প্রকাশ : ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০০:০০
২৩ আগস্ট অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে একটি আদেশ জারি করা হয়েছে, যা একদিকে আনন্দের, অন্যদিকে একটি প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। আদেশটি হচ্ছে, ‘যোগদানের মাস থেকেই উৎসব ভাতা পাবেন বিভিন্ন সরকারি, আধা সরকারি ও রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এবং স্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের নতুন কর্মচারীরা। উৎসবের মাসে বা তার আগের মাসের যে তারিখেই যোগদান করুক না কেনো, মূল বেতনের সমান বোনাস পাবেন এসব প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা।’ আগে যে নিয়মটি প্রচলিত ছিলো তা হচ্ছে, ‘যোগদানের মাসে উৎসব হলে নতুন সরকারি কর্মচারী খণ্ডিত বোনাস পেতেন। কিন্তু এখন থেকে যোগদানের মাসে উৎসব হলে নবনিযুক্ত কর্মচারীরা মূল বেতনের সমপরিমাণের উৎসব ভাতা পাবেন।’ প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের যেকোনো ধরনের প্রণোদনা ও সুবিধা একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। তারা রাষ্ট্রের জনগণ তথা সর্বস্তরের মানুষকে সেবা প্রদান করেন, তারা যাতে আরো ভালোভাবে সেবা প্রদান করতে পারেন, সেজন্য মাঝে মাঝে রাষ্ট্র কর্তৃক বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। এটি ভালো কথা। তবে এর সঙ্গে কয়েকটি বিষয় চলে আসে।
দিন যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এবং বেতন ও সুবিধা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের সেবার মানও যাতে বাড়ে, সেই বিষয়টি আসলেই নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে লাভ কী? জনগণের ট্যাক্সের টাকায়ই চলে এসব কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন, বিদেশ থেকে কোনো অনুদানও যদি আসে, সেটিও কিন্তু জনগণের জন্য আসে। তার মালিক এবং প্রাপক জনগণই। তাদের সর্বোত্তম সেবা নিশ্চিত করতে হবে রাষ্ট্রকেই। যে হারে তাদের বেতন বাড়ে, সেই হারে বা তার ধারেকাছেও কি সেবার মান কখনো পৌঁছে? সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন ডাবল বা তারও বেশি করা হয়েছে। এটি প্রয়োজন ছিল। আমরা আশা করেছিলাম যে এখন থেকে সরকারি অফিস-দপ্তরে আর ঘুষ দিতে হবে না। তারা আগে ঘুষ খেতেন ভালোভাবে সংসার পরিচালনার জন্য। কিন্তু হায়! উেকাচ ছাড়া কোনো কাজই হচ্ছে না? বরং বেতন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে উেকাচের পরিমাণও বেড়ে গেছে বেশ বড় অংকে। রাষ্ট্র কেন এটি নিশ্চিত করতে পারছে না যে উেকাচ ছাড়া জনগণ সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে সেবা পাবেন। আমি নিয়মিত বিভিন্ন শিক্ষা অফিসে যাই। অনেক জায়গায় অনেক ধরনের অভিজ্ঞতা হয় ও হচ্ছে।
একবার প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগের ঢাকা অফিসে গেলাম। সালাম দিয়ে এক কর্মকর্তার রুমে ঢুকলাম। দেখলাম তিনি আমাকে হ্যাঁ, না, বসেন, দাঁড়ান, কেনো এসেছেন, কার কাছে এসেছেন, কোথা থেকে এসেছেন, এ-জাতীয় কোনো কথাই বলছেন না। শুধু মাথা নিচু করে কী যেনো দেখছেন আাার মাঝে মাঝে ফোন করে ব্যস্ততা দেখানোর চেষ্টা করছেন। আমি শুধু দেখলাম যে এদের কোনো প্রশিক্ষণ নেই কীভাবে মানুষকে সেবা দিতে হয়। সেটি না হয় দূরের কথা, মানুষের সঙ্গে, আগন্তুকের সঙ্গে কীভাবে আচরণ করতে হয়, কিছুই শেখেননি। কী শিক্ষা অফিসে তারা চাকরি করছেন, কাদের জন্যে করছেন? কেনো তাদের এসব প্রশিক্ষণ দেয়া হয় না। আমাদের বিভিন্ন অফিস ও দপ্তরের কর্মকর্তা ও কর্মচারী মোটামুটি এ রকমই। কেনো তাদের কোনো প্রশিক্ষণ দেয়া হয় না? বিদেশের যে কোনো অফিসে যান, কোনো ভিড় দেখবেন না, কারণ সেবাপ্রার্থীরা আসার সঙ্গে সঙ্গে সেবা নিয়ে চলে যান। আমাদের দেশের বেসরকারি অফিসগুলোও সেই রীতি কিছুটা চালু করেছে কিন্তু রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা মোটেই পরিবর্তন হয়নি। কে করবে? কীভাবে করা হবে? কাজেই যখনই রাষ্ট্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কোনো সুবিধা পেতে দেখি তখনই ওইসব চিত্র চোখের সামনে ভাসে। কাদের রাষ্ট্রীয় সুবিধা দেয়া হচ্ছে, কেন দেয়া হচ্ছে? কাদের টাকা দেয়া হচ্ছে?
