প্রকাশ : ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০০:০০
রাজা পঞ্চম জর্জের রাজ্যাভিষেকের দরবার বসে নগরীর অদূরে বুরাডিতে। এর আগে ১৯১১ সালের ২২ জুন ইংল্যান্ডের ওয়েস্টমিনিস্টার অ্যাবেতে তাঁর অভিষেক হয়। এই প্রথম ভারতবাসী দেখছে তাদের হবু রাজাকে। এর আগে পাইক পেয়াদাকে রাজপুরুষ ভেবে পরম শ্রদ্ধা-ভক্তি করতো। তাই তাদের মধ্যে উচ্ছ্বাসের অন্ত নেই।
রাজাও তার সুবিশাল উপনিবেশ দেখে বিস্ময়াভিভূত। কিছু নাবিক বাণিজ্য করতে এসে কি বিশাল এক রাজ্য দখল করে নিয়েছে! এর আগে শুধু গল্পই শুনেছেন, ভারতের হীরা জহরতের, ফল ফসলের, এখন দু চোখে ভরে দেখছেন। মুগ্ধ হচ্ছেন!
রাজা খুশি হয়ে সৈনিক ও নিম্নপদস্থ কর্মচারীদের এক মাসের অতিরিক্ত বেতন প্রদানের ঘোষণা দেন। অনুগত ভারতের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের স্যার, রাজা, মহারাজা, নওয়াব, রায় বাহাদুর ও খানবাহাদুর প্রভৃতি সম্মানসূচক উচ্চ খেতাব প্রদান করেন মুক্তহস্তে।
সেই দরবারে হাজার মাইল পূর্বে অবস্থিত জলঘেরা এক প্রদেশের মানুষের জন্যে দুটি ঘোষণা দেন। একটি খারাপ, আরেকটি ভালো। খারাপটি আগে বলি।
প্রদেশটির নাম পূর্ববঙ্গ ও আসাম। মাত্র ৬ বছর আগে প্রদেশটি হয়েছে। সেই থেকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন শুরু হয়েছে। আন্দোলন দমাতে রাজা ঘোষণা দিলেন পূর্ববঙ্গ প্রদেশ আবার বাংলার অংশ হয়ে যাবে। আবার যুক্তবাংলা গঠিত হবে। তবে ব্রিটিশরাও হার মানবার জাতি নয়। বিনিময়ে পশ্চিম বাংলার কলকাতা থেকে রাজধানী দিল্লিতে সরিয়ে আনা হবে।
পুনর্গঠিত যুক্ত বাংলার জন্যে গভর্নর-ইন-কাউন্সিল সৃষ্টি করা হবে। বিহার, উড়িষ্যা ও ছোটনাগপুরকে বাংলা থেকে বিচ্ছিন্ন করে এদের সমন্বয়ে একজন লেফটেন্যান্ট গভর্নরের অধীনে নতুন প্রদেশ সৃষ্টি করা হবে। আসামের মর্যাদা পুনরায় হ্রাস করে একজন চীফ-কমিশনারের অধীনে দেয়া হবে। আরো ঘোষণা করা হয়, তখন থেকে ভাইসরয় ক্রমান্বয়ে শুধু রাজকীয় স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয় দেখাশোনা করবেন এবং প্রাদেশিক শাসনকার্য গভর্নর-ইন-কাউন্সিল ও নির্বাচিত সংস্থা কর্তৃক স্বশাসিতভাবে পরিচালিত হবে। এর ফলে ভারতীয়রা সীমিত পরিসরে দেশ শাসনের ক্ষমতা পায়। মন্ত্রীর পদ সৃষ্টি হয়। এসব ঘোষণার পর ভারতে ব্রিটিশবিরোধী ক্ষোভ সাময়িক স্তিমিত হয়।
আর ভালো খবরটি হলো সেই প্রদেশের রাজধানীতে একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য ৫০ লক্ষ টাকা বরাদ্দের ঘোষণা দেন রাজেশ্বর। সেই ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯২১ সালের ১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রায় দশ বছর পর! এতো দেরি হওয়ার কারণ কী?