রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২০ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০০:০০

শহীদুল্লাহ মাস্টার : স্মৃতি অমলিন
অনলাইন ডেস্ক

অঝোর বৃষ্টিস্নাত শ্রাবণেরই দিন ছিলো সেটি। সন’টি আশি বা একাশি হবে। বিয়ের পর ‘ফিরানী’ (মানে, নববিবাহিত মেয়েদের প্রথম বাপের বাড়ি বেড়াতে যাওয়া) শেষে ভাবীকে আনতে যাবেন শহীদ ভাই। বন্ধু বলা যাবে না, ছোট ভাই হয়েই সঙ্গী হলাম শহীদ ভাইর। কিছু কিছু এলাকায় তখনও বর্ষা মৌশুমে নৌকাই ছিলো গ্রামাঞ্চলে যাতায়াতের প্রধাণ ও সুবিধাজনক বাহন। ‘কেরাইয়া’ নাও (সাধারণত চুক্তিতে ভাড়া করা ডিঙ্গি নৌকা) ভাড়া করা হলো একটি। বাবুরহাট, নাকি মুন্সিরহাট থেকে যাত্রা শুরু করলাম মনে নেই। ছৈ-এর নিরাপদ আশ্রয়ে আয়েশে বসে বিলের জলে বৃষ্টির রিনিঝিনি গান শুনতে শুনতে এবং ‘কার্ল মার্ক্স’, ‘লিনিন’, আর বাংলা কাব্যকথার গল্পে গল্পে কখন যে ভাবীদের বাড়ি পৌঁছে গেছি বুঝতেই পারিনি।

বাড়ির এক পাশে নৌকা ভিড়লো। আম, জাম, কাঁঠাল, নারকেল, সুপারি গাছের ছায়াঘেরা বাগানের মতো প্রশস্ত একটি চত্বর পেরিয়ে বসতঘর। কয়েকজন ছাতা নিয়ে এগিয়ে এলেন। আধাভিজা হয়ে ঘরে উঠলাম। তার পর অবিরল ধারা বর্ষণের সেই দিনটি কটেছে ঘরে বসে গল্প করেই। না, সেই গল্প-কথায় অবশ্যই মার্ক্স, লেনিন বা কলা-কাব্য ছিলো না! নিরেট হাসি আনন্দের ঝংকারে আটশাট করে বুনা গল্পের জালে জড়ানো ছিলো সেই সোনালি দিনটি।

প্রাথমিক জলপান পর্ব শেষে শহীদ ভাই আর আমি দুই দলে ভাগ হয়ে গেলাম। শহীদ ভাই তুলনামূলক বয়স্কদের দলে, আর আমি তরুণ-কিশোরদের দলে (বয়স হওয়ার পরও বয়স্কদের সাথে আমি কেমন যেনো যেতে পারি না!)। সেদিনের কল্পলোকে দুজনের ছবিই সংরক্ষিত আছে। ভাবীর ছোট বোন ও ছোট ভাই। দুজনই আমার চেয়ে কম বয়সী হলেও গল্পে, গল্পে বয়সবৈষম্য ঘুচে যায় সহসাই! করো সাথে গল্প করার সময় যদি মনে হয়, ‘আর কখনো এভাবে দেখা না-ও হতে পারে (!)’, তাহলে কথায়, গল্পে একটু বাড়তি অন্তরঙ্গতা যুক্ত হয়! গল্পে ডুবে যেতেই মনে হয় এই বাড়ি, এই পরিপার্শ্ব এবং মানুষেরা অনেক দিনের পরিচিত। হয়তো তাই, সেদিনের স্মৃতিটুকু উল্কীর মতো লেগে আছে গায়ে!

তখনকার দিনে সাত থেকে দশ টাকায় পাওয়া যেতো যে কোনো কাব্যগ্রন্থ। নির্মলেন্দু গুণ, শামসুর রাহমান, আবুল হাসান এঁরা ছিলো আমার প্রিয় কবি। পাবলো নেরুদা, খলিল জিব্রান এঁদের অনুবাদের প্রতিও ভক্তি ছিলো। রুদ্র মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ তখন উঠতি কবি। তখনকার সময়ে দ্রোহের কবিতাই জনপ্রিয় ছিলো। নির্মলেন্দু গুণের কবিতার সাথে শামসুর রাহমানের ‘বন্দীশিবীর থেকে’ কাব্যগ্রন্থের কবিতা তখন বামপন্থিদের জনসভায়ও আবৃত্তি হতো। ঢাকায় এলে অনেক সময়ই দুপুরের খাবারের পয়সা বাঁচিয়ে বা রিকশা ভাড়া বাঁচিয়ে একটি কবিতার বই কিনেছি। বহুদিন নিউমার্কেটের বইয়ের দোকান ঘুরে, দুটি সিংগারা খেয়ে দুপুর কাটিয়ে, নিউমার্কেট থেকে পায়ে হেঁটে সদরঘাট এসে চাঁদপুরের লঞ্চে উঠেছি। আমার মনে আছে শহীদ ভাইয়ের বিয়েতে ভাবীকে কুড়ি টাকা দামের দুটি কবিতার বই উপহার দিয়েছিলাম!

