ধরে শিলন্দিয়া গ্রামের পাঠশালাটি বাবুরহাট মধ্যম ইংরেজি স্কুল হিসেবে বাবুরহাট বাজারে স্থানান্তরিত হয়। সেই হিসেবে এটি জেলার প্রথম স্কুল। তবে চাঁদপুর জেলার প্রথম হাইস্কুল ধরা হয় চাঁদপুর হাসান আলী হাইস্কুলকে। নোয়াখালী কাঞ্চনপুরের জমিদার হাসান আলী চৌধুরী ১৮৮৫ সালে তা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৮৭ সালে মহারাণী ভিক্টোরিয়ার জুবিলি উৎসবের কারণে কিছুদিন এর নাম ছিলো জুবিলি হাইস্কুল। সারদা মোহন রায় বাবুরহাট হাইস্কুলের দ্বিতীয় সম্পাদককালে (১৯০২-১৯২৭) প্রথম টিনের প্রলম্বিত স্কুল ঘর নির্মাণ করেন। ১৯১৩ সালে দুর্বৃত্তরা ঘরটি পুড়িয়ে দেয়। সারদা মোহন রায় তা পুননির্মাণ করেন। তিনি চতুর্থ সম্পাদককালে (১৯৩৫-১৯৩৮) দ্বিকক্ষবিশিষ্ট একতলা দালান করেন। নর্মদানন্দ রায়, পঞ্চম সম্পাদক (১৯৩৮-১৯৪২) একতলার উপর দোতলা করেন। অ্যাডঃ আবদুল হালিম পাটোয়ারী ১১তম সম্পাদক (১৯৫৮-১৯৭৮) ১৯৬৬ সালে টিনের ঘরটি সুরম্য দোতলা করে পুরাতন ভবনের সাথে একীভূত করেন। তিনিই মোঃ শহীদ উল্লাহ মালকে বাবুরহাট হাইস্কুলের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দান করেন। অতঃপর আপন তেজে শহীদ উল্লাহ হয়ে উঠেন শহীদ উল্লাহ মাস্টার বা সর্বজনশ্রদ্ধেয় শহীদ স্যার বা বড়ো শহীদ স্যার।
২.
২০০০ সালে বাবুরহাট হাইস্কুলের শতবর্ষ উদ্যাপনের সময় শহীদ স্যারের সম্পাদনায় ‘শতবর্ষ পূর্তি, ১৮৯৯-১৯৯৯, বাবুরহাট উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ’ নামে একটি ম্যাগাজিন বের হয়। সেখান ‘সৌরভে গৌরবে বাবুরহাট’ নামে আমার একটি লেখা ছিলো। ২০১৮ সালে ঈদুল আজহার সময় শহীদ স্যার বাবুরহাট হাইস্কুলের ১২০ বছরপূর্তি পালনের ডাক দেন। তিনি তখন স্কুল এন্ড কলেজের গভর্নিং বডির সভাপতি। তিনি এবারের ম্যাগাজিনের জন্যে আমার আগের লেখাটি আরেকটু বড়ো করে দিতে বলেন। আমি বললাম, স্যার তাহলে তো বইই হয়ে যায়। স্যার বললেন লেখাটাও দাও, বইও লেখো। তা-ই হলো। স্যার বইয়ের ভূমিকা লিখে দিলেন এবং তিনিই বইয়ের নাম রাখলেন ‘আমার বাবুরহাট আমার পরিবার’। তাড়াহুড়ো করে বইটি লেখা ও ছাপা হয়। ২৭-২৮ ডিসেম্বর ২০১৯ তারিখে বাবুরহাট হাইস্কুল এন্ড কলেজের ১২০তম বর্ষপূর্তি পালিত হয় শহীদ স্যারেরই সভাপতিত্বে। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি অনুষ্ঠানে বইটির মোড়ক উন্মোচন করেন। বইটিতে সংগত কারণে শহীদ স্যারের প্রসঙ্গ এসেছে। স্যারের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে স্যারের কিছু প্রসঙ্গ কথা বই থেকে পুনরায় তুলে ধরছি। শহীদ উল্লাহ বিএ বিএড। শিক্ষক, রাজনীতিবিদ, আলোকিত মানুষ। আমাদের সামাজিকীকরণ ও রাজনৈতিক দীক্ষাগুরু। তাঁর সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি হতে বের হওয়া একেকটি পদক্ষেপ ছিল দিব্য জ্যোতি। তিনি বলতেন, আমার ভালো ছাত্রের দরকার নাই, ভালো মানুষ দরকার। ফরাসি দার্শনিক রমা রঁলাকে উদ্ধৃত