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র ও শিক্ষক বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ অমিয়কুমার দাশগুপ্তের কন্যা অলকনন্দা প্যাটেল তাঁর স্মৃতিকথা ‘পৃথিবীর পথে হেঁটে’-তে লিখেছেন: ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শুরু হয় ১৯২১-এ, তবে এ নিয়ে কথাবার্তা চলছিলো অন্তত দশ বছর ধরে। শেষ পর্যন্ত ‘সেন্ট্রাল লেজিসলেচার অ্যাক্ট’ অনুযায়ী ঢাকা ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠিত হয়। স্যার আশুতোষ ঘোর বিরোধিতা করলেন, ফট ইট টুথ অ্যান্ড নেইল-দ্বিতীয় ইউনিভার্সিটি হলে তাঁর জমিদারি খাটো হয়ে যাবে। বিরোধিতা সংক্রামক ব্যাধি, সেই যে ঢাকার স্নাতক বা অধ্যাপকদের প্রতি কলকাতার তরফ থেকে অবজ্ঞা শুরু হলো, কোনোদিন মুছে গেছে কিনা জানি না।’
মূলত পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশ সরকারের পরিত্যক্ত ভবন ব্যবহার করে এই বিশ্ববিদ্যালয়টি যাত্রা শুরু করে। বাৎসরিক ১ হাজার টাকা ভাড়ার ভিত্তিতে রমনা এলাকার ৭২৮ বিঘা জমি এবং এর উপর স্থাপিত পূর্ব ও আসাম প্রদেশ সরকারের ভবনগুলো ভাড়া দেয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে।
মজার ব্যাপার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয় ঢাকা ও জগন্নাথ কলেজের স্নাতক পর্যায়ের ছাত্র ও কিছু শিক্ষক নিয়ে। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দুটো হলের নাম ঢাকা ও জগন্নাথ হল রাখা হয়। এছাড়া সিলেট এমসি কলেজ থেকে অনেক বই ও বিজ্ঞানের উপকরণ দেয়া হয় নবপ্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়টিকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংগ্রহে যাতে ব্যাঘাত না ঘটে তাই জগন্নাথ কলেজ ও ঢাকা কলেজ থেকে স্নাতক শ্রেণি তুলে দেয়া হয়।
১৯২১ সালে রমেশচন্দ্র মজুমদার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে যোগদান করেন। তিনি তাঁর স্মৃতিচারণে লিখেছেন : ‘ঢাকা শহরের উপকণ্ঠে রমনা মাঠ নামে একটি বিস্তৃত প্রান্তর ছিল। এই রমনা মাঠে নতুন শহর পত্তন করে বড় বড় সরকারী দফতর এবং কর্মচারীদের বসবাসের জন্য সুন্দর সুন্দর অনেক বাড়ি তৈরি হয়। প্রত্যেক বাড়িতেই বড় বড় কম্পাউন্ড, বাড়িগুলিও ফাঁকা ফাঁকা, প্রশস্ত ও সুপরিকল্পিত রাস্তা’।
কিন্তু কী লক্ষ্য সামনে রেখে এই বিশ্ববিদ্যালয়টির যাত্রা শুরু হয়েছিলো? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য বর্ণনা করতে গিয়ে এর প্রথম উপাচার্য স্যার উইলিয়াম হর্টগ ১৯২৯ সালে লক্ষ্মৌতে দেয়া এক বক্তৃতায় বলেন, ‘আমার মনে হয় ভারতবর্ষের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একটি বিষয়, সে বিষয় যা-ই হোক, নানা দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখতে শেখা, চিন্তা করা, ছাত্রদের শেখানো হয় না। তাই নিজের মতামত তৈরি করার মতো শিক্ষাও দেওয়া হয় না। ছাত্ররা বিচার করতে শেখে না, শিক্ষকের কথা মেনে চলে। মতভেদের সাহস বা যোগ্যতা কোনোটিই তাদের হয়ে ওঠে না। মনে পড়ে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে চাকরিপ্রার্থী এক ভদ্রলোককে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তোমার বক্তৃতার পর কোনো ছাত্র যদি এসে বলে, দুঃখিত স্যার, আপনার সঙ্গে একমত হতে পারছি না, আমার চিন্তা অন্যভাবে বিষয়টিকে দেখছে-তুমি কী বলবে?
