প্রকাশ : ১২ অক্টোবর ২০২১, ০০:০০
বিশ্ববিদ্যালয় খুলছে, এরপর কোন পথে হাঁটবো
এম মেসবাহউদ্দিন সরকার
দীর্ঘ প্রায় ১৮ মাস বন্ধ থাকার পর করোনা নিয়ন্ত্রণে আসায় স্কুল-কলেজ খুলেছে। অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে ক্লাস চলছে। দেড় বছরে অনেকেরই দৈহিক বৃদ্ধি ঘটেছে, শারীরিক পরিবর্তন হয়েছে। সংগত কারণেই পুরোনো জুতা, স্কুলড্রেস সবকিছুই অকেজো। অনেক দিন পর বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হবে, তাই চাই সবকিছু নতুন নতুন। মা-বাবা জরুরি কাজ বাদ দিয়ে জুতার দোকানে ও দর্জির ঘরে গেলেন, কিনলেন নতুন খাতা-পেনসিল-ব্যাগও। কী উচ্ছ্বাস, কী আনন্দ! আবেগ ও আয়োজন যেনো ঈদ, পূজা, পয়লা বৈশাখ সবকিছুকে ছাড়িয়ে গেলো। রাত পোহালেই স্কুলে যাবে, তাই রাতভর নেই ঘুম। অবশেষে স্কুলে গেলো, বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হলো, হইচই, হইহুল্লোড়, দৌড়াদৌড়ি সবই হলো, কিন্তু কঠোর নিয়ম-শৃঙ্খলা ও বিধিনিষেধের মধ্য দিয়ে। দলবেঁধে চলা নিষেধ, ক্যান্টিন ও বাইরে খাওয়া নিষেধ, ছুটি শেষে সোজা বাড়িতে যাওয়া এবং সর্বত্র মাস্ক পরা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা ইত্যাদি। কোনো কোনো বন্ধুকে না দেখে মন খারাপও হয়েছে। জানা গেলো, অভাবের কারণে অনেক মেয়ে শিক্ষার্থীর বিয়ে হয়ে গেছে, ছেলে বন্ধুরা সংসারের হাল ধরেছে ইত্যাদি। এরই মধ্যে মানিকগঞ্জে করোনায় আক্রান্ত হয়ে এক শিক্ষার্থীর মৃত্যু, গোপালগঞ্জে এক শিক্ষার্থী ও বাগেরহাটে এক শিক্ষকের আক্রান্ত হওয়া এবং ঠাকুরগাঁয়ে করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় সেখানে স্কুল বন্ধের ঘোষণায আবার দুশ্চিন্তায় ফেললো সবাইকে।
|আরো খবর
ইতিমধ্যে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় খোলার দিন-তারিখ ঘোষণা করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাস্টার্স ও চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থীদের প্রথমে ক্যাম্পাসে আনার পরিকল্পনা করেছে। পর্যায়ক্রমে অন্যান্য বর্ষের শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে আসবেন নির্দিষ্ট সময়ে। সবকিছু নির্ভর করছে শিক্ষার্থীদের ভ্যাকসিন দেয়ার ওপর। অন্তত প্রথম ডোজ দেয়া হলেই শিক্ষার্থীরা তাদের প্রাণের ক্যাম্পাসে ঢুকতে পারবেন, এটা এখন নিশ্চিন্ত।
ইউজিসি ও সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ইতিমধ্যেই শিক্ষার্থীদের ভ্যাকসিন দেয়ার হালনাগাদ তালিকা প্রস্তুত করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব অফিস, বিভাগ, আঙিনা, বারান্দা, রাস্তাঘাট ইত্যাদি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে রেখেছে। ক্যাম্পাস এখন শিক্ষার্থীদের আগমনে অপেক্ষারত। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী প্রবেশে যার যার মতো প্রস্তুতি নিলেও আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব একটু আলাদা। একমাত্র আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ায় এখানে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্যে আবাসিক হলে সিট থাকা বাধ্যতামূলক। তা সত্ত্বেও দীর্ঘদিন ধরে এর বাইরের সংস্কৃতির এখানে চলছে। প্রতি বছর ভর্তির আসনসংখ্যা বাড়লেও এখানে আবাসনসংখ্যা বেড়েনি। ফলে বাধ্য হয়েই শিক্ষার্থীদেরকে গণরুমে থাকতে হচ্ছে, যেখানে নেই লেখাপড়ার ন্যূনতম পরিবেশ।
বর্তমান উপাচার্য শিক্ষার্থীদের এই দুর্ভোগ দূরীকরণে অঙ্গীকারবদ্ধ ছিলেন এবং সরকারের উচ্চ মহলের সঙ্গে দেনদরবার করে প্রায় সাড়ে ১৪শ’ কোটি টাকার অনুদান এনেছেন। যথাসময়ে কাজও শুরু করেছেন। এক হাজার আসনবিশিষ্ট ছেলেদের তিনটি ও মেয়েদের তিনটি হল এখন নির্মাণের শেষ পথে। দশতলাবিশিষ্ট অত্যাধুনিক হলগুলো এখন ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের পাশে দৃশ্যমান। দেখলে মনে হবে এ যেনো ইউরোপ-আমেরিকার কোনো ক্যাম্পাস। নির্মাণকাজ শেষ হলে বিশ্ববিদ্যালয়টি দীর্ঘদিনের গণরুমের অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবে।