করে বলতেন, ঙহপব ঋৎধহপব ধিং ংধাবফ নু যবৎ রফষবৎং. স্যার আমাদেরকে সব কিছু পড়তে বলতেন রবীন্দ্রনাথ শরৎচন্দ্র নজরুলের জীবনী ছাড়া। স্যার পরে আমাদেরকে বুঝিয়ে বলেছেন, তাঁরা আগুন, তাঁদের ভুল অনুকরণ হয়ে গেলে তোরা তো পুড়ে যেতি। দশম শ্রেণিতে স্যার আমাদের বাংলা পড়াতেন। একদিন কী একটা ব্যাকরণ ধরেছিলেন। ফার্স্ট বয় এহছানুল হক পাটোয়ারী, সেকেন্ড বিশ্বনাথ সিংহ, ৩য়/৪র্থ আমি/রতন গোস্বামী। এহছান পারলোনা, বিশ্বনাথও না। স্যার এলেন আমার দিকে। আমার জিহ্বা শুকিয়ে কাঠ। স্যার ফিরে গেলেন এহছানের কাছে। তারপর আমাদের প্রসারিত করতলে সজোরে তুলে দিলেন জোড় বেতের গুরুদাক্ষিণ্য। উহু করে উঠলেও প্রচণ্ড ছিল সেই দাক্ষিণ্য তেজ। যে কোন ছাত্রের লক্ষ্যপথে তা পথপ্রদর্শক তীব্র আলোর ছটা।
৩.
স্যার বলতেন, আমরা দরিদ্র ঘরেরই সন্তান। দারিদ্র্যকে ভয় করবি না। চেয়ে দেখ দরিদ্র ঘরের সন্তানরাই পৃথিবীর বড় বড় নমস্য। অপূর্ব কণ্ঠে তিনি আবৃত্তি করতেন, ‘হে দারিদ্র্য, তুমি মোরে করেছ মহান তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রিস্টের সম্মান কণ্টক মুকুট শোভা। দিয়াছ তাপস অসঙ্কোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস উদ্যত উলঙ্গ দৃষ্টি, বাণী ক্ষুরধার বীণা মোর শাপে তব হলো তরবার। (দারিদ্র্য : কাজী নজরুল ইসলাম) সত্য সুন্দরমকে অর্জনের চেষ্টাই শহীদ স্যারের জীবনসংগ্রাম। তাঁর যৌবনে কোনো ছেলে ভয়ে কোনো দোকানে আড্ডাবাজি করতো না। গ্রামে গ্রামে রাতের অন্ধকারে চুপিসারে ছেলেদের পাঠাভ্যাস দেখতেন তিনি। এই ভয়েই অর্ধেক পড়াশোনা হয়ে যেত ছেলেদের। ১৯৭১ সালে বাবুরহাট হাইস্কুল প্রাঙ্গণে ঝাউতলায় মুক্তিকামী ছাত্রদের তেজোদ্দীপ্ত সভায় সমবেত শ্লোগান উঠতো ‘জয় বাংলা’। এই প্রাঙ্গণেই শতকণ্ঠে আমরা গাইতাম ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’। আমাদের এই চেতনার পেছনের প্রাণপুরুষ ছিলেন শহীদ স্যার। আমরা ২০ ফেব্রুয়ারি রাত ১২.০১ মিনিটে স্যারের নেতৃত্বে বাবুরহাট-চাঁদখাঁর দোকান, বাবুরহাট-মঠখোলা যেতাম আর গাইতাম জাগরণী গান : আমরা করব জয় , আমরা করব জয় , আমরা করব জয় নিশ্চয়। আহা বুকের গভীরে, আছে প্রত্যয় আমরা করব জয় নিশ্চয়। আমাদের নেই ভয়, আমাদের নেই ভয়, আমাদের নেই ভয় আজ আর , আহা বুকের গভীরে, আছে প্রত্যয় আমরা করব জয় নিশ্চয়। ...তারপর প্রভাতে প্রভাতফেরি। বাবুরহাটে তখনো শহীদ মিনার ছিল না। আমরা বাবুরহাট থেকে শহীদ স্যারের নেতৃত্বে শহীদ খান (ছোট শহীদ স্যার), কমরেড মিলন দা ও কমরেড আরিফ ভাইয়ের উপনেতৃত্বে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী, আমি কী ভুলিতে পারি’ গাইতে গাইতে বিশাল প্রভাতফেরি নিয়ে যেতাম খলিসাডুলি প্রাইমারি স্কুলের শহীদ মিনারে। বাবুরহাটে আমাদের ছিল শিশুকিশোর সংগঠন ‘নির্ভয় খেলাঘর আসর’। শহীদ স্যার ছিলেন প্রধান উপদেষ্টা। সর্বত্রই আলোকবর্তিকাধারী শহীদুল্লাহ মাস্টার।
