মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪  |   ২৭ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   মিশরে ঈদে মিলাদুন্নবীর ঐতিহ্য ‘আরুসাত-আল-মোলিদ’ : জন্মদিনের পুতুল
  •   'বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের চেতনার রাজনৈতিক শক্তির বিকাশ অপরিহার্য'
  •   চাঁদপুরের ২৪তম পুলিশ সুপার মুহম্মদ আব্দুর রকিব
  •   ফরিদগঞ্জে ঈদে মিলাদুন্নবী উপলক্ষে শোভাযাত্রা
  •   ওয়াইফাই সংযোগ দিতে গিয়ে প্রাণ গেল যুবকের

প্রকাশ : ২০ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০

মাতৃতুল্য প্রিয় শিক্ষক

রাহমান জিকু
মাতৃতুল্য প্রিয় শিক্ষক

শৈশব-কৈশোরের পুরো সময় কেটেছে গ্রামীণ জনপদ ঘিরে। ২০১০ সালে পিএসসি, ২০১৩ সালে জেএসসি, ২০১৬ সালে এসএসসি এবং ২০১৮ সালে এইচএসসি পাসের মধ্য দিয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য জনপদ ছেড়ে শহরে পাড়ি জমালাম।

অচেনা শহরে চারপাশে যেন কেবল অসহায়ত্বের হাহাকার বইছে। সবকিছুই খুব অপরিচিত। এভাবেই কিছু সময় পেরিয়ে গেল। চট্টগ্রাম কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৮-১৯ সেশনে স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়ে গেলাম।

১০ সেপ্টেম্বর ২০১৮, সোমবার। অনার্স প্রথম বর্ষের ওরিয়েন্টেশন ক্লাস। সকালে উঠে ফ্রেশ হয়ে উৎফুল্ল মনে কলেজে যাচ্ছি। কলেজের প্রায় কাছাকাছি চলে আসি। হঠাৎ করে আচমকা ঝোড়োহাওয়া বয়ে ঝুম বৃষ্টি নামল। কোনোমতে দৌড়ে কলেজের প্রধান ফটকের নিচে আশ্রয় নিলাম। এদিকে ঘড়ির কাঁটা ১০টা পেরিয়ে আরও ২০ মিনিট অতিক্রম করে ফেলছে। কলেজের প্রধান ফটক থেকে আমার বিভাগ হেঁটে দুই মিনিটের পথ। কিন্তু বৃষ্টি উপেক্ষা করে যাওয়ার সাহস পেলাম না।

মুহূর্ত পরই প্রধান ফটকে একটা সিএনজি হর্ন বাজিয়ে উঠল। তৎক্ষণাৎ গেটের প্রহরী গেট খুলে দিল। সিএনজি ফটক দিয়ে প্রবেশ করতেই ভেতর থেকে একটা শব্দ ভেসে আসে আমার কানে, ‘এই বাবু শুনছ?’ এতটা মিষ্টি সুরে কেবল আম্মুর কাছে শুনেছি আমাকে ডাকতে। দুই পা বাড়িয়ে সিএনজির পাশে গিয়ে বললাম, ‘জি বলুন।’ কিছুটা স্মিতস্বরে আবারও বললাম, ‘আসসালামু আলাইকুম ম্যাম। জি বলুন।’ সালামের জবাব দিয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোন ক্লাসে তুমি? গেটে দাঁড়িয়ে আছ কেন?’

কিছুটা বিচলিত হয়ে বললাম, ‘ম্যাম, আমি অনার্স প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়েছি। ওরিয়েন্টেশন ক্লাসে যাচ্ছি। বৃষ্টির কারণে এখানে দাঁড়িয়ে।’ তিনি পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোন বিভাগ?’ বললাম, সমাজবিজ্ঞান। ম্যাম হেসে বললেন, ‘সিএনজিতে ওঠো।’ আমি ড্রাইভারের পাশে বসলাম। ম্যাম বললেন, ভেতরে বসো। ততক্ষণে সিএনজি ড্রাইভার সমাজবিজ্ঞান বিভাগের নিচের গেটে পৌঁছে গেল। আর আমি কিছুটা ভয় পেয়েও আনন্দিত ছিলাম। ততক্ষণে বুঝতে পেরেছি, ম্যাম সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক।

ম্যামের সঙ্গে সিঁড়িতে ওপরে উঠছিলাম। বুঝতে পারছিলাম ম্যাম হয়তো অসুস্থ, সিঁড়ি দিয়ে উঠতে কষ্ট হচ্ছিল। ওনার ব্যাগ নিতে চাইলে মৃদু হেসে বললেন, ‘এই তো উঠে গেছি।’ সমাজবিজ্ঞান বিভাগ ছিল দ্বিতীয় তলায়। এভাবেই ম্যামের সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ।

