প্রকাশ : ০৯ নভেম্বর ২০২১, ০০:০০
শিক্ষার্থীদের পদচারণায় মুখরিত এখন বাংলাদেশের সব কটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস। প্রায় ১৮-১৯ মাস পর শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে ফিরে আসায় সশরীরে ক্লাস হচ্ছে, ক্যান্টিনে খাওয়া হচ্ছে, খোলা জায়গায় আড্ডা হচ্ছে, মিছিল-মিটিং হচ্ছে অর্থাৎ ক্যাম্পাস তার পুরানো রূপে ফিরেছে।
ক্লাসে ও হলে ঢুকতে হাত ধোয়া, তাপমাত্রা মাপা, স্বাস্থ্যবিধির নিয়মসহ সকল বিধি-নিষেধ মেনে চলছে সকলেই। আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র শিক্ষকের এই সম্পর্ক আরো মধুরময়, আবেগময় এবং আনন্দময়।
হলে ও ক্লাসে সম্মানিত শিক্ষকগণ বহুদিন পর প্রিয় শিক্ষার্থীদেরকে পেয়ে আবেগে আপ্লুত হন এবং তাদেরকে বরণ করে নেন আদর-সোহাগ দিয়ে, ফুল দিয়ে, কেক খাইয়ে। শ্রেণিকক্ষে সকলে মাস্ক পরিহিত এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে ক্লাস চলছে। সকলের মাঝে তাই ফুরফুরে ও আনন্দ ভাব। করোনা পরিস্থিতির বর্তমান অবস্থা অব্যাহত থাকলে পহেলা ডিসেম্বর থেকে স্বাভাবিকভাবে চূড়ান্ত পরীক্ষাও নেয়া হবে বলে জানিয়ে দেওয়া হয়। করোনা ও লকডাউনের জন্য যে সময়টুকু নষ্ট হয়েছে তা পুষিয়ে নিতে সিলেবাস সংক্ষিপ্তকরণ, সরকারি ও অন্যান্য ধর্মীয় ছুটিগুলো কমিয়ে এবং অতিরিক্ত ক্লাস নিয়ে কিভাবে দ্রুততম সময়ে পরীক্ষা নেওয়া যায় সে ব্যাপারে চিন্তাভাবনা ও পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
গবেষণায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান এবং সুনাম বিশ্বনন্দিত। বিশ্বের দুই শতাংশ বিজ্ঞানীদের তালিকা আছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানী প্রফেসর এএ মামুন এবং অনুপ্রাণ বিজ্ঞানী প্রফেসর ইব্রাহিম খলিল। রসায়নে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিজ্ঞানী প্রয়াত প্রফেসর সৈয়দ শফিউল্লাহ স্যারের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। এই ধারা এখনো অব্যাহত রেখেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর শরীফ এনামুল কবির স্যার। বাংলাদেশের প্রথম নারী উপাচার্য বিশিষ্ট নৃতত্ত্ব ও সমাজবিজ্ঞানী প্রফেসর ফারজানা ইসলামের গবেষণা, প্রশাসনিক দক্ষতা সকলের মুখে মুখে এবং দৃশ্যমান।
গবেষণায় আরও চমক লাগিয়েছে সম্প্রতি একদল তরুণ বিজ্ঞানী। সম্প্রতি প্রকাশিত এডি সাইন্টিফিক ইন্ডেক্সিংএ ৫৫ জন বিজ্ঞানীদের নাম তালিকাভুক্ত হওয়ায় সারাবিশ্বে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম আরেকবার উন্মোচিত হলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষক ড. মোহাম্মদ তারিকুল ইসলাম কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় এবং লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছেন। এখানে নিয়মিতই গবেষণা হচ্ছে এডিস মশা, প্রজাপতি, পাখি এবং হিংস্র প্রাণী নিয়ে। চলমান করোনাকালীন সময়েও এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রায় শতাধিক শিক্ষার্থী স্কলারশিপ নিয়ে ইউরোপ-আমেরিকা সহ বিভিন্ন দেশে উচ্চশিক্ষার্থে চলে গিয়েছে।
এদিকে ৭ নভেম্বর থেকে শুরু হয়েছে ভর্তি পরীক্ষা। আনুমানিক ২০০০ হাজার আসনের বিপরীতে তিন লক্ষাধিক শিক্ষার্থী প্রতিযোগিতা করেছে এখানে। অর্থাৎ একটি আসনের বিপরীতে ১৫০ জন শিক্ষার্থী প্রতিযোগিতায় লড়ে।
নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে ভর্তিচ্ছুদের জন্য সিটপ্লান করা হয়েছে। পরীক্ষার সময়কাল এক ঘণ্টার পরিবর্তে ৪৫ মিনিটে আনা হয়েছে। দুই শিফটের মধ্যবর্তী সময় আধা ঘণ্টার পরিবর্তে ৪৫ মিনিট রাখা হয়েছে যাতে শিক্ষার্থীরা নিরাপদে বের হতে এবং পরবর্তী শিফটের শিক্ষার্থীরা নিরাপদে ক্লাস রুমে ঢুকতে পারে। শিক্ষার্থীরা কে কোন রুমে পরীক্ষা দিবে তার তালিকা ওয়েবসাইট এবং পত্রপত্রিকায় দেয়া হয়েছে। পরীক্ষার আগের দিন এসএমএসের মাধ্যমেও জানিয়ে দেওয়া হবে।