শিক্ষতার পাশাপাশি শহীদ স্যার ছিলেন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। স্বাধীনতার পর আমরা অটোপ্রমোশনে সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। শহীদ স্যারকে দেখে একটু একটু করে রাজনীতির হাতেখড়ি হয় আমাদের। তিনি করতেন মোজাফ্ফর ন্যাপ। টাঙ্গাইল নিবাসী চাঁদপুর কলেজের বাংলা বিভাগের শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক সৈয়দ আবদুস সাত্তার স্যার ও শহীদ স্যার বুঝাতেন ধর্ম-কর্ম-সমাজতন্ত্র। মোজাফ্ফর ন্যাপই শহীদ স্যারকে জনতার কাছে নিয়ে যায়। অধ্যাপক মোজাফ্ফর বলতেন, নতুন শতাব্দীতে নতুন সভ্যতা জন্ম নিচ্ছে, যার প্রসব যন্ত্রণা শুরু হয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়নে এবং এই ব্যথা ক্রমশ ছড়াচ্ছে অন্যান্য দেশে-আমাদের দেশেও। বলতেন, অবিচল সততাই হবে রাজনীতিকের জীবনের আদর্শ। শহীদ স্যার সে আদর্শে ব্রতী হয়ে যোগদান করলেন মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দানকারী দল আওয়ামী লীগে। হয়ে উঠেন পোড়খাওয়া স্বচ্ছ রাজনীতিক। বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা তথা সকল ধর্মের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ ও অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি এবং সমাজতন্ত্র তথা শোষণমুক্ত সমাজ ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মূলনীতি। স্যার তাঁর মেধা ও শ্রম দেন আওয়ামী লীগকে। আমৃত্যু সেই দলেই থাকেন।
৪.
ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের পর ইয়াহিয়ার সামরিক আইনে মিথ্যা মামলায় শহীদ স্যারকে নির্যাতন করা হয়। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর সরকার উক্ত মামলা প্রত্যাহার করেন। ১৯৮০ সালে চাঁদপুর জেলায় সন্ত্রাসবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে তিনি ফৌজদারি মামলায় নির্যাতিত হন। ১৯৮৫ সালে মহামান্য আদালতে তিনি বেকসুর খালাস পান। এক কথায় শহীদ স্যার ছিলেন সহকারী প্রধান শিক্ষক, বাবুরহাট উচ্চ বিদ্যালয়; ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ বাবুরহাট উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ; চেয়ারম্যান কল্যাণপুর ইউনিয়ন পরিষদ; চেয়ারম্যান চাঁদপুর উপজেলা কেন্দ্রীয় সমবায় সমিতি; সভাপতি চাঁদপুর জেলা কৃষকলীগ; সহ-সভাপতি চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগ; পরিচালক সাহিত্য একাডেমি চাঁদপুর। সব মিলিয়ে শহীদ স্যার ছিলেন একজন সাদা মনের মানুষ। ২০২০ সালের ১ আগস্ট ঈদুল আজহার দিন বিকেল চারটায় তিনি চলে গেলেন (ইন্নালিল্লাহি...রাজিউন)। আশিকাটি, কল্যাণপুর ও মৈশাদী ইউনিয়নের সঙ্গমস্থল বাবুরহাটের আপামর জনতার হৃদয় তথা চাঁদপুরবাসীর হৃদয়ে মহান শিক্ষক হিসেবে তিনি চিরস্থায়ী হয়ে গেলেন। আমার অনেক ঋণ আছে শ্রদ্ধেয় স্যারের কাছে। প্রার্থনা করি আল্লাহ তাঁকে বেহেশত নসিব করুন। আমিন।