উত্তর ছিলো, আমি মনে করি আমার থেকে আলাদা মত রাখবার অধিকার কোনো ছাত্রের নেই। আমরা ওকে নিইনি।
তবে কেবল সুবিচার দিয়ে মতামতের যোগ্যতা জীবনের পাথেয় হয় না, কারণ দৃঢ়বিশ্বাস যুক্তিকে হাওয়ায় উড়িয়ে দিতে পারে। চরিত্রের তাই সাম্যতার প্রয়োজন। এটা পাওয়া কঠিন; তার থেকেও কঠিন জীবনের লক্ষ্য ঠিক করে সবকিছু ছেড়ে সেই লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে চলা।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ব্যাচের ছাত্র ছিলেন অমিয়কুমার দাশগুপ্ত। তাঁর কন্যার বিবরণী থেকে জানা যাক কোন প্রেক্ষাপটে তাঁর পিতা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে না গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন: ‘‘আমার বাবা, অমিয়কুমার দাশগুপ্ত ১৯২২-এ বরিশালের বিএম কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে উচ্চশিক্ষার জন্য এলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিষয় অর্থনীতি। বিশ্ববিদ্যালয় তখন নতুন, সবেমাত্র ১৯২১-এ শুরু হয়েছে। বিলেতের অক্সফোর্ড-কেমব্রিজ ঘেঁষা শিক্ষাপদ্ধতি, ইংরেজি কায়দায় বিশাল সুদৃশ্য দালানে কলেজ (বিশ্ববিদ্যালয়কে তখন কলেজ বলা হতো), ছাত্রদের আবাস, খোলা মাঠ, পুষ্পশোভিত গাছপালা, ছাত্রদের কাছে সবকিছু রোমাঞ্চকর, বিশেষ করে পূর্ববঙ্গে গ্রাম বা ছোট শহর থেকে যাঁরা আসতেন, তাঁদের কাছে। পূর্ববঙ্গে এই প্রথম ইউনিভার্সিটি, সবার পক্ষে কলকাতা গিয়ে পড়াশোনা করা সম্ভব হতো না, আর্থিক সংকট ছিল প্রধান বাধা, তাঁদের কাছে এই নতুন শিক্ষাকেন্দ্র এনে দিলো উচ্চশিক্ষার বিরাট সুযোগ।’
প্রথম পর্বে কারা এসেছিলেন শিক্ষক হয়ে, তাদের সম্পর্কে সে-সময়ের ছাত্র, পরে বিখ্যাত কবি, কিরণশঙ্কর সেনগুপ্ত লিখেছেন : ‘এমন নয় যে হরিদাস ভট্টাচার্য, সত্যেন বসু, রমেশ মজুমদার, এফ রহমান এরা কোথাও বেকার বসেছিলেন, আর চাকরি খালির বিজ্ঞাপন দেখে তাঁরা কলকাতা ছেড়ে ঢাকাতে দৌড়ে এসেছিলেন। তাঁদের সংগ্রহ করা হয়েছিলো। আর তার প্রতিষ্ঠানগত কৃতিত্ব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকালের সাংগঠনিক কমিটির হলেও, বিশ্ববিদ্যালয়ের কাগজপত্রে যে ব্যক্তির ঐকান্তিক আগ্রহ, পরিশ্রম ও চেষ্টার পরিচয় পাওয়া যায় তিনি না বাঙালি, না ভারতীয় এবং না হিন্দু, না মুসলমান। তিনি ইংরেজ-পি জে হার্টগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বপ্রথম ভাইস চ্যান্সেলর বা উপাচার্য। তিনিও বেকার ছিলেন না। ভারতীয় শিক্ষা সার্ভিস বা আই.ই.