সরকারি, আধা সরকারি ও রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এবং স্ব-শাসিত প্রতিষ্ঠানের নতুন কর্মচারীদের উৎসব ভাতার প্রাপ্যতা নিয়ে আদেশে বলা হয়েছে, একজন নবনিযুক্ত কর্মচারী যে মাসে উৎসব অনুষ্ঠিত হবে, সেই মাসে বা তার পূর্ববর্তী মাসে যতো তারিখই যোগদান করুন না কেনো যোগদানকৃত পদের মূল বেতনের সমপরিমাণ অর্থ উৎসব ভাতা হিসেবে প্রাপ্য হবেন।’ অর্থাৎ নতুন কর্মচারীদের আর খ-িত উৎসব ভাতা পেতে হবে না। অনেক ভালো কথা কিন্তু এমপিওভুক্ত শিক্ষক, যারা বহু আন্দোলন, ত্যাগ ও তিতিক্ষার পর এখন মূল বেতনের শতভাগ এমপিও হিসেবে পেয়ে থাকেন, তাদের কথা বলা হলো না। এক ধরনের জটিলতা সৃষ্টি হলো এবং আবার তাদের দেনদরবার করতে হবে, তার পরে হয়তো সিদ্ধান্ত হবে।
মাধ্যমিক শিক্ষা রাষ্ট্রীয় বৈষম্যের শিকার। গ্রামগঞ্জের ৯৭ শতাংশ শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষক বিরাট বৈষম্যের শিকার। শিক্ষার মাত্র ৩ শতাংশ রাষ্ট্র পুরোপুরি পরিচালনা করে। একই কারিকুলাম, একই সিলেবাস, একই পরীক্ষা পদ্ধতি, একই কর্মঘণ্টাসহ শিক্ষাদান পদ্ধতির সবকিছু একই নিয়মে পরিচালিত হলেও সরকারের আর্থিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত বেসরকারি মাধ্যমিক শিক্ষকরা। বেসরকারি মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা চালাতে বেশি বেতন নিতে হয়। শিক্ষকরা পান ১ হাজার টাকা বাড়ি ভাড়া, ৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা আর উৎসব ভাতা পান মূল বেতনের ২৫ শতাংশ। এ চাকরিতে নেই পদোন্নতি, নেই অবসর সুবিধা। মৌলিক অধিকারের দিক থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা কতটা গুরুত্বের দাবি রাখে, তা আমরা স্বাধীনতার এত বছর পরেও বুঝতে পারিনি। গত ২৯ মার্চ বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তি ও জনবল কাঠামোর নীতিমালা প্রকাশ করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। নতুন এমপিও নীতিমালার লুক্কায়িত গুরুত্ব হচ্ছে, মাধ্যমিক শিক্ষার যে বিশাল অংশ বেসরকারি পর্যায়ে পরিচালিত হয়ে আসছে, সেটি বেসরকারিই থেকে যাচ্ছে। অনেক শিক্ষক এবং শিক্ষক সংগঠন বিভিন্নভাবে এটিকে উপস্থাপন করেছিলেন যে শিক্ষা জাতীয়করণ হচ্ছে। নতুনভাবে এমপিও নীতিমালা তৈরি করার অর্থ হচ্ছে শিক্ষা জাতীয়করণ হচ্ছে না। এর কারণ শুধুই অর্থনৈতিক নয়। বর্তমান সরকার দ্বিতীয়বারে যেসব প্রাথমিক বিদ্যালয়কে সরকারি করেছিল, সেগুলোর শিক্ষকদের মান নিয়ে বিরাট প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। সেটি একটি কারণ। মাধ্যমিকে যেভাবে শিক্ষক নিয়োগ হয়ে আসছিল, তাতে এ ধরনের শঙ্কা অমূলক নয়। তবে এনটিআর সি-এর মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ শুরু হওয়ায় কিছুটা আশান্বিত হওয়ার জায়গা তৈরি হয়েছে, যদিও একেবারে স্মার্ট কিছু ঘটেনি। আরেকটি কারণ হতে পারে ‘প্রতিযোগিতামূলক’ ব্যবস্থা না থাকলে শিক্ষার মান নিয়ে হয়তো কেউ ভাববেন না। বর্তমানে বেসরকারি পর্যায়ে অনেক নামিদামি প্রতিষ্ঠান রয়েছে এ প্রতিযোগিতার কারণে। সব একই মানের ও একই ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থাকলে মানের বিষয়টি উপেক্ষিত থেকে যাবে। তবে জাতীয়করণ করলে মান নিয়ে আলাদাভাবে চিন্তা করা যেত। আমরা আরেকটি বিষয় লক্ষ করেছি যে কলেজ এমপিওভুক্তিকরণ বিষয়টি আগের চেয়ে জটিল করা হয়েছে, অর্থাৎ কলেজশিক্ষাকে কিছুটা নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। কারিগরি শিক্ষাকে বাস্তবসম্মত কারণেই সরকার বেশ গুরুত্ব দিচ্ছে। শুধু কলেজে পড়ে বেকার সৃষ্টি করা বিষয়টিতে সরকারি একটু নড়েচড়ে বসেছে। সম্ভবত এ কারণেই কলেজের এমপিওভুক্তিকরণ বিষয়টিকে কিছুটা জটিল করা হয়েছে।