এখনো করোনা একেবারে নির্মূল হয়নি, আছে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবও। উপরন্তু, বিশ্ববিদ্যালয়টি সবুজ গাছগাছরায় আচ্ছাদিত এবং সে কারণে মশা ও কীটপতঙ্গের আধিক্য এখানে বেশি। তাহলে গণরুমের শিক্ষার্থীরা এই মুহূর্তে কোথায়, কীভাবে থাকবে? উল্লেখ্য, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জুলাই মাস থেকে অনলাইনে চূড়ান্ত পরীক্ষাপদ্ধতি প্রচলন করেছে, যা প্রশংসিত হয়েছিলো সব মহলে। পরবর্তী সময় এই পদ্ধতি বাংলাদেশের অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ও গ্রহণ করেছে।
যা হোক, অনলাইনে পরীক্ষা নেয়ার ফলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় অনেক সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। যাদের পরীক্ষা ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে, তাদের এ মুহূর্তে ক্যাম্পাসে প্রবেশ না করিয়ে, যাদের পরীক্ষায় এখনো বাকি, তাদের কথা প্রথমে বিবেচনা করা যেতে পারে। তবে এ-সংক্রান্ত সুস্পষ্ট বিজ্ঞাপন বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচার করতে হবে। পর্যায়ক্রমে সবার ভ্যাকসিন দেয়া শেষ হবে, দশতলা হলগুলোর নির্মাণকাজ শেষ হবে ও সবার আবাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের পাশাপাশি অভিভাবকদের এখানে অনেক দায়িত্ব। সন্তানকে আপনি এখন না পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠাবেন, তা ভালোভাবে জেনে নেবেন।
ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবক সবার মনে রাখতে হবে, যে কোনো একজনের জন্যেই পুরো ক্যাম্পাস সংক্রমিত হতে পারে, যেমনটি হয়েছে ঠাকুরগাঁয়ের স্কুলে। তাই সবকিছু জেনেশুনে, প্রয়োজনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও ক্যাম্পাসে অবস্থানরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে আপনার সন্তানকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠাবেন।
কর্তৃপক্ষকেও প্রস্তুত রাখতে হবে প্রয়োজনীয়সংখ্যক অক্সিমিটার, অ্যাম্বুলেন্স, মাস্ক, হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও আইসোলেশন সেন্টার। নিয়মিত মনিটর করতে হবে এগুলো সচল থাকে কি না। শিক্ষার্থীরা যাতে হলের ভেতরেই অবস্থান করেন সেজন্যে স্বল্পমূল্যে মানসম্মত খাবার, অভ্যন্তরীণ ব্যায়ামাগার ও খেলাধুলার আধুনিক সরঞ্জাম, বিতর্ক প্রতিযোগিতা ইত্যাদি আয়োজন করা যেতে পারে। যে ১৮ মাস চলে গেছে, তা কখনোই ফিরে আসবে না। এই অপূরণীয় ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার জন্যে শিক্ষার্থীদের আগের চেয়ে বেশি লেখাপড়ায় মনোযোগী হতে হবে। সেজন্যে আপাতত সব ধরনের রাজনীতি, সভা-মিছিল-মিটিং ও ঠিকাদারের পেছনে দৌড়াদৌড়ি কমাতে হবে। দ্রুততম সময়ে লেখাপড়া শেষ করে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করতে হবে, বৃদ্ধ মা-বাবার মুখে হাসি ফোটাতে হবে, নিজের সংসারও শুরু করতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যে ঘোষণা করেছে, অন্তত দুই সপ্তাহ শিক্ষার্থীরা হলে অবস্থান করবেন এবং হলে থেকেই অনলাইনে ক্লাস/পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করবেন। প্রয়োজনে লেখাপড়া চলবে ব্লেন্ডেড পদ্ধতিতে। করোনায় এতো ভোগান্তির পর যে ক্লাসের দরজা খুলেছে, আমাদের কোনো ভুলের কারণে যেনো আবার তা বন্ধ না হয়, হলের গেটে তালা না ঝুলে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকে ‘প্রবেশ নিষেধ’ লেখা না থাকে।
সামনেই ভর্তি পরীক্ষা, যা চলবে দুই সপ্তাহব্যাপী। একই শিক্ষার্থীর এক ইউনিটের পরীক্ষা আজ তো অন্য ইউনিটের পরীক্ষা অন্যদিন। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থীরা পরিচিত কারও সঙ্গে হলে থাকবেন। কোনোভাবেই যাতে একটি সিটে একের অধিক শিক্ষার্থী না থাকেন, সেদিকে সতর্ক নজর রাখতে হবে। অনলাইন পরীক্ষাপদ্ধতি প্রচলন করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় যেমন সবার প্রশংসা ও সুনাম অর্জন করেছে, তেমনি করোনা-পরবর্তী সময়েও সব বিধিনিষেধ ও শৃঙ্খলা মেনে সবার সহযোগিতায় বিশ্ববিদ্যালয়কে সচল রাখার নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেÑএমনটাই দেশবাসীর প্রত্যাশা।
ড. এম মেসবাহউদ্দিন সরকার : অধ্যাপক ও পরিচালক, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।