শহীদ ভাই একটু বেশি বয়সেই বিয়ে করেছেন (অবশ্য, সেকালের হিসেবে)! তখন তার বয়স (অনুমান) ৩৮ থেকে ৪০-এর মধ্যে হবে। তবে তখনও তিনি আজকের মতোই প্রতিষ্ঠিত ও পরিচিত মানুষ ছিলেন! ওই সময় তিনি দ্বিতীয় দফায় ইউনিয়ন পরিষদের জনপ্রিয় চেয়ারম্যান ও জেলা ন্যাপের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। জেলা ও জতীয় রাজনীতিতে ভূমিকা, গণমানুষের সাথে সম্পর্ক এবং সামরীক স্বৈরাচারনির্ভর মাস্তানী, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সাহসী ভূমিকার জন্যে সমগ্র চাঁদপুর জেলায় তাঁর জনপ্রিয়তা ছিলো ঈর্ষণীয়!

আমাদের সময়ের অনেক বামপন্থি নিবেদিতপ্রাণ (বিপ্লবী) রাজনৈতিক নেতা-কর্মী স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বয়সে বিয়ে করেছেন, কেউ কেউ চিরকুমার থেকেছেন। তখন একটি ধারণা ছিলো বিপ্লবীরা সংসারী হলে ‘বিপ্লব’ উচ্ছন্নে যাবে। ঠিক এ রকমটি না হলেও রাজনীতি, সমাজকর্ম নিয়ে অতিব্যস্ততা ও পরিবারিবারিক (মা, বোন, স্বজনদের) দায়িত্ব পালনে আন্তরিকতা এসব কারণেই স্বাভাবিক সময়ে (আরো বছর পাঁচেক আগে) তিনি বিয়ের কথা ভাবতে পারেননি। তবে বাস্তব জীবনে বিয়ে তাঁর অতীত জীবনের কর্মযজ্ঞের কোনো ক্ষেত্রকেই এতোটুকু সংকুচিত করতে পারেনি।

পেশাগতভাবে শহীদ ভাই বাবুরহাট হাইস্কুলের শিক্ষকতায় নিযুক্ত ছিলেন। একজন আপাদমস্তক সৎ মানুষ হওয়ার কারণে বলতে গেলে এটাই ছিলো তার আয়ের প্রধান উৎস। বিয়ের পর ভাবীও শিক্ষকতার পেশায় নিযুক্ত হলে পারিবারিকভাবে তার অর্থনৈতিক ভিত্তিটি একটু মজবুত হয়। এছাড়া ভাবী মানসিকভাবে রাজনীতিসচেতন ও প্রগতিশীল হওয়ার কারণে তার রাজনীতি, সমাজকর্মে অনুপ্রেরণনার ঘাটতি পরেনি। বিয়ের আগে শহীদ ভাইয়ের সাথে আমাদের আড্ডাটা হতো প্রধাণত বাবুরহাট বাজারে বা আমাদের বাড়িতে, বিয়ের পরে ৬০ ভাগ আড্ডা সিফ্ট হলো শহীদ ভাইয়ের বাড়িতে।

বাবুরহাটে শিশু সংগঠন ‘খেলাঘর’-এর কমিটি করা হলো। শহীদ ভাইয়ের স্ত্রী হলেন সভাপতি। কোনো এক ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ ভাইয়ের স্ত্রী সুরাইয়া আক্তারের সম্পাদনায় ‘খেলাঘর’ বাবুরহাট শাখা প্রকাশ করলো ছড়া সংকলন ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’। ভাবীর সাথে সেই সংকলন প্রকাশের স্মৃতিটুকুও আমার হৃদয়ের আঙ্গিনায় শ্রাবণের জলেভেজা কাঁঠাল পাতার মতো ঝুলে আছে-উজ্জ্বল।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়