২০১০ সালে ১ হাজার ৬২৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হয়েছিলো। সে সময়ে সব সংসদ সদস্যের পছন্দ অনুযায়ী বিদ্যালয় এমপিওভুক্ত করা যায়নি বলে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রীকে সংসদ সদস্যদের তোপের মুখে পড়তে হয়েছিল। তারপর পার হয়েছে প্রায় ১০ বছর। এর মধ্যে এমপিওভুক্তির দাবিতে নন-এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীর বহুবার আন্দোলনে নামেন। নতুন করে আর এমপিওভুক্তি হয়নি। ২০১৮ সালে অনেক শিক্ষক আশা করেছিলেন যে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হবে। অনলাইনে আবেদন গ্রহণ করা হলো, ৯ হাজার ৪৯৫টি প্রতিষ্ঠান আবেদন করল। ২০১৯ সালের অক্টোবরে জানা গেল ২ হাজার ৭৩০টি প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির ছাড় পেল। পরে জানানো হলো, এমপিও পাওয়ার উপযুক্ততা অর্জন করেছে মাত্র ২ হাজার ৬১৫টি প্রতিষ্ঠান। ২০১৯ সালের শেষের দিকে বিশেষ ক্ষমতা বলে সরকার আরো সাতটি প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করেছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে এমপিও খাতে বরাদ্দ ৪০০ কোটি টাকার বেশি ফেরত যায় রাষ্ট্রের কাছে, কারণ শিক্ষা মন্ত্রণালয় সেই অর্থের সদ্ব্যবহার করতে পারেনি। দেশে এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রায় ২৮ হাজার এবং স্বীকৃতিপ্রাপ্ত কিন্তু নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা সাত হাজারের বেশি। এসব প্রতিষ্ঠানে প্রায় পৌনে দুই লাখ শিক্ষক-কর্মচারী আছেন। আমাদের এই দরিদ্র তথা বৈষম্যপূর্ণ সমাজে কত অর্থের অপচয় হচ্ছে ব্যক্তিগতভাবে, সামাজিকভাবে ও রাষ্ট্রীয়ভাবে অথচ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাটিকে বেসরকারি রেখে এখানকার শিক্ষকদের এক করুণ অবস্থার মধ্যে ফেলে দিয়ে আমরা কত দার্শনিক কথা বলে বেড়াই। আজ যেসব শিক্ষক এমপিও পাচ্ছেন, তার পেছনে ঝরেছে অনেক ঘাম, রক্ত, আছে পরিশ্রম এবং তীব্র আন্দোলনের ইতিহাস। কিন্তু কোনো সরকারই তাদের কাছে মাথা নত করেনি। এরশাদ আমলেও শিক্ষকরা এসএসসি পরীক্ষার সময় আন্দোলন করেছিলেন, এরশাদ সরকার বীরের মতো তাদের কাছে মাথা নত না করে অন্যান্য পেশায় নিয়োজিত লোকদের দ্বারা পরীক্ষা পরিচালনা করেছিল। এ এমপিও রাষ্ট্র থেকে ইচ্ছায় তাদের দেয়া হয়নি, যদিও দেশের নাগরিকদের শিক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। এখনো এমপিও শিক্ষকরা রাষ্ট্রীয় নতুন কোনো সুবিধা থেকে বঞ্চিত থেকেই যাচ্ছেন। তাদের কথা কখনই সাধারণভাবে বলা হয় না। সবার কথাই বলা হলো যে চাকরিতে যোগদান করার পর পরই তারা পূর্ণ বোনাস পাবেন, উল্লেখ করা হলো না এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের কথা। শিক্ষকসমাজের প্রতি অবজ্ঞার এ চিত্র আমরা কি দেখতেই থাকব?
লেখক : মাছুম বিল্লাহ, শিক্ষা গবেষক।