এস-এর অভিজ্ঞ ও উচ্চতর সদস্য। কিন্তু ঢাকাতে বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি, তার সাহিত্য, বিজ্ঞান, দর্শন, আইন-সকল বিভাগের জন্য উপযুক্ত শিক্ষক অন্বেষণের যে প্রচেষ্টা হার্টগ সাহেব চালিয়েছিলেন, সেটি তাঁকে একজন যথার্থ কর্মী, জ্ঞানী এবং উদ্যোগী সংগঠক হিসেবে প্রমাণিত করে। আজকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের উচিত সেই গোড়াকার সকল প্রয়াস ও প্রচেষ্টার মধ্যে যাঁরা ছিলেন, পি জে হার্টগ এবং তাঁর অন্য সহকর্মীদের পরিচয় সংগ্রহ করে প্রকাশ করা।’
কিরণ ১৯৩৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তিনি তাঁর তেজস্বী শিক্ষকদের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লিখেছেন : ‘স্পেশাল বাংলা ক্লাসে প্রথম বছরেই যাঁর মুখোমুখি হলাম তিনি আজকের বাংলা সাহিত্যের একজন ব্যক্তিত্ব-মোহিতলাল মজুমদার। সাহিত্যের একজন জিজ্ঞাসু ছাত্র হিসেবে আমি দু’বছর তাঁর কাছে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলাম এবং এই দু’বছরের মধ্যেই প্রধানত তাঁর বক্তৃতা ও আলোচনা আমার সাহিত্যবিচারের পরিধি ও রসবোধকে ব্যাপকতর করতে যথেষ্ট সাহায্য করেছিলো। বস্তুত সৎসাহিত্যের এই স্রষ্টার কাছেই মধুসূদন ও রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে গভীরভাবে পড়বার ও ভাবিত হবার প্রেরণা প্রথম লাভ করেছিলাম। মোহিতলাল যখন ক্লাসে পড়াতেন তখন ছাত্রছাত্রীরা একাগ্রচিত্তে শুনতেন, বেলাইনের ছাত্ররাও অর্থাৎ কমার্স-এর ছাত্র, বিজ্ঞানের ছাত্ররাও অনেক সময় এসে বসতেন নিঃশব্দে পেছনের বেঞ্চিতে, তাঁর বক্তৃতা শোনার জন্য।’
তবে শিক্ষকদের সবচেয়ে প্রাণবন্ত বর্ণনা মেলে কবি বুদ্ধদেব বসুর লেখায় : ‘পথে পথে আরো অনেক চেনামুখ, কখনো দেখি বিজ্ঞান বিখ্যাত সত্যেন্দ্রনাথ বসু চলেছেন মন্থরচনে-হাতে গোল্ড ফ্লেকের টিন, জামা বোতামহারা, চুল উশকোখুশকো, ছাঁটা চুল। চোখে সোনার চশমা, গিলে করা চুড়িদার পাঞ্জাবিতে সুপ্রশাধিত যেই যান বিরল পথেও অতি সতর্ক সাইকেল চালিয়ে আস্তে আমাকে ছাড়িয়ে যান ডক্টর সংস্কৃত বাংলার অধ্যাপক সুলীল কুমার। বা হয়তো দেখা যায়– জগন্নাথ হলের দিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটকে ঢুকলেন ইতিহাস বিশারদ রমেশচন্দ্র মজুমদার, যুবকদের চাইতেও দ্রুত এবং বলিষ্ঠ তাঁর পদক্ষেপ অথবা, আমি যখন কলেজের গাড়ি বারান্দায় ঠিক তখুনি সাইকেল থেকে নামেন আমাদের ইংরেজী বিভাগের সত্যেন্দ্রনাথ রায়, সারা বিশ্ববিদ্যালয়ে যার তুল্য লাজুক অধ্যাপক আর নেই-আমাকে দেখে ঈষৎ লাল হন তিনি, মৃদু কেশে নরম আওয়াজে বলেন, ‘এই যে বুদ্ধ ভালো আছো?’ আমি করিডোর দিয়ে যেতে যেতে শুনি ঘণ্টার শব্দ।’