ক্যাম্পাসটি ঢাকা থেকে একটু দূরে হওয়ায় শিক্ষার্থীদের সাথে অভিভাবকগণ আসেন। ফলে ক্যাম্পাসে অসংখ্য লোকের সমাগম ঘটে। করোনাকালীন এই সময়ের জন্য এটি একটি মারাত্মক হুমকি। তাই শিক্ষার্থী-অভিভাবকগণ নিজ নিজ দায়িত্বে সুরক্ষিত মাক্স পরিধান করে আসতে হবে এবং অযথা ক্যাম্পাসে অবস্থান করবেন না। অর্থাৎ ক্যাম্পাসে অবস্থান কালে সরকার এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক আরোপিত স্বাস্থ্যবিধির সকল আচরণ মেনে চলতে হবে।
জায়গা স্বল্পতার জন্য নিজস্ব গাড়ি না এনে গণপরিবহন ব্যবহার করলে ভালো হয়। সরকার এবং গণ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের জন্য ভাড়া মওকুফ কিংবা স্বল্পমূল্যে পরিবহন পরিচালিত করলে দেশবাসীর কাছে প্রশংসিত হবে । সাভার এলাকার ব্যবসায়ী, নেতৃবৃন্দ এবং পরিবহন মালিকগণও এ ব্যাপারে অবদান রাখতে পারেন।
উল্লেখ্য যে, সরকারের নির্দেশে এ বছর অধিকাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নিয়েছে। এতে শিক্ষার্থীদের হয়রানি কমেছে, সময় ও খরচ বেঁচেছে। ভবিষ্যতে বাংলাদেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এই পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া উচিত বলে সকলে মনে করেন। এমনকি উন্নত দেশের আদলে ভর্তি পরীক্ষা ছাড়াই কিভাবে শিক্ষার্থী ভর্তি করা যায় সে ব্যাপারে পরিকল্পনা করার আশা ব্যক্ত করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্য।
উল্লেখ্য, গত ১১ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলো খুলে দেয়া হয়েছে এবং ওই দিন থেকেই ওয়াজেদ মিয়া বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্রে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় শিক্ষার্থীদের টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে কর্তৃপক্ষ। ক্যাম্পাসে বসবাসরত রিকশাচালক, দোকানদার, দিনমজুর সকলের জন্যই এই কার্যক্রম অব্যাহত আছে এখনো।
৪৯তম ব্যাচ (সর্বশেষ) ব্যাচের শিক্ষার্থীদের ইতিমধ্যেই অনলাইনে পরীক্ষা সমাপ্ত হওয়ায় এবং গণরুম বন্ধ থাকায় উক্ত ব্যাচের শিক্ষার্থী ছাড়া সকল শিক্ষার্থীরাই হলে অবস্থান করছে। তবে সুখবর হচ্ছে মাননীয় উপাচার্যের প্রচেষ্টায় সাড়ে ১৪ কোটি টাকার সরকারি অনুদানে ১০০০ আসন বিশিষ্ট দশতলার ৬টি সুদৃশ্য আবাসিক হলের কাজ প্রায় শেষের দিকে। খুব শীঘ্রই ফুলগুলো মাননীয় প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করবেন বলে আশা করা যাচ্ছে ষ তখন ৪৯তম ব্যাচসহ শতভাগ শিক্ষার্থীর আবাসনের ব্যবস্থা হবে ইনশাআল্লাহ। পর পর দুই মেয়াদে আট বছর প্রশাসনে থেকে বর্তমান উপাচার্য শিক্ষা, গবেষণা এবং অবকাঠামো উন্নয়নে অনেক অবদান রেখেছেন।
দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের আইআইটি এবং সিএসই বিভাগের শিক্ষার্থীরা গত কয়েক বছর যাবত চ্যাম্পিয়ন হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মুখ উজ্জ্বল করে আসছে। আরো বিশ্বমানের কাজের জন্য এখানে হাইটেক পার্কের আদলে একটি বিশাল আইটি শিক্ষা ও গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন করা উচিত। তাই হলগুলো উদ্বোধনকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরবর্তী উন্নয়ন এবং আইটি ভবনের জন্য প্রতিশ্রুতি আদায়ে আন্তরিক হবেন-এটাই দেশবাসীর প্রত্যাশা।
লেখক : অধ্যাপক ও পরিচালক, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।