কিছুক্ষণ পরই ওরিয়েন্টেশন ক্লাস শুরু হলো। বৃষ্টির বিড়ম্বনায় ৪০ মিনিট দেরিতে ক্লাস শুরু হয়। রুম নম্বর ২০২। আমি বসি মাঝের সারির দ্বিতীয় বেঞ্চে। শিক্ষক আসতেই চমকে উঠে সালাম দিলাম। একটু আগে সিএনজিতে যে ম্যামের সঙ্গে এলাম, তিনিই ক্লাস নেবেন। কিছুটা ভালো লাগা কাজ করছিল, আবার একটু নার্ভাসও ছিলাম। নার্ভাস এ জন্য যে কিছুক্ষণ পরপরই ম্যামের দৃষ্টিতে পড়ছিলাম।

ম্যাম চেয়ারে বসলেন। নিজের পরিচয় দিলেন, ‘আমি খালেদা খানম; সহযোগী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ।’ তারপর আমাদের সঙ্গে পরিচিত হতে আগ্রহ প্রকাশ করলেন। সবাই এক-এক করে পরিচয় দিলাম। পরিচয় দিতে গিয়ে ম্যামের দিকে তাকাতেই মুখে শব্দ আটকে গেল। তিনি বিষয়টি খেয়াল করলেন এবং চেয়ার থেকে উঠে এসে আমার পাশে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘ভয় পেও না। রিলাক্স হয়ে বলো।’ ততক্ষণে সহপাঠীরা হেসে দিল। সেদিন উনার উৎসাহে সংকোচহীনভাবে পরিচয় দিতে পেরেছি।

ওরিয়েন্টেশন ক্লাস শেষ করে বাসায় ফিরে আসি। ম্যামের আন্তরিকতা আমাকে দারুণ মুগ্ধ করেছে। সেদিনের পর থেকে নিয়মিত ক্লাসে যেতাম। দিন যত যাচ্ছিল, বিভাগের শিক্ষকদের সঙ্গে একটা আত্মার সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেল। সব শিক্ষক আমাকে পছন্দ করতেন। তবে খালেদা খানম ম্যামের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি আন্তরিকতা গড়ে ওঠে। মাঝেমধ্যে উনাকে আন্টি বলেও সম্বোধন করতাম। তিনি তখন মৃদু হাসতেন।

আসলে শহর থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরত্বে থাকা আম্মুকে অনেক মিস করতাম। ম্যামের আন্তরিকতা ও ভালোবাসায় সেই অভাব কিছুটা হলেও দূর হতো। নিজের সন্তানের মতো সবকিছু তদারক করতেন, যেভাবে আম্মুরা সন্তানকে গুছিয়ে রাখেন।

এভাবে অনার্সের তিন বছর দারুণভাবে কেটে গেল। এই সময়ে আমি সর্বোচ্চ উপস্থিতির পুরস্কারও পেলাম। নিদারুণ চেষ্টা ও পরিশ্রমের মাধ্যমে ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে উত্তীর্ণ হই। বর্তমানে চতুর্থ বর্ষে পড়াশোনা করছি। ক্লাসও প্রায় শেষের দিকে। সামনে ফাইনাল পরীক্ষা।

এদিকে আমার মায়ের শূন্যতা ভুলিয়ে ক্লাসে মনোযোগী করে তোলা প্রিয় শিক্ষক খালেদা খানমের অবসরের চিঠি পৌঁছে গেল। কয়েক দিন আগেই তিনি বিভাগ থেকে বিদায় নিয়েছেন।

প্রিয় শিক্ষক,

খালেদা খানম ম্যাম

২০১৮ সালের ১০ সেপ্টেম্বর থেকে গত ১৪ জানুয়ারি পর্যন্ত আপনার সান্নিধ্যে ছিলাম। ১৫ জানুয়ারি চট্টগ্রাম কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগ আপনার শূন্যতায় হাহাকার। শিক্ষকদের রুমে নিত্যদিনের মতো সেদিনও গিয়েছিলাম।

আপনার ডেস্কের চেয়ারটি শূন্য পড়ে আছে। বড্ড মিস করছি আপনাকে। অবসরের অবকাশ ভালো কাটুক। যেখানেই থাকুন সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন। সর্বোপরি আপনার সার্বিক সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করি।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়