কেমন ছিলো প্রথম দিককার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়? সাংবাদিক আবু জাফর শামসুদ্দীন-এর ‘আত্মস্মৃতি’ গ্রন্থে লিখেন : ‘কাজী নজরুল ইসলাম ঢাকা এসেছিলেন ১৯২৬ এবং ১৯২৭ সালে। মুসলিম হলে মুসলিম সাহিত্য সমাজে এক অধিবেশনে তাঁকে দেখতে গিয়েছিলাম। তখন এস.এম. হল ছিল বর্তমান মেডিকেল কলেজের ওপর তলায়, নিচে বিশ্ববিদ্যালয়। নিচের তলার একটি বড় কামরায় (সম্ভবত ডাইনিং হলে) অধিবেশন হয়। কিন্তু সেদিন সকালে অধিবেশনে কবি উপস্থিত হতে পারেননি।’
এখানে উল্লেখ্য, এর বাইরে দুটো হল ছিলো। একটি জগন্নাথ হল ও ঢাকা হল। পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের অ্যাসেম্বলি হল নিয়ে জগন্নাথ হল এবং আশপাশের ভবন নিয়ে ঢাকা হল প্রতিষ্ঠিত হয়। আর সদরঘাটে খ্রিস্টান ছাত্রদের একটি হল ছিলো। সেটি অবশ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পরিচালনা করতেন না।
উন্মেষ পর্বের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতি রোমন্থন করে পরিমল রায় লিখেছেন: ‘মনে পড়িতেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম ভর্তি হইয়া আমাদের কী আনন্দ। সেকালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রমনার সাত সমুদ্র ছড়াইয়া ছিল। ‘চামারি’ হইতে নীলক্ষেত তরুণ বিদ্যার্থীর বিপুল সাম্রাজ্য, রীতিমতো দিগ্বিজয়ে বাহির হইবার আমন্ত্রণ। আমরা নতুন আগন্তুকরা কিছুদিন দিশাহারা আত্মহারা হইয়া ঘুরিয়ে বেড়াইতে লাগিলাম। যাহা দেখি, তাহাতেই মুগ্ধ হইয়া যাই। কমন রুম দেখিয়া বিস্ময় মানিলাম, লাইব্রেরিতে ঘুরিয়া অভিভূত হইলাম, সুবেশ অধ্যাপকদের দেখিয়া উচ্ছ্বসিত হইলাম, দীর্ঘ করিডরগুলি রুদ্ধশ্বাসে হাঁটিয়া ফিরিলাম, ঘোমটাপরা তরুণী বিদ্যার্র্থিণীদের দেখিয়া চক্ষু কৌতূহলী হইয়া উঠিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চার বৎসর ছাত্রজীবন কাটাইয়াছি। তাহার প্রত্যেকটি দিন মুক্ত স্বচ্ছন্দ ও সুন্দর। ইচ্ছা হয় ক্লাশে যাও, ইচ্ছা না হয় যাওয়ার আবশ্যক নাই, আমাদের কালে হাজিরা গোনার নিয়মই ছিল না। দরকার হইলে লাইব্রেরিতে যাইতে পার, না হইলে গাছের তলায় গিয়া জুটিতে পার। আদিত্যর চায়ের দোকানে আড্ডা জমাইতেও বাধা নাই, কমনরুমে গিয়া কুশন-আঁটা চেয়ারে তোফা ঘুম লাগাইতেই বা দোষ কী? প্রতি সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কোথাও না কোথাও সেমিনার, কোথাও বা বক্তৃতা। রমনার প্রতি সন্ধ্যা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিধ উৎসবে আলোকিত, যেখানে খুশি গিয়া বসিলেই হয়। জনতায় ভিড়িবার ইচ্ছা না থাকে, রমনার দীর্ঘায়িত পথগুলিতেই হইহই করিয়া ঘুরিয়া বেড়াও, ক্ষুধার উদ্রেক হইবে।’
বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ ভবতোষ দত্ত লিখেছেন: ‘ঢাকায় যে কত সহজ ও স্বাভাবিক এই স্বজনবোধ সেটা তাঁরাই জানেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই সময়ের আবহাওয়ায় যাঁরা বড় হয়েছেন। সেখানকার পরিবেশই ছিল আলাদা। শহরের উপকণ্ঠে রমনার কয়েকশো একর জমি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়। উদার সবুজাস্তীর্ণ মাঠে মোগল স্থাপত্যরীতিতে নির্মিত ছড়িয়ে থাকা সেসব সুরম্য সৌধ্য, মাঝেমধ্যে টলটলে বাঁধানো পুকুর, সবুজের মধ্যে গড়িয়ে যাওয়া পিচের কালো রাস্তা। রাস্তার ধারে ধারে গাছ বিশ্ববিদ্যালয়ের রক্ষীর মতো। একদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অট্টালিকাশ্রেণি আরেকদিকে ছাত্রাবাস, ঢাকা হল, জগন্নাথ হল, ফজলুল হক হল, সলিমুল্লাহ হল। কার্জন হল ও লিটন হলে বসত সান্ধ্য অনুষ্ঠান-সাহিত্যসভা অথবা নাটকের অভিনয়। আজ এতদিন পরে যখন পেছন ফিরে তাকাই, তখন মনে হয় যেন রূপকথার রাজ্য পেরিয়ে এসেছি।’
তৎকালের রক্ষণশীল ঢাকায় অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো মুক্ত প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন বাধার সম্মুখীনও হয়েছিল। কিরণশঙ্কর সেনগুপ্তের বর্ণনায়: ‘সম্প্রদায়গতভাবে মুসলমান-প্রধান পূর্ববঙ্গের ঢাকা শহর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কিন্তু তখনো, আমার অধ্যয়নকালেও, চল্লিশের দশকে, সংখ্যায় হিন্দু ছাত্রছাত্রীই বেশি। মুসলমান ছাত্রী তো কুল্লে ডজনখানেক। রমনা নতুন শহর। রেললাইনের দক্ষিণ পাড়ে পুরনো শহর। রমনা যদি-বা মুক্ত, কিছুটা উদার, ঢাকা রক্ষণশীল। মুসলমান ছাত্রী যারা ঢাকা থেকে আসত, তারা আসত বদ্ধ দরোজা-ঘোড়ারগাড়িতে। রেললাইন পেরুলেই মাত্র গাড়ির দরজা আর মাথার ঘোমটা ফেলে দিতে সাহস পেত। কিন্তু ঢাকা ইউনিভার্সিটি অভিহিত হতো ‘মক্কা ইউনিভার্সিটি’ বলে।’
সেই রক্ষণশীল সমাজে ছাত্র-ছাত্রীদের সম্পর্ক কেমন ছিলো তা বুদ্ধদেব বসুর লেখায় উঠে এসেছে : ‘একমুঠো ছাত্রীও আছেন আমাদের সঙ্গে-আছেন এবং অনেক বিষয়ে নেই। যেমন দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক, পৃথকৃত ও সুরক্ষিত এক অতি সুকুশর উপবংশ, তারা অবকাশের প্রতিটি মিনিট যাপন করেন তাদের পর্দায়িত বিশ্রাম-কক্ষে, অধ্যাপকদের নেতৃত্ব ছাড়া সেখান থেকে নিষ্ক্রান্ত হন না। প্রতিটি ঘণ্টা শুরুতে এবং শেষে করিডোরগুলো বিভিন্নমুখী মিছিলে ভরে যায়, মহিলাগুলোকে পশ্চাৎবর্তী করে চলেছেন এক একজন অধ্যাপক, পুনশ্চ নির্বিঘ্নে পৌঁছে দিচ্ছেন তাদের কমনরুমের দোরগোড়া পর্যন্ত। ক্লাসে তাদের জন্য বসার ব্যবস্থা আলাদা, আমাদের বেঞ্চিগুলো থেকে দূরে বসানো চেয়ারে, সেখানে তারা চক্ষু : নত রাখেন পুঁথির উপর, কোনো প্রশ্ন করেন না অধ্যাপককে, পাঠ্য বিষয়ে হাসির কথা থাকলেও তাদের গাম্ভীর্যে টোল পড়ে না। এমন নয় যে, করিডোর বা ক্লাসের মধ্যে কোনো দৃষ্ট ভ্রমর কখনো ছুটে আসে না আমাদের দিকে কিন্তু দর্শন পেরিয়ে শ্রবণে তারা কখনোই প্রায় ধরা দেন না, শুধু মূক শ্রোতার ভূমিকা নেন নাট্যাভিনয় বক্তৃতা ইত্যাদি অনুষ্ঠানে। আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের চার বছরে আমি প্রকাশ্যে ছাত্রী কণ্ঠ শুনেছিলাম একবার মাত্র-শুধু মেয়েদেরই জন্য আয়োজিত এক প্রতিযোগিতায়: ছাত্রছাত্রীর মধ্যবর্তী এই স্বচ্ছ দেয়ালটিকে একেবারে নীরান্ধ্র ভাবলে কিন্তু ভুল হবে: বেয়ারার হাতে চিরকুট পাঠিয়ে ‘লেডিজ’ কমনরুমের দরজায় দাঁড়িয়ে, কোন বাসন্তীদের বা অমিতা চন্দর সঙ্গে দুচার মিনিট কিছু অর্থহীন কথা বলা এবং শোনা যায় না তা নয়-কোন কোন বদ্ধপরিকর ছাত্র তা করেও থাকে-কিন্তু দেখে মনে হয় উভয়পক্ষই অপ্রতিভ স্বাচ্ছন্দরহিত, আলাপ ঠিক জমছে না অথবা একে আলাপ বলাটাই ভুল। ব্যাপারটা খুব কৌতুক শোনাবে আজকের দিনে, কারো কারো পক্ষে অকল্পনীয়। কিন্তু প্রায় অর্ধ শতাব্দী আগেকার বাঙালি সমাজে, হাজার খানেক নবযুবার মধ্যে পনেরো কুড়িটি বিদ্যার্থিনী তরুণী নিয়ে এই ব্যবস্থাই স্বাভাবিক ও সংগত ছিল তা মানতে হবে। সেই সময়কার কথা ভাবলে আমি নিজেকে দেখতে পাই রমনার একটা রাস্তায়, যা চলে গেছে পুরনো পল্টনের মোড় থেকে সোজা পশ্চিমের দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিংহদ্বার পর্যন্ত এক মাইল।... পাঁচ মিনিট পরে সুন্দরের মধ্যে সব থেকে সুন্দর সেই তথাকথিত চামারিয়া হাউস (বর্তমান সিরডাপ হাউস); সেখান থেক বেরিয়ে এলেন পাঁচটি অথবা সাতটি সহপাঠিনী, আমি চলার গতি শ্লথ করে দিলাম যাতে অন্তত: পেছন থেকে তাদের নিরীক্ষণ করা যায়। সৈনিক অথবা খ্রিস্টান সন্ন্যাসিনীদের মতো শ্রেণীবদ্ধ হয়ে হাঁটছেন তারা সমতলে পা ফেলে ফেলে, মাথা আঁচলে ঢাকা, চওড়া পাড়ের সাদা সাদা শাড়ি পরনে, যৌবন সুলভ চঞ্চলতার কোনো লক্ষণ নেই, আর পা ফেলে এমন ঢিম লয়ে, যে একটু পরেই তাদের অতিক্রম না করে আমার উপায